আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

রামপাল চুক্তি: পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা’র পরিসমাপ্তি

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ  

সুন্দরবনের সঙ্কট দূরত্বের মধ্যে কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবেশ ঝুঁকি বিবেচনা করে বাংলাদেশের পরিবেশবিদরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করেছেন, করছেন আন্দোলন। পরিবেশবাদীদের সমালোচনা সত্ত্বেও সম্প্রতি ২০০ কোটি ডলার অর্থায়নে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও ভারত।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল) এবং বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিলি) এর মধ্যে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। বিআইএফপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য এবং বিএইচইএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রেম পাল যাদব চু্ক্তিতে সই করেন।

চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার এই কেন্দ্র নির্মাণে প্রয়োজনীয় ১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। পরে বিআইএফপিসিএলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, “বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ বিপিডিবি এবং ভারতের এনটিপিসি’র সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিআইএফপিসিএল কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্ট বিআইএফপিসিএলের প্রথম প্রকল্প, যা সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।”

এনভাইরনমেন্টাল ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ)-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৩২০ মেগাওয়াটের এই প্রকল্পের জন্য বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হবে। অ্যাভোগ্রেডোর প্রকল্প অনুযায়ী ১ টন কয়লা পুড়লে ২ দশমিক ৮৬ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। সেই হিসেবে এই প্রকল্প ৮০ শতাংশ লোড ফ্যাক্টরে উৎপাদন করলেও বছরে ১ কোটি ৮ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হওয়ার কথা। যদিও প্রতিবেদনে সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করায় উদ্যোক্তাদের হিসেব মতোই ৭৯ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন করে বাকি কার্বন ফ্লাই অ্যাশে যোগ হবে বলে ধারণা দেয়া হয়েছে। যদি উদ্যোক্তাদের হিসেবে-ই সঠিক বলে ধরে নেয়া হয়, তারপরও প্রশ্ন হচ্ছে, ৭৯ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড কী কম ক্ষতিকর? যত উঁচু চিমনিই ব্যবহার করা হোক না কেন বাতাসের চেয়ে ভারী এই গ্যাস তো এই দেশেই ফিরে আসবে, ফিরে আসবে সুন্দরবনের বুকে।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়, ভারতের এনটিপিসি কোম্পানি সেই দেশের ছত্তিশগড়ে একই প্রকল্প অর্থাৎ একটি ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গ্রিন প্যানেলের ইআইএ রিপোর্ট প্রকল্পটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে প্রতিবেদন দাখিল করায় ভারত সরকার সেই প্রকল্পটি বাতিল করেছে । স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, যে প্রকল্পটি তার জন্মভূমি ভারতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হলো সেটি আমাদের দেশে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেল কীভাবে?

রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হবে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি নামে একটি কোম্পানিও গঠন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে ১৫% পিডিবি, ১৫% ভারতীয় পক্ষ আর ৭০% ঋণ নেয়া হবে। যে নীট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০% হারে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে একটা ফর্মুলা অনুসারে। সেই ফর্মুলাটি কী?

যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এর দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা। প্রতি টন ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ দেশীয় ওরিয়ন গ্রুপের সাথে মাওয়া, খুলনার লবন চড়া এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা তে যে ৩টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যে চুক্তি হয়েছে পিডিবি’র সাথে সেখানে সরকার মাওয়া থেকে ৪ টাকায় প্রতি ইউনিট এবং আনোয়ারা ও লবন চড়া থেকে ৩টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে। সরকার এর মধ্যেই ১৪৫ ডলার করে রামপালের জন্য কয়লা আমদানির প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তার মানে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দিয়ে পিডিবি এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে, সেটা নিশ্চিত। এক পর্যায়ে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সার্টিফিকেট না নিয়ে এই প্রকল্প চালুর বিষয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করে।

এমতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ইনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) রিপোর্টে এই প্রকল্পকে পরিবেশবান্ধব বলে সার্টিফিকেট দেয়া হয় এবং সেই প্রতিবেদন অনলাইনে আপলোড করে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। অথচ নিয়ম হচ্ছে প্রকল্প শুরুর আগেই ইআইএ প্রতিবেদন তৈরির পর সেটার ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন বা বাতিল করা। অবশেষে সেই ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া বিতর্কিত ইআইএ প্রতিবেদনকে সঠিক ধরে নিয়েই গত ২০ এপ্রিল ঢাকায় ভারতের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাক্ষরিত তিনটি চুক্তির মধ্যে রয়েছে- যৌথ উদ্যোগ চুক্তি, বাস্তবায়ন চুক্তি ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি।

আমরা যখন জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক আলোচনা জল্পনা-কল্পনা ও প্রশ্ন-উত্তরে মুখর, তখন খুবই নীরবে সরকার ভারতের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র/প্রকল্পের জন্য চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। লাভ-ক্ষতির হিসাব করলে এই প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এবং পরিবেশ ও জনপদে এই প্রকল্পের ঋণাত্মক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।

বাস্তবতা হচ্ছে- ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজন ও বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানোর জন্য আমাদের প্রচুর বিদ্যুৎ দরকার। এই দেশে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন না থাকা অনেকটা স্বপ্নতুল্য। ফুরিয়ে আসছে গ্যাসের মজুত। অর্থাৎ বিদ্যুৎ ক্রয় না করলে অথবা নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করলে দেশ জ্বালানি-বিপর্যয়ে পড়বে। বিদ্যুৎ ক্রয় দীর্ঘ মেয়াদিভাবে লাভজনক নয়। তাই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে। কী ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন দেশের জন্য লাভজনক ও নিরাপদ? কোথায় সেই কেন্দ্র হওয়া উচিত? রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কি অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক এই সুবিধাগুলো প্রদান করবে?

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রামপাল প্রকল্পের জন্য বাগেরহাটে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে (অনেক পরিবারকে উচ্ছেদ করে) বালু ভরাটের মাধ্যমে দু’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি হয় বাংলাদেশ (বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড; পিডিবি) ও ভারতের (ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন; এনটিপিসি) মধ্যে। এই প্রকল্প হবে বাংলাদেশের পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের মাত্র ৯-১৩ কিলোমিটারের মধ্যেই (যদি সরকারিভাবে দাবি হচ্ছে যে এটি সুন্দরবনের বাফারজোনের ১৪ কিলোমিটার দূরে), যা সুন্দরবনের বনাঞ্চল, পরিবেশ ও জীবসম্পদের জন্য বিপদজনক। এমনকি দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের টিকে থাকার জন্য আশংকাজনক। এরচেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে এই প্রকল্প হবে কয়লাভিত্তিক। যার নির্মাণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরুৎসাহিত করা হয় বা হচ্ছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন। কারণ এটি পরিবেশবান্ধব নয় এবং মানুষ ও জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর। যেমন, কানাডা ও ফ্রান্সে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন।

প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরের আগে কোনও প্রকার পরিবেশ বিপর্যয় বিষয়ক যাচাই ও গবেষণা না করে সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরে সরকারি সমীক্ষাতেই (প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ সমীক্ষা) দেখা যায় যে এটি পরিবেশ, বিশেষ করে সুন্দরবনের সংরক্ষিত জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর।

শুধু সুন্দরবন নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশের মানুষ ও জনপদের জন্য ব্যাপারটি ক্ষতিকর হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের পাশে বসবাসকারী মানুষজন দীর্ঘমেয়াদে ৩-৬ গুণ বেশি আক্রান্ত হন ক্যানসার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও নিউরোডিজেনারিটিভ স্নায়ুরোগে, যেহেতু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে সৃষ্ট বায়ু ও জল দূষণ মানুষকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সরকার বলছে যে এই প্রকল্পের ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অথচ এই প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে উচ্ছেদ করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। যারা এখন ভূমি ও কর্মহীন। এই জনপদের মানুষের প্রধান জীবিকা মাছ আহরণ, সুন্দরবন থেকে গাছগাছালি মধু ইত্যাদি আহরণ ও কৃষিকাজ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে সৃষ্ট দূষণে দীর্ঘমেয়াদে যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সুন্দরবন বিনষ্ট হবে তখন আরও অধিক মানুষ ভূমি ও জীবিকাহীন হয়ে যাবে।

মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ভারতীয় এনটিপিসি ৫০ শতাংশ মালিকানা পাবে এবং পিডিবিকে এনটিপিসি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। অর্থাৎ আমাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমাদের পরিবেশ ও জনপদ নষ্ট করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্যের কাছ থেকে আমাদের কিনতে হবে! ধারণা করা হচ্ছে- এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম হবে স্বাভাবিক বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ। পিডিবিকে লোকসানজনক ভর্তুকি দিতে হবে অথবা বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। তাছাড়া রয়েছে এই প্রকল্পের জন্য গৃহীত ঋণ ও এর সুদের হার। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য কতোটা লাভজনক, সেটি বুঝতে আমরা সক্ষম নই।

এনটিপিসি যদি এই প্রকল্প ভারতের অংশের সুন্দরবনের আশপাশে করতে চাইতো তবে অনুমতি পেতো না। ভারতীয় আইন মতে, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও জনবসতির ১৫-২৫ কিলোমিটারের মধ্যে এই ধরনের প্রকল্পের অনুমোদন নেই। তবে এনটিপিসি কেন বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে এসে ৯-১৩ কিলোমিটার মধ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে আগ্রহী?

উল্লেখ্য, ভারতের মধ্যপ্রদেশে এই এনটিপিসি আরেকটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন পায়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশ নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছে। তাজমহলের সৌন্দর্যহানি যেন না হয় পরিবেশ দূষণের কারণে যেজন্য ভারতীয় সরকার এর আশপাশের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও ধরনের বিশাল কারখানা (যা পরিবেশ দূষণ করতে পারে), বিমানবন্দর স্থাপন কিংবা বিশাল প্রকল্প স্থাপন নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের দেশে সুন্দরবন সংরক্ষণে এমন আইন তো নেই-ই, বরং আমরা উঠেপড়ে লেগেছি সুন্দরবনের কাছাকাছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে!

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অন্যান্য ধরনের যেকোনও ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ে পরিবেশে। এছাড়া রয়েছে বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, ক্যাডমিয়াম, লেড, ছাই ইত্যাদি গ্যাস ও ভারী ধাতুর পরিবেশে নির্গমন, ফলে এসিড-বৃষ্টি অবধারিত, ফলে অনায়সে ধসে পড়বে সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছগাছালি ও প্রাণীদের জীবনচক্র, যেহেতু তাদের খাদ্য ও বায়ু বিষাক্ত হয়ে পড়বে। মানুষের জন্যও এই প্রভাব প্রযোজ্য।

সর্বোপরি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশ, বিশেষ করে সুন্দরবন ও সংলগ্ন মানুষ, জনপদ ও বনাঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর এবং ভৌগলিকভাবে বেমানান ও অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, একেকটি প্রকল্প মানে হচ্ছে একেকটি দুর্নীতির উৎস। পদ্মাসেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির জন্য কানাডার আদালত পর্যন্ত গিয়েছে। খটকা লাগে পিডিবি ও বাংলাদেশ সরকার এতোসব জনমত, গবেষণা, সমীক্ষা ইত্যাদি উপেক্ষা করে কার স্বার্থে কী লোভে সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এতো মরিয়া? কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যদি স্থাপন করতেই হয় তাহলে সেটি উত্তরাঞ্চলের যেকোনও জেলায় কেন নয়?

