Advertise
ফজলুল বারী | ২৫ মার্চ, ২০১৯
ক্রাইস্টচার্চের দুই মসজিদে শুক্রবারের নামাজে অভাবনীয় হামলা-হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের নানা মিডিয়ার রিপোর্ট পড়ে টিভির টকশোর আলোচনা দেখে শুনে অসহায় লাগছিল। কারণ নিউজিল্যান্ড দেশটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের তথ্য ঘাটতি অথবা ধারনার অভাব। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কেনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি, পুলিশ কেনো দেরিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছলো, কেনো অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে জঙ্গি বলা হবোনা, কেনো নিউজিল্যান্ডের এতো মানুষের হাতে অস্ত্র, এমন নানা প্রশ্ন।
হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের ভূমিকায় অবশ্য পরে এসব প্রশ্ন মিইয়ে আসে। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখেন জেসিন্ডা কী করে শোককে শক্তিতে পরিণত করে ঐক্যবদ্ধ করলেন পুরো নিউজিল্যান্ডকে।
মুসলিম নারীর মতো মাথায় ওড়না দেয়া জেসিন্ডাকে মনে হচ্ছিল একান্ত আপন পাশের বাড়ির আপা অথবা ভাবীর মতো একজন। প্রধানমন্ত্রী হবার পর মা হন জেসিন্ডা। বেনজির ভূট্টোর পর তিনিই বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি ক্ষমতায় গিয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি আগেই বিশ্ব মিডিয়ার নজরে ছিলেন। ক্রাইস্টচার্চ ট্র্যাজেডির পর তিনি হয়ে গেলেন পুরো দেশটির ঐক্যের প্রতীক। অভাবনীয় ঘটনায় দেশটির ভীতসন্ত্রস্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মা। শোক সেখানে এক অবিস্মরণীয় ঐক্য আর ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।
ক্রাইস্টচার্চ শহরটি নিয়ে একটু আলাপ করি। নিউজিল্যান্ড একটি ভূমিকম্প প্রবণ দেশ। এ দেশটিতে সুপ্ত-পরিত্যক্ত আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব আছে। অনেক এলাকার পুকুরে-লেকের ধূমায়মান পানিতে এখনো বুদবুদ ওঠে। স্পর্শ করলে পানিতে গরম অনুভব হয়। হট ওয়াটার বীচ নামের একটি সৈকতও আছে নিউজিল্যান্ডে। যেখানে পর্যটকরা সমুদ্র সৈকতের পানি-বালিতে পা ফুঁড়ে নীচের গরম তাপের আঁচ নেন। অনেক এলাকার পাহাড়-জঙ্গলের গা ঘেঁষে বেরোয় