প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রেজা ঘটক | ৩০ আগস্ট, ২০১৭
আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই মায়ানমারে সেনা চৌকিতে হামলার অভিযোগ তুলে রোহিঙ্গাদের উপর হামলার ঘটনার পেছনে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। একই সময়ে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিস ওয়েলসের ঢাকা সফরের পেছনেও সেই একই ছক।
জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মায়ানমার বিষয়ক প্রস্তাবে সমর্থন আদায়ই ওয়েলসের ঢাকা সফরের মূল লক্ষ্য। জাতিসংঘ বরাবরই বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেবার অনুরোধ করছে। সীমান্ত খুলে দেবার অর্থ হলো মায়ানমার সরকার যে তাদের সেনা ছাউনিতে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের আক্রমণের খবর চাউর করেছে, তার সত্যতা মেনে নেওয়া।
একই সময়ে মায়ানমার সরকারকে যৌথ সেনা অভিযানের যে প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ, তাও উদ্বেগজনক। তবে আশার কথা যে, এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আলোচ্যসূচিতে রাখতে যাচ্ছে ২৮ দেশের ইউরোপীয় জোট ইইউ। এ জন্য ৫ সেপ্টেম্বর ইইউ'র রাজনীতি ও নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটিতে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে -আলোচনা করবে তারা।
পাশাপাশি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রাখাইনের পরিস্থিতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আলোচ্যসূচিতে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি রাখাইনে অস্থিরতায় সক্রিয় ভূমিকা না রাখায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করেছেন। এছাড়া রাখাইনের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে ইরান ও ইন্দোনেশিয়া।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ, ইইউ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটকৌশলের পর তুরস্ক ও ইরানের এই উদ্বেগের সোজাসাপটা অর্থ হলো- এরপর ঘটনায় যোগ দেবে রাশিয়া। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই মায়ানমার ও বাংলাদেশ এবং বঙ্গোপসাগর এলাকায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সার্বক্ষণিক শকুনদৃষ্টি রয়েছে। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের দিকেই তাদের নজরদারি।
ওদিকে মায়ানমারকে দিয়ে নিরবে ঘুটি চালাচ্ছে চীন ও ভারত। সে তুলনায় পিছিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েতনাম যুদ্ধে হারার পর থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিন ধরে ঘাটি করার খায়েস। যে কারণে কম্বোডিয়া ও লাওসে দীর্ঘদিন রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলেছে। যার প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এবার মায়ানমারে দীর্ঘস্থায়ী এক গৃহযুদ্ধ পাকানোর ছক করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই ছকে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশকেও বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে। কারণ এখানে প্রধান স্বার্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কত জন মারা গেল, কত জন বাংলাদেশে পালিয়ে আসলো, এসব লোকদেখানো সস্তা মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না যুক্তরাষ্ট্র। তাদের চাই এ অঞ্চলে আধিপত্য ও অস্ত্র বিক্রির গোপন লাইনঘাট।
মায়ানমারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিমাত্রার আগ্রহের কারণে, ভারত-চীন-ভুটান সীমান্তে অবস্থিত বিতর্কিত ডোকলাম মালভূমিতে ওই দুই দেশের সেনা সমাবেশ ঘটানোকে কেন্দ্র করে, টানা ৭০ দিন মুখোমুখি অবস্থান থেকে দুই দেশই সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যে মুহূর্তে মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর হামলা হচ্ছে, হঠাৎ করে কী এমন ঘটলো যে ডোকলাম নিয়ে চীন ও ভারত হুট করেই সমঝোতা করলো?
কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আধিপত্যবাদের হিসেব কষেই মায়ানমার ইস্যুতে সম্ভাব্য -বড় শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে চীন ও ভারত এই সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে। যে কারণে মায়ানমার সরকারকে পেছন থেকে নিরব সমর্থন দিচ্ছে চীন ও ভারত। সেই কৌশলে বরং একটু ভুল হলেই যুক্তরাষ্ট্রের খপ্পরে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
কারণ, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (আরসা)-র সাথে বাংলাদেশের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের যোগাযোগ রয়েছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই'র সঙ্গে বাংলাদেশের উগ্রবাদীদের ও মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের এই যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে ফসল ঘরে তুলতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে বিষয়টি মোটেও জলের মত সহজসরল নয়। মানবিকতা দেখিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিলেই রোহিঙ্গা সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হবে না।
কারণ ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসেবে রয়েছে। মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে হারাকাহ আল-ইয়াকিন নামে যে নতুন সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনের উদ্ভব ঘটছে, তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর একধরনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। সৌদি আরবসহ অন্যত্র বসবাসরত প্রবাসী রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই বিদ্রোহকে ধর্মীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য এই সংঘাতে যুক্ত হওয়ার পথ উন্মুক্ত করবে।
বাংলাদেশের সীমান্তে সংঘাত, অব্যাহত শরণার্থীদের প্রবেশ, একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপস্থিতি এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের স্বার্থকে ঘিরে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যুটি অবশ্যই বাংলাদেশের নিরাপত্তার যখন হুমকিস্বরূপ। যে কারণে মায়ানমারের সঙ্গে যৌথ সামরিক অভিযানের পরিবর্তে এই সমস্যাকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমস্যায় রূপ দেওয়ার দিকেই হাঁটতে হবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্র ও জোটের সঙ্গে মিলে মিয়ানমারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
কূটনৈতিক কৌশলে একটু ভুল করলেই সেই সুযোগ লুফে নেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুকে ঘিরেই বড় ধরনের ছক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই ছকে এতদিন জল ঢেলেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আর তা বেড়ে উঠতে সহায়তা করেছে বাংলাদেশের উগ্রবাদী ইসলামী দলগুলো। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের হিসাব-নিকাশ মোটেও সহজ নয়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য