প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন | ১৮ জুলাই, ২০১৭
২০১৫ সালে জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশ টেকসই উন্নয়নের জন্য ১৭টি লক্ষ্য, ১৬৯টি টার্গেট নির্ধারণ করেছে। সেখানে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। লক্ষ্য ও টার্গেটে যে ইস্যুগুলো রয়েছে, তা আমাদের জন্য গর্বের। এজন্য গর্বের যে, আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, বড় সমস্যা এ লক্ষ্য ও টার্গেটে যোগ করতে সক্ষম হয়েছি। এ যোগ করা খুব কঠিন। অনেক দেশ তাদের ইস্যুগুলো যোগ করতে চায়। কিন্তু প্রায় আড়াই বছর দেনদরবার করে আমরা আমাদের ইস্যুগুলো যোগ করতে পেরেছি।
আমাদের বড় ইস্যু হচ্ছে— দারিদ্র্য বিমোচন, মানসম্পন্ন শিক্ষা, প্রযুক্তির ব্যবহার, পানিসম্পদের আন্তঃসীমা ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু, প্রবাসী বাংলাদেশীদের অধিকার নির্ণয় এবং তারা অর্থ যেন সস্তায় দেশে পাঠাতে পারে, সে ব্যবস্থা করা, প্রবাসী বাংলাদেশীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা, টেকসই জ্বালানি, কৃষি, শিল্পায়ন, পরিবেশ বান্ধব নগরায়ণ, অবকাঠামো প্রভৃতি।
এসব সমস্যা আমরা জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রায় যোগ করতে সক্ষম হয়েছি। এর অর্থ— আমরা যখন এগুলো সমাধান করার চেষ্টা করব, তখন আমাদের সহযোগী দেশগুলো সাহায্য করবে। এজন্য তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। এজন্যই আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য ও টার্গেটের ওপর খুব জোর দেই। এখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তিনি জনগণের ক্ষমতায়ন বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন চেয়েছেন। আরেকটি হলো, কাউকে পেছনে রেখে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। সবাইকে নিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করতে হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্য পূরণ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণ হলে বিশ্বে কোথাও অতিদরিদ্র থাকবে না। লক্ষ্যগুলো উচ্চাভিলাষী হলেও অর্জন করা অসম্ভব নয়। এখানে বাংলাদেশের জোরালো ভূমিকা রাখার একটি কারণ হলো, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো আমরা খুব কম খরচে অর্জন করেছি। ২০১০ সালে ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছিল। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০ সালের পরবর্তী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের যদি এমডিজির গোলগুলো অর্জন করতে হয়, তবে লাগবে ৭৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রতি বছর ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ লাগবে। আর আমরা হিসাব করে দেখিয়েছিলাম এমডিজির লক্ষ্যপূরণে জনপ্রতি ১১২ ডলার প্রতি বছর বাংলাদেশীদের বিদেশী সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু আমরা পেয়েছি ৮ থেকে ১০ ডলার। এ দিয়েই আমরা এমডিজি গোল যেমন— শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, প্রাথমিক শিক্ষা, লিঙ্গসমতা প্রভৃতি অর্জন করেছি। ম্যালেরিয়াসহ অসুখ-বিসুখ অনেক কমিয়ে ফেলেছি। দরিদ্র অর্ধেকের বেশি কমেছে।
১৯৯১ সালে প্রায় ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। ২০১৬ সালে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে। শিশুমৃত্যুর হার ৭৩ শতাংশ কমেছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। বিশ্বের মাত্র পাঁচটি দেশ মাতৃমৃত্যুর এ হার অর্জন করতে পেরেছে, আমরা তাদের অন্যতম। এজন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে আমরা একটি মডেল। কারণ এত জনসংখ্যা সত্ত্বেও এত কম খরচে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি আমরা। অথচ ৩২টি পোস্ট কনফ্লিক্ট দেশের একটিও এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
