আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘হাওরে ঈদ আসছে কান্না নিয়ে’

চিররঞ্জন সরকার  

মার্চ মাসের শেষে আকস্মিকই পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টির কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলার হাওরাঞ্চলের উঠতি ফসল তলিয়ে যায়। সরকারি হিসাব মতে, হঠাৎ বন্যায় সুনামগঞ্জের ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৩১ হেক্টর, হবিগঞ্জের ১ লাখ ৯ হাজার ৫১৪ হেক্টর, নেত্রকোনার ৭৯ হাজার ৩৪৫ হেক্টর, কিশোরগঞ্জের ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৩ হেক্টর, মৌলভীবাজারের ৪৭ হাজার ৬০২ হেক্টর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৯ হাজার ৬১৬ হেক্টর হাওরের জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

হাওরাঞ্চল বছরের প্রায় সাত মাস পানিতে ডুবে থাকে। বাকি যে পাঁচ মাস শুকনো থাকে, সে সময়ে চাষাবাদ করা হয়। হাওরে একটি মাত্র ফসল হয়। কিন্তু পাহাড়ি ঢল নামার আগে চাষবাসের কাজ শেষ না হলে তা নষ্ট হয়ে যায়, যেমন হয়েছে এবার। সারাদেশের এক-পঞ্চমাংশ ধান হাওর এলাকায় উৎপাদিত হয়। শুকনো মৌসুমের ৬ মাস শুধু বোরো ফসল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন হাওরবাসী। এই ফসলের ওপরই ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল তাদের জীবন ও জীবিকা।

সুনামগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের বেশিরভাগ হাওরের ধান নষ্ট হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সব জেলা মিলিয়ে প্রায় এক কোটি হাওরবাসী শিকার হয়েছে ফসলহানির।

এই পরিবারগুলোতে এবার ঈদের আনন্দ নেই। খাবার নেই। নতুন কাপড় নেই। বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। তাদের ত্রাণের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে অনেকেই জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছেন। অনেকেই সস্তায় গরুছাগল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ধান শুধু তাদের ভাত যোগায় না, গরুর খাবারও যোগায়, রান্নার জ্বালানিও হয়। সেই ধান না থাকায় অনেকে কম দামে গবাদি প্রাণী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো হচ্ছে। সরকারিভাবে কম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে ওএমএস-এর চাল ও আটা। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও ত্রাণ, নগদ টাকা ও গোখাদ্য বিতরণ করছে। কিন্তু মানুষের ক্ষতি ও প্রয়োজনের তুলনায় এসব উদ্যোগ খুবই অপ্রতুল।

যাদের নিজের জমি নেই, বর্গা জমি চাষ করে হলেও সারাবছরের খোরাকির চাল সংগ্রহে রাখেন তারা। তিন বেলা ভরপেট ভাত খেতে অভ্যস্ত এসব মানুষ ভাত ও রুটির পুষ্টিগুণের পার্থক্য বোঝেন না, বুঝতে চানও না। অভ্যস্ততার কারণেই তাদের মনে হয়, ভাত না খেলে শরীরে বল পাওয়া যায় না। ভাত খেয়ে অভ্যস্ত হাওরের মানুষ অন্য কিছু খেলে সেটাকে খাওয়া মনে করে না। তারা রুটি খাওয়াকে তুচ্ছার্থে 'আডা খাওয়া' বলে। ঘরে চাল নেই, এমনটা ভাবতেই পারে না হাওরবাসী। অথচ তারাই আজ সহায়সম্বলহীন। অনেকে ‘আডা’ খেয়ে বেঁচে আছেন।

