প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এমদাদুল হক তুহিন | ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হওয়ার অন্তত তিন সপ্তাহ পর সাময়িকভাবে এ সঙ্কট সমাধানে ইতিবাচক বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্কট নিরসনে প্রথমবারের মতো ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্র। তবে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর এক প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে চীন। ওই বৈঠকে মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা বন্ধ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে রাখাইনে ত্রাণকর্মীদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। বৈঠকে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উপরও জোর দেয়া হয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদ কোন অবরোধ আরোপ করেনি। ভেটো দেওয়ার জোর গুঞ্জন থাকলেও শেষ পর্যন্ত চুপ ছিল চীন। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ঐক্যমত্য না হলেও বাকি ১৪টি রাষ্ট্রের মতো রাখাইনে যে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হচ্ছে তা মেনে নিয়েছে চীন।
নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠকে ১৫ রাষ্ট্রের ঐক্যমত্যের ঘটনাকে ‘বিরল ঐক্যমত্য’ বলে আখ্যা দিয়েছে হিউম্যান রাইট ওয়াচ। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। নিরাপত্তা পরিষদের ওই বৈঠকে চীনের অবস্থান ছিলো মূলত নিরপেক্ষ। দেশটি বুঝাতে চেয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা বাংলাদেশের পাশেও আছে। তবে মিয়ানমারকেও বাদ দিয়ে নয়। অর্থাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, চীন এখন অনেকটা মধ্যাবস্থায়।
এদিকে, মিয়ানমারের উপর অবরোধ আরোপ করতে মত দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্ট। সেখানে বেশকিছু সুপারিশসহ একটি রেজ্যুলেশন গৃহীত হয়েছে। দ্রুত এই গণহত্যা বন্ধ করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই ইইউ কর্তৃক মিয়ানমারের উপর পুরোপুরি অবরোধ আরোপ হতে যাচ্ছে। দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক কার্যত প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকলেও সম্প্রতি যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং এর প্রভাবে মুক্ত বাণিজ্যের সুবিধায় দেশটির অর্থনীতি যেভাবে ফুলে ফেঁপে উঠছিলো সেই গতি মন্থর হবেই বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ইইউ পার্লামেন্টে গৃহীত রেজ্যুলেশনের প্রভাব আসলে কতোটা পড়বে তা সময়ই বলে দিবে।
অপরদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মিয়ানমার সফরের পর, বহির্বিশ্বে ভারত যে সমালোচনায় পড়েছিলো; ইতোমধ্যে দেশটি সেই ‘নেতিবাচকতা’ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। মিয়ানমারে চলমান সহিংসতার মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগের কথা জানালে বেঁকে বসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মমতার এই অবস্থান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এছাড়া কলকাতার রাস্তায় মুসলিমদের যে সমাগম ঘটেছিলো; সেই সমাগমও পূর্বের রেকর্ড ছাড়িয়েছে বলে কয়েকটি সূত্র বলছে। এমন পরিস্থিতিতে বহির্বিশ্বের সমালোচনাসহ দেশের অভ্যন্তরে মুসলিমদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও মমতার অবস্থানের কারণেই ভারত তার অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের বর্তমান এই অবস্থান আমাদেরকে ইতিবাচক বার্তা দেয়। একইসঙ্গে এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ফোন তাদের অবস্থানকে স্পষ্ট করে। ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশটি বাংলাদেশের পাশে আছে এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে এই বলাটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্তই কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখনও কোন উচ্চবাচ্য করছে না। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা রয়েছে ভারতেও। বাংলাদেশের মতো প্রকট না হলেও সমস্যাটিতে ভাগ রয়েছে ভারতেরও। ফলে সঙ্কটটিকে ‘বাংলাদেশের সঙ্কট’ না মনে করে ‘উভয়ের সঙ্কট’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ভারতকেও এই ইস্যুতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। কেবল ত্রাণ সাহায্য পাঠিয়েই দায়িত্ব যেন শেষ না হয়। এটি অবশ্য, ভারতের কাছে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অধিকারও।
তবে সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলা এই সময়েও রোহিঙ্গা নিধন থেমে নেই। শেষ সময়ের মতো ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়ত পালিয়ে আসছে। গণমাধ্যমে হৃদয়বিদারক ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। নাফ নদীতে ভেসে ওঠা ওই শিশুর মতো শতসহস্র শিশুর জীবনে কতো করুণ ঘটনা ঘটে গেছে তা আমাদের কল্পনায় আসার মতো নয়। ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া, মাতৃভূমি ছেড়ে আশ্রয় নেওয়া বলতে; আমাদের মতো তরুণের চোখে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সহিংসতার সময়ে নিজের ঘরে বাস করতে না পারা কোন রাজনৈতিক নেতার যে ছবি ভেসে উঠে তা নয়। আবার ৭১’র শরণার্থী ও ১৭’র শরণার্থীর মধ্যেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। আমি ঠিক ততোটা কল্পনা করতে পারছি না, যতো ঝড় বয়ে গেছে ওই ১০ বছরের শিশুর উপর। যে শিশুটি নিজের কাঁধে করে ২ থেকে ৩ ভাই কিংবা বোনকে নিয়ে ভয়ার্ত হৃদয়ে কতোটা সাহস নিয়ে সীমান্ত জয় করেছে; সময়টিতে তার কল্পনার জগতে কী খেলে গেছে- তা কল্পনায়ও আসে না। শিশুদের মতো না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ১০ লাখে ঠেকতে যাওয়া এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রায় সবার জীবনই এক। স্রোতের মতো মানবজীবনের বয়ে চলা ঝড়!