অনেকেই বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কথা বলেন। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি অভাবনীয় সাফল্য। বাংলাদেশের বড় সাফল্য হচ্ছে— কৃষি খাত। একসময় আমাদের খাদ্য ঘাটতি ছিল। প্রচুর খাদ্য আমদানি করতে হতো। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে আমরা কৃষি উৎপাদন বাড়িয়েছি। খাদ্যে এখন আমরা মোটামুটিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মঙ্গা এখন নেই। এটা অভাবনীয় সাফল্য।
এমডিজিতে সাফল্য অর্জন করায় আমরা বিভিন্ন পুরস্কারও পেয়েছি। এজন্য বিশ্ববাসীর নজর এখন আমাদের দিকে। বিশ্ববাসী বাংলাদেশের উন্নতি দেখে অবাক হয়েছে। তারা ভাবছে, যে দেশটি একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল, সেটি কীভাবে অর্থনীতির মডেল হয়ে দাঁড়াল। একসময় বাংলাদেশের নারীদের ১ বা ২ শতাংশ আয়ের জন্য বাইরে কাজ করতে হতো। কিন্তু এখন এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এজন্য বাংলাদেশের প্রতি সবার দৃষ্টি রয়েছে। তারা জানতে চায়, এটা কীভাবে সম্ভব করেছে বাংলাদেশ। কারণ এ সমস্যা তো তাদেরও রয়েছে। যারা নেতিবাচক কথাবার্তা বলেন, তারা অন্য দেশ দেখেননি। এজন্য তারা বুঝতে পারেন না অন্য দেশগুলো কেমন ভুগছে।
এমডিজি লক্ষ্য সফলভাবে অর্জন করায় এখন এসডিজি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিশ্ব। তারা দেখতে চায়, আমরা কীভাবে এটি অর্জন করি। আমরা জোরগলায় বলেছি, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রস্তুত রয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০০ সালে জোর দিয়ে বলেছিলেন, এমডিজি লক্ষ্য অর্জন করতে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর ২০১৫ সালে তিনি বলেছেন, শুধু টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নয়, ২০৪১ সালে আমি বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধশালী ও স্থিতিশীল দেশে পরিণত করব।
একথা বলার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। এগুলো অর্জনের জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হবে। এজন্য প্রচুর অর্থও লাগবে। এলডিসির ৪৮টি দেশ ধনী দেশগুলো থেকে মাত্র ৩৮ থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলার সাহায্য পায়। এটা ওইসব দেশের জিএনআইয়ের দশমিক ২৬ থেকে দশমিক ২৯ শতাংশ, অথচ তারা বলেছিল দশমিক ৭ শতাংশ দেবে। আগামীতে যে এ সহায়তা বাড়বে, তার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ ধনী দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা এখন বেশি ভালো নেই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রতি বছর আমাদের ৫ থেকে ১১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ লাগবে। ৫ ট্রিলিয়ন ডলার হিসেবে আমরা বিদেশ থেকে পাব মাত্র দশমিক শূন্য ৩ শতাংশের মতো। বাকি অর্থ কোথা থেকে আসবে? এ অর্থ সংগ্রহ করার জন্য উদ্ভাবনী পথ বের করতে হবে। দেশ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
এ অর্থ সংগ্রহ করার জন্য আমরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি। যেমন— রেমিট্যান্স পাঠাতে ব্যয় হয় ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। আমরা এটা ৩ শতাংশের বেশি না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। বিশ্বজুড়ে যে ৬০০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সপ্রবাহ হয়, তার মধ্যে থেকে যদি ১০ শতাংশ সাশ্রয় করতে পারি, তাহলে পাব ৬০ বিলিয়ন ডলার। ৬০ বিলিয়ন অনেক টাকা। এলডিসি দেশ হিসেবে মাত্র ৩৮-৪০ বিলিয়ন ডলার পাই, যা ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ১ শতাংশের কম। এছাড়া বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। এজন্য বিদেশী ব্যাংকগুলোকেও কাজ করতে হবে। কেউ অর্থ পাঠালে তারা