হাওরাঞ্চলে যারা গান করেন, তারও বেকার। ফসল তোলার পর গানের মহোৎসব লেগে যেত হাওরে। রোজার মাসেও তারাবির পর থেকে সেহরি পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে বসত গানের আসর। বর্ষায় ঈদ হলে ঈদের পরদিন থেকে টানা কদিন হাওরের সর্বত্র শোনা যায় গান, যাত্রা ও পালার সুর। কিন্তু এবার বর্ষায় কোথাও কোনো ডাক পাননি তারা। ঈদের পর যে পাবেন, এমন ভরসাও নেই। হাওরে এবার ঈদ আসছে কান্না নিয়ে।

জীবিকার সন্ধানে বাড়িঘর ছেড়েছে অনেকে। গোখাদ্যের অভাবে এরই মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ গরু বিক্রি করে দিয়েছে কৃষক। বিকল্প আয়ের সন্ধানে বড়দের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়ারাও ঘুরছে। এতে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্বিপাকে পড়া হাওরাঞ্চলের এসব মানুষের সহায়তায় সরকার এগিয়ে এলেও স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে সেটাও ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
হাওরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে এবার ঈদের আনন্দ নেই। খাবার জোটা নিয়েই যেখানে সংশয়, সেখানে ঈদের জামাকাপড় কেনা হাওরাঞ্চলের মানুষের কাছে বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় শপিং মল ও বিপণি বিতানগুলোতে যেখানে কেনাকাটার ভিড় বাড়ছে, সেখানে ব্যতিক্রম হাওরাঞ্চল।

একসময় চীনের দুঃখ ছিল হোয়াং হো নদী। অথচ তারা নদীর দুই ধারে বাঁধ দিয়ে এবং গভীরতা বাড়িয়ে সেই দুঃখ ঘুচিয়ে ফেলেছে। তাই চীনের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে। শুধু এ বছরই নয়, বাংলাদেশে প্রতিবছরই হাওরাঞ্চলে এই বর্ষার সময়টায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে।

হাওরবাসীর আকাঙ্ক্ষা সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা হোক। বাঁধ নির্মাণে যেন কোনো রকম দুর্নীতি না হয়। হাওরে কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা নির্মাণের দাবিও আছে। হাওরবাসী চায় সেখানেই তাদের কাজের ব্যবস্থা হোক। তারা অনুদান চায় না। খয়রাতিও চায় না। তারা কাজ চায়, কাজ করে বেঁচে থাকতে চায়। হাওরবাসীর জন্য টেকসই উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি।

হাওরাঞ্চলের সম্ভাব্য মানবিক সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি, সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ। এ জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষকে তাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশি সাহায্যের আশায় না থেকে আমাদের সমস্যা আমাদেরই মোকাবিলা করার জন্য সদা সচেষ্ট থাকতে হবে। অন্যদিকে খেয়াল রাখতে হবে, একজন বন্যার্তও যেন খাদ্যাভাবে, সাহায্যের অভাবে, চিকিৎসার অভাবে কিংবা নিরাপত্তার অভাবে অসহায় অনুভব না করে। আমাদের দেশের মানুষ আজীবন প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেছে। সুতরাং বিপদের দিনে একটু সাহায্যই তার জন্য অনেক বড় প্রেরণা।

মানুষ মানুষের জন্য। তাই সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিত্তবানরা যদি বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারবে। এক দিনের বিনোদনের খরচ বাঁচিয়ে, একবারের প্রমোদ ভ্রমণে না গিয়ে সেই টাকা দিন না বন্যাদুর্গত মানুষদের! আমাদের একটুখানি আত্মত্যাগই পারে এই ঈদে আরেকজন দুর্গত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে।

আমরা কী ঈদের খুশিটা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানবিক উদ্যোগটি নেব না?

(আমার লেখক ও সাংবাদিক বন্ধু রাজীব নূর সম্প্রতি বন্যাদুর্গত হাওরাঞ্চল ঘুরে এসে চার পর্বের প্রতিবেদন লিখেছেন দৈনিক সমকাল পত্রিকায়। শিরোনামটি রাজীবের প্রতিবেদন থেকে ধার নেওয়া।)

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