আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা অস্বীকার প্রবণতায় এক কাতারে

মাসকাওয়াথ আহসান  

নিউজিল্যান্ডে মসজিদে কট্টরপন্থী খ্রিস্টানের হামলার পর সে দেশের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষেরা ধর্মীয় পরিচয়ের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ আত্মপরিচয়ের উদঘাটন ঘটিয়েছে। নিউজিল্যান্ড সরকার দ্রুততার সঙ্গে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আশার কথা সভ্যতার এই উজ্জ্বল ধারা পৃথিবীর নানা জায়গায় দৃশ্যমান ।

নানা-ধর্মের মানুষের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষের কারণে সৃষ্ট সংকটটিকে সভ্যতার সংকট না বলে অসভ্যতার সংকট বলতে চাই।

নিউজিল্যান্ড হামলায় তুরস্কের কট্টরপন্থী শাসক এরদোয়ানের প্রতিক্রিয়াটি যথারীতি বিদ্বেষমূলক মনোভঙ্গি। অথবা একই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কট্টরপন্থী শাসক নরেন্দ্র মোদির নিরবতা ও অনুশীলিত নির্লিপ্ততার কারণও একই।

তুরস্ক ও ভারত এই দুটি দেশ অসাম্প্রদায়িক মানবিক চিন্তার জন্য একসময় আদৃত ছিলো। কিন্তু দুটি রাষ্ট্রের সভ্য চিন্তার স্রোতকে অবরুদ্ধ করে অসভ্যতার সংকটে নিমজ্জন ঘটিয়েছে উগ্রপন্থী রাজনীতি। এই দায় কেবল এরদোয়ান বা মোদির নয়; এই দায় দেশদুটোর কট্টরপন্থার সমর্থকদেরও।

ওদিকে আফ্রিকার কট্টরপন্থী মুসলমানেরা খ্রিস্টানদের হত্যা করেছে। এই হামলার প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেনি অনেক মুসলমান। তারা ব্যস্ত তাদের বেছে নেয়া "নিউজিল্যান্ড মসজিদ হামলা"র ইস্যুটি নিয়ে। কেউ কেউ অতি আগ্রহী হয়ে ফেইক নিউজ ছড়াচ্ছে 'বেশ কিছু খ্রিস্টান ইসলাম ধর্ম' গ্রহণ করেছে বলে। এই যে কেবল মুসলমানের মৃত্যুকে শোকের বিষয় ভাবা; আর অন্যধর্মের মানুষের মৃত্যুতে অনুশীলিত নির্লিপ্ততা, চুপচাপ থাকার রোগ; ঠিক এটাই কট্টরপন্থা।

কট্টরপন্থী যে ধর্মেরই হোক; তাদের মিলের জায়গাটি হচ্ছে ডিনাইয়াল বা অস্বীকার প্রবণতা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিউজিল্যান্ড হামলার সামান্য সমালোচনার পর এটা বলেই ছেড়েছেন, তিনি হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট বা খ্রিস্টিয় মৌলবাদিদের উত্থানের কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না।

নিজ নিজ ধর্মের কট্টরপন্থার উত্থানে চোখ বুজে থাকা; বরং সুযোগ পেলেই ঘৃণা উস্কে দেবার ক্ষেত্রে ট্রাম্প-এরদোয়ান-মোদির যে মিল; সেই মিলটিই আজকের এই বিশ্বব্যাপী অসভ্যতার সংকটের মূল কারণ। যে সব মানুষের মধ্যে নিজ ধর্মের মানুষের সন্ত্রাস কোন ব্যাপার নয়; অন্য ধর্মের মানুষের সন্ত্রাসই সমস্যা এরকম একচক্ষু রোগ রয়েছে; তারাই কট্টরপন্থী।

এরদোয়ানের কাছে আফ্রিকায় মুসলমান কট্টরপন্থীদের হাতে খ্রিস্টানের মৃত্যু কোন ব্যাপার নয়; আসল ব্যাপার নিউজিল্যান্ডের মসজিদে কট্টর খ্রিস্টানের হামলায় মুসলমানের মৃত্যু। মোদির কাছে গুজরাটে কট্টরপন্থী হিন্দুর হাতে মুসলমানের মৃত্যু কিংবা হিন্দুত্ববাদি সরকারের সেনা অভিযানে কাশ্মীরে মুসলমান হত্যাও কোন ব্যাপার নয়; আসল ব্যাপার পুলওয়ামায় মুসলমান সন্ত্রাসীদের হাতে হিন্দু-সেনা হত্যা।