সরকারকে তা জানাবে। কারণ বিদেশী ব্যাংকগুলোই অর্থ পাচারের সুযোগ করে দিচ্ছে। আরেকটি হলো, সাউথ সাউথ দেশগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে। এ দেশগুলো যথেষ্ট ভালো করছে। এদের বিনিয়োগ তহবিল অনেক। চীনেরই ৬ ট্রিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে এবং তারা বিনিয়োগও করতে চায়। এগুলো আমাদের সংগ্রহ করতে হবে। সাউথ সাউথ মিনিস্ট্রিয়াল ফোরাম করার জন্য বাংলাদেশ এগিয়ে এসেছে। চীন এ বাবদ এক বিলিয়ন ডলার দেবে বলে অঙ্গীকার করেছে। অন্যদিকে অনেক বড় বড় ব্যাংক তৈরি হয়েছে, যেমন— এশিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইবি), ব্রিকস ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। তবে অর্থ সংগ্রহের চেয়ে কঠিন এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। এজন্য যেসব দেশ এসডিজি অনুমোদন করেছে, তারা নির্ধারিত সময়ে যেন লক্ষ্য অর্জন করা যায়, তার জন্য এসডিজি মন্ত্রণালয় করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকা একটি মন্ত্রণালয় করেছে মিনিস্ট্রি অব সাসটেইনেবল গোলস নামে। আমরাও এ রকম একটি করতে পারি।
উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা অবকাঠামো। উন্নয়নের জন্য ভালো অবকাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে। অবকাঠামোকে আমি দুই ভাগে ভাগ করি। একটি হচ্ছে দৃশ্যমান, আরেকটি হলো অদৃশ্যমান। দৃশ্যমান অবকাঠামো হচ্ছে পর্যাপ্ত জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, রাস্তাঘাট, বন্দর, সেতু প্রভৃতি। সরকার অনেক রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ করছে, যা খুবই ভালো। এগুলো আমাদের উন্নয়নের জন্য খুবই প্রয়োজন। অদৃশ্যমান অবকাঠামো হচ্ছে সহজ প্রক্রিয়া, সঠিক আইন, নিয়মকানুন প্রভৃতি। আমাদের দেশে এখনো লাল ফিতার দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। এটা কমাতে হবে। তবে এটা একদিনে কমানো যাবে না। এটা কমাতে হলে ভুক্তভোগী এবং সেবা প্রদানকারীদের একসঙ্গে বসে কোয়ালিটি সার্কেল তৈরি করতে হবে। এরা প্রতি মাসে বসে বলবে এখানে খটকা রয়েছে। যেমন কোনো একটি রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু আইনের বেড়াজালে হঠাত করে এটি আটকে গেল। এজন্য আইনগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। গবেষণা ও আলোচনার মাধ্যমে এটি করতে হবে। অ্যাডওয়ার্ড ডেমিং, যাকে বলা হয় ফাদার অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স, তিনি বলেছেন, এগুলো অর্জনের জন্য টিম ওয়ার্ক দরকার, কোয়ালিটি সার্কেল তৈরি করা দরকার। ভুল ধরিয়ে দিতে হবে, মানুষের ভয় দূর করতে হবে। আইন-কানুন না ঢেলে সাজালে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনার মতো ঘটনা ঘটবে। তাই এখন থেকেই আমাদের সজাগ হতে হবে।
উন্নয়নের জন্য আমাদের প্রয়োজন দক্ষ মানবশক্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার পিপলস এমপাওয়ারমেন্ট মডেলে বলেছেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও মানসম্পন্ন লোক চান তিনি। আমাদের মানসম্পন্ন শিক্ষা চাই। এটি কীভাবে করা যাবে, তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। ভালো বিষয় হলো, এবার বাজেটে অবকাঠামো, প্রযুক্তি, শিক্ষার জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এজন্য আমি বলি, বাজেটটা হচ্ছে স্বপ্ন পূরণের বাজেট। আমাদের স্বপ্ন পূরণের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। সুখের কথা হচ্ছে, আমাদের অনেক যুবক রয়েছে। আমাদের প্রায় ৭৪ শতাংশ লোক ৪০ বছর বয়সের নিচে। এদের অনেক দিন কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ৪৯ শতাংশ লোক ২৫ বছরের নিচে। এদের গড়ে তুলতে পারলে আমরা লাভবান হব। শিক্ষিত, দক্ষ লোক তৈরি করা গেলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। আমি সবসময় বলে থাকি, বাংলাদেশে দুটি সবচেয়ে বড় সম্পদ— একটি হচ্ছে মানবসম্পদ এবং আরেকটি পানি। এগুলো কাজে না লাগাতে পারলে উন্নতি হবে না।