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করে সরকার নজর দিতে পারতো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে। প্রথমে মাথায় আসে সৌরশক্তি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উত্তম জায়গা। এখানে বছরের ৫ থেকে ৭ মাস মাঝারি থেকে প্রখর রোদ থাকে। ফলে বছর দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাঁধা নেই। সৌরশক্তি ও নবায়নযোগ্য অন্যান্য শক্তি (যেমন, বায়ু, জল ইত্যাদি) ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে এর সঞ্চয় ও পরিবহনে। কিন্তু আধুনিক ব্যাটারি প্রযুক্তিতে যে অগ্রগতি হচ্ছে (যেমন, টেসলার পাওয়ারওয়াল ব্যাটারির প্রযুক্তি) তাতে এটি এখন বড় সমস্যা নয়। আগামী ৫ বছর নাগাদ প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য ও সস্তা হয়ে উঠবে। সৌর প্যানেলের কর্মদক্ষতা ২৫-৪০% কিন্তু বিজ্ঞানিরা ধারণা করছেন আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে এই কর্মদক্ষতা ৬০-৮০% শতাংশে উন্নত হবে।

নেদারল্যান্ডস অনেকদিন ধরে সমুদ্রে টার্বাইন স্থাপন করে সমুদ্রের ঢেউ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ স্থাপন করছে অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির পাশাপাশি, পারমাণবিক-নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র বিপর্যয়ের পরে জাপান-ও মনোযোগ দিচ্ছে এই প্রযুক্তিতে। তারা তাদের সমুদ্রপৃষ্ঠ কয়েক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে সৌর প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ সামুদ্রিক সীমানা। এখানে জাপান ও নেদারল্যান্ডসের মতো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে, যা হবে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও স্থাপন করতে পারে বাংলাদেশ। রাশিয়া এই ব্যাপারে সহযোগিতার ও সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। যদিও ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা হিসেবে এই ব্যাপারে বাংলাদেশকে সর্তক হতে হবে। তারপরও সাম্প্রতিককালে রাশিয়া ও জাপান পোর্টেবল পারমাণবিক চুল্লি বিষয়ক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে। এসব চুল্লি সহজে বহনযোগ্য, সহজে শাট-ডাউন করে দেয়া যায়। বিপর্যয়ের সময় এবং তেজস্ক্রিয়-বর্জ্যের পরিমাণ কম। ফ্রান্সের বিদ্যুৎ চাহিদার ৭১% আসে পারমাণবিক উৎস থেকে এবং ফ্রান্স দীর্ঘদিন ধরে (প্রায় ৩০ বছর ধরে) এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে কোনও বড় দুর্ঘটনা ছাড়াই। পারমাণবিক প্রযুক্তি সম্পর্কে আমাদের অহেতুক ভীতি রয়েছে। যা একেবারেই অহেতুক।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮০ সালে দু’টো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপনের জন্য কাজে লাগলেও পরে স্থগিত করতে হয়। তারা আশঙ্কা করেছিলো এতে লাভ হবে না। যদিও সম্প্রতি এই কাজ শেষ করতে যাচ্ছে যেহেতু এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক কমে গেছে। সুতরাং বাংলাদেশকে বরণ করে নিতে হবে আধুনিক প্রযুক্তি, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (তা যেখানেই হোক না কেনো) পরিবেশের জন্য বাজে, মানুষ ও প্রাণীদের জন্য দুর্বিষহ।

সরকার যেহেতু চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলেছে আমাদের লড়তে হবে প্রতিবাদ করতে হবে এই চুক্তি বাতিলের জন্য। এটি যেমন সহজ নয়, তেমনি অসম্ভবও নয়। আমরা এর আগেও অনেক রাজনৈতিক ক্ষতিকে থামিয়ে দিতে পেরেছি। যদি সবকিছু উপেক্ষা করে সরকার এই প্রকল্প চালু রাখতেই চায় আমাদের উচিত কিভাবে ক্ষতি মিনিমাইজ করা যায় সেদিকে নজর দেয়া। অন্যথায়, আমাদের জাতীয় প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাংলার বাঘ কেবলই হবে স্মৃতি!

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