ট্রাম্পের কাছে ইরাকে-সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনা গিয়ে অসংখ্য মুসলমান হত্যা কোন ব্যাপার নয়; তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ টুইন টাওয়ার হামলায় মৃতরা।

অসভ্যতার সংকটের একমাত্র কারণ ধর্মীয় বিদ্বেষই শুধু নয়; এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনেক কারণ আছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয়গুলো ধর্মীয়-বিভাজনের( পড়ুন, রাজনৈতিক বিভাজনের) মাঝ থেকে বের করে নিয়ে আসাই এই ক্ষমতার ঘোড়-সওয়ারদের প্রধান কাজ।

এই সভ্যতার সংকট দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রকট। বার্মার কট্টরপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু-বাংলাদেশের কট্টরপন্থী মুসলমান হুজুর-ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দু ভক্ত-পাকিস্তানের কট্টরপন্থী মুসলমান মোল্লাদের ঘৃণা বিদ্বেষের দোকানদারির লাভালাভ দেশগুলোর শাসকরা নগদে গুনে নেন।

এরকম হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ দ্বন্দ্বের মাঝ দিয়ে শত বছরে ঢেকে রাখা গেছে আসল বিভাজন; ধনী-দরিদ্রের বিভাজন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অতি দ্রুত ধনী হবার প্রক্রিয়ায়; এখানে প্রচলিত দুর্বল রাজনৈতিক আদর্শ বা উগ্রজাতীয়তাবাদ দিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষের বিভাজন অত সফলভাবে না হওয়ায় সেই আদি এবং অকৃত্রিম হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ দ্বন্দ্বের দোকানগুলোকেই সক্রিয় দেখা যাচ্ছে সর্বত্র।

দক্ষিণ-এশিয়ায় পাশাপাশি খুব পরিচ্ছন্ন চিন্তার ও অপরিচ্ছন্ন চিন্তার মানুষের বসবাস হলেও; নিজেকে, নিজের সমাজ-জাত-রাষ্ট্রের পাতকুয়াটিকে শ্রেষ্ঠ ভাবার হাজার বছরের পুরোনো রোগ এখানে অসভ্যতার সংকটকে তীব্র করেছে।

দক্ষিণ এশিয়া ছেড়ে পশ্চিমে গেলেও চিন্তার পাতকুয়া মস্তিষ্কের মাঝে বসিয়ে নিয়ে যায় অধিকাংশ লোক। এদের কেউ কেউ সেখানে মসজিদ-মন্দির বানিয়ে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের রোগ-সাধনা করে। কেউ কেউ বেশ প্রগতির পোশাক পরে সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্বের রোগ সাধনা করে।

বিশ্বের যে কোন জায়গায় যে কোন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলেই; দক্ষিণ এশিয়া ও প্রবাসে দক্ষিণ এশিয়ার লোকেদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণা-বিদ্বেষের উদগীরণ করতে থাকে। ধর্ম বা প্রগতি যেটিরই চর্চা করুক তারা; চর্চা করে একইরকম কট্টরভঙ্গিতে। দিনশেষে "আমিই শ্রেষ্ঠ; আর কেউ কিছু নয়" এটা প্রমাণ করতে গিয়ে বিষিয়ে তোলে পরিবেশ।

নিউজিল্যান্ড হামলার পরেই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় ভ্রমণে সতর্কতা জারি করেছে। পশ্চিমের দেশগুলো এসব সতর্কতা যেহেতু আরোপ করে; তাই বাংলাদেশকেও এটা করে দেখিয়ে দিতে হবে। নিউজিল্যান্ড মসজিদে হত্যাকারিকে গ্রেপ্তারে যে দ্রুততা ও দক্ষতা দেখিয়েছে ; বাংলাদেশে ধারাবাহিক ব্লগার হত্যার পর হত্যাকারিদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে তার ধারে কাছের কোন দ্রুততা বা দক্ষতা দেখা যায়নি; কিন্তু শ্রেষ্ঠত্ব তো দাবি করতেই হবে।

ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই যে শ্রেষ্ঠত্বের রোগ; এই রোগই দেশে দেশে সভ্যতার সংঘর্ষ ও অসভ্যতার সংকট তৈরি করেছে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ না ভেবে অন্যতম ভেবে স্বাভাবিক চিন্তা করতে শেখার মাঝেই রয়েছে এই সংঘর্ষ ও সংকটের প্রশমন।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