প্রশাসনিক কাঠামো সেবাবান্ধব করতে হবে। বর্তমানে যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা যুগোপযোগী নয়। এখনো প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ঢাকাকেন্দ্রিক। যে এলাকায় কাজ, সে এলাকায় পাঠিয়ে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল জেলায় জেলায় জেলা সরকার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাদেশিক সরকার রয়েছে। প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য যতগুলো মডেল রয়েছে, তার মধ্যে আমেরিকার মডেল এখনো সবচেয়ে ভালো। সুখের কথা হলো, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশকে সোনার বাংলা তৈরির জন্য বদ্ধপরিকর। অর্থাৎ আমাদের নেতা লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। কিন্তু সমস্যা হলো নিচে। অ্যাডওয়ার্ড ডেমিংয়ের একটি জনপ্রিয় থিউরি রয়েছে। ৮০-২০ থিউরি। এ থিউরিতে তিনি বলেছেন, প্রডাক্ট বা সার্ভিসের উৎকর্ষের ৮০ শতাংশ নির্ভর করে টপ ম্যানেজমেন্টের ওপর। আমাদের টপ লিডার কিন্তু ভালো চান। এরপর ডেমিং বলেছেন কী ধরনের প্রসেস নেয়া হলে ওই উৎকর্ষ অর্জন করা যাবে। এটি নির্ভর করবে যারা বিভিন্ন লেভেলে কাজ করেন তাদের ওপর। অর্থাৎ একটি হচ্ছে টপ লিডার যদি মনে করেন, আমি এটা করব তাহলে ৮০ শতাংশ নির্ভর করবে তার ইচ্ছার ওপর। বাকি ২০ শতাংশ নির্ভর করবে তার অনুসারীদের ওপর। কিন্তু কী ধরনের প্রসেস গ্রহণ করলে লিডার তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন, তার ৮০ শতাংশ নির্ভর করবে বিভিন্ন লেভেলে কাজ করা লোকদের ওপর। এক্ষেত্রে আমাদের খুব দৈন্য। আমাদের টপ লিডার কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন কিন্তু নিচের লেভেল এখনো প্রস্তুত নয়। এখন সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাদের এখন অন্য পিছুটান থাকা উচিত নয়।
আমার পরামর্শ হলো, সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রত্যেক মাসে ওয়ার্কশপ আয়োজন করা। এটা কর্মচারীদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনবে। অন্যকে সাহায্য করার মনমানসিকতা তৈরি করবে। মনে করুন, একটি সরকারি অফিসে পাঁচজন লোক বসে রয়েছে। একজন হয়তো বাইরে গেছে এবং তার ডেস্কে ফোন বাজছে। দেখা যাবে কেউ ফোনটা ধরবে না। কিন্তু আমেরিকায় দেখা যায়, কারো ডেস্কে ফোন বাজলে সে যদি উপস্থিত না থাকে তবে অফিসের কেউ ফোনটা ধরে তার জন্য বার্তাটা রেখে দেবে। আমাদের এখানে ওই মানসিকতা নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের এমন মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে যে, তারা যেন সবসময় অন্যকে সাহায্য করার জন্য সচেষ্ট থাকে। তাদের সবসময় মনে রাখতে হবে জনগণের টাকা থেকেই তাদের বেতন আসে। এ মনমানসিকতা একদিনে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এজন্য বিভিন্ন ওয়ার্কশপ করতে হবে। তবে সুখের কথা হচ্ছে, এখন অনেক যুবক কর্মকর্তার মনমানসিকতা এ ধরনের। আমার মনে হয়, অন্যকে সাহায্য করতে চাওয়া লোকের কোনো অভাব নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জবাবদিহিতা। জবাবদিহিতা না থাকলে কাজ ভালো হবে না। দেখা যায়, একটি রাস্তা করা হলো কিন্তু তা এক বছর পরেই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু যে এ রাস্তার কাজটা করেছে, তার কোনো শাস্তি হয় না। দক্ষিণ কোরিয়ার জেনারেল পার্ক ক্ষমতায় আসার পর একটি নিয়ম করলেন। নিয়মটা হলো, যে প্রজেক্টের কাজ যার কাছে থাকবে, সে যদি ওই কাজ ভালো করে তবে তার প্রমোশন হবে, ইনক্রিমেন্ট হবে। আর ঠিকভাবে কাজ না করতে পারলে তার প্রমোশন, ইনক্রিমেন্ট হবে না। প্রয়োজনে জেলেও যেতে হতে পারে। এতে দেশটিতে দারুণ পরিবর্তন আসে এবং এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মডেলে পরিণত