এমন দুঃসময়ে ওই শিশু ও রোহিঙ্গা নর-নারীর পাশে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনিই প্রথম, যিনি কোন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গেলেন। চোখের জল ফেলেছেন। কেঁদেছেন। শিশুর মাথাকে বুকে রেখে কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অবস্থান, সংসদে তার ভাষণ তথা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এই অবস্থান পুরো বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকটি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের পরেই হয়েছে। মিয়ানমারের উপর ইইউ কর্তৃক অবরোধ আরোপের প্রস্তাবটিও। ভারতের ত্রাণ পাঠানোর ঘটনাটিও। এমনকি সুষমা স্বরাজের ফোনটিও। অর্থাৎ, রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনার এই অবস্থান অতুলনীয় ও অগ্রগণ্য। তবে শেখ হাসিনাকে আমি ‘শান্তির দূত’ বলছি না এই কারণে, বিশ্বে আজকাল ‘শান্তির দূত’ শব্দটিও নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার উদাহরণ তো সূচি-ই। এবং শান্তির দূত শব্দটি উচ্চারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন জানি নোবেল শব্দটি চলে আসে। আর সেই পুরষ্কারটি অনেক আগেই তার প্রাপ্য সম্মান হারিয়েছে। সম্মানহানি ঘটেছে এমন কোন কিছু শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্ত হোক তা আমি মনে প্রাণে চাই না। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তা অন্তত চাইতেও পারি না।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘বঙ্গমা’ শেখ হাসিনা যে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলছেন, বহির্বিশ্বে তার যে প্রশংসা হচ্ছে; রাষ্ট্র হিসেবে সেই প্রশংসা বাংলাদেশের। আর তা আরও অধিকতর উজ্জ্বল হবে এবারের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে। ৭২তম সাধারণ এই অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়ার কথা রয়েছে। আর অধিবেশনে দেওয়া শেখ হাসিনার ভাষণের বড় অংশ জুড়েই থাকবে রোহিঙ্গা ইস্যু। দ্রুত এই সঙ্কট সমাধানে শেখ হাসিনা আহ্বান জানাবেন বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রতি। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ সমূহ মিয়ানমার যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন করে, বহির্বিশ্ব যাতে সেভাবেই চাপ দেয়- সঙ্কট সমাধানে এটিই হয়ে উঠতে পারে মুখ্য। তবে শেখ হাসিনার এই ভাষণ হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীতে থেকে কোন একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন হতে না দেওয়া আন্তর্জাতিক কোন সনদ।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষের হৃদয় যেভাবে জেগে উঠছে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে, সেই প্রতিবাদ জারি রেখে- আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। বহির্বিশ্বকে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে বাড়তি চাপ ও বল প্রয়োগ করতে হবে। সূচিকে কথা বলাতে বাধ্য করতে হবে। চীন যাতে মানবতার পক্ষে অবস্থান নেয় তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কথা বলাতে হবে তাদেরকেও। ভারতের মতো অবস্থান যেন হয় রাশিয়ারও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের যৌথ প্রয়াসে যাতে আর কোন ‘আরসা’ তৈরি না হয়; নিশ্চিত করতে হবে তাও। ইস্যু যেহেতু মিয়ানমারের, সঙ্কট যেহেতু বাংলাদেশের, রাষ্ট্র যাতে কোন ফাঁদে পা না দেয়- তাই জনগণকেও খোলা রাখতে হবে চোখ-কান।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য