হয়। আমাদের দেশেও এটা চালু করা যেতে পারে। যে ভালো করবে সে দ্রুত প্রমোশন ও ইনক্রিমেন্ট পাবে। যে ভালো করবে না, দুর্নীতি করবে সে শাস্তি পাবে। প্রয়োজনে তাকে জেলে প্রেরণ করা যেতে পারে। অবৈধ উপায়ে যে সম্পদ অর্জন করেছে, তা নিলামে বিক্রি করে দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে তাহলে অন্যরা শিখবে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রমোশন ও ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এছাড়া যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো কাজ করবে তাদের সরকারি কাজে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথটা সহজ নয়। মালয়েশিয়ার ৩৯ বছর লেগেছে নিম্নমধ্যম থেকে উচ্চমধ্যমে যেতে। এটা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের জনপ্রতি আয় এখন ১৬০২ ডলার। এটা উন্নীত করতে হবে ৪ হাজার ডলারে। সুতরাং এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের এডিপির প্রায় ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়। আবার যেগুলো বাস্তবায়ন হয়, তার মধ্যে অনেকগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন থাকে। একটি আলাদা বিভাগ করা যেতে পারে, যারা এডিপি বাস্তবায়ন তদারক করবে। আর মানসম্পন্ন কাজ হচ্ছে কিনা তাও দেখবে। এছাড়া চাকরিচ্যুত করার ক্ষমতাও থাকবে এ বিভাগের ওপর। সরকারি কর্মকর্তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের চাকরি। কারো চাকরি চলে গেলে অন্যরা সচেতন হবে। দেশ থেকে দুর্নীতি পালাবে। আমাদের প্রচুর লোক রয়েছে। একজনকে চাকরিচ্যুত করলে আরেকজন লোক পাব।
জনগণের কর কীভাবে ব্যবহার হয়, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। পরিবেশমন্ত্রী বলেছেন, তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দেশেই থাকে না, বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। এ বিষয়গুলোয় শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি কাজে কেউ বিদেশে গেলে সে দেশে ফিরে জবাবদিহি করবে, জানাবে সে বিদেশে গিয়ে কী করেছে। সরকার ও জনগণকে তা জানাতে হবে। সব সরকারি কর্মকর্তাকে কাজের জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে। এটা করা না হলে উচ্চমধ্যম আয়ের স্বপ্ন পূরণ হতে অনেক দিন লাগবে।
আমেরিকায় পুলিশের কর্মকর্তাদের নিজ এলাকায় দায়িত্ব দেয়া হয়। সে ওখানকার লোক হয়ে থাকলে দুর্নীতি করে বড়লোক হতে পারবে না। কারণ মানুষ তো তাকে চেনে। এজন্য পুলিশদের সবসময় সচেতন থাকতে হয়। আমাদের এখানে দেখা যায় ওসির ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়তে গিয়ে নগদ টাকায় বাড়ি কিনছে। এ বিষয়ে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।
আরেকটি বিষয় দেখা যায়, কোন জায়গায় পাঁচ-সাতজন মারামারি করছে, অথচ পুলিশ ৫০০ জনকে আসামি করেছে। এটা কর্তব্যের অবহেলা। পুলিশ তো ওই পাঁচ বা সাতজনকে ধরবে, কেন ৫০০ জনের নামে মামলা দেবে? এটা করা হলে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এ ধরনের কাজ সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি করে। অপরাধী না হওয়ার পরও যে ৫০০ জনকে আসামি করা হলো, তারা কিন্তু সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বাজে কাজের দায় সরকারকে নিতে হয়। এ কাজের জন্য ওই কর্মকর্তার কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।
আমরা কীভাবে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব— সেটির দিকে পুরো বিশ্ব এখন তাকিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি সামলে বাংলাদেশ খুব ভালো করছে। উপরে আলোচনার বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ দ্রুত উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে।
[লেখাটি দৈনিক বণিকবার্তা থেকে নেয়া]
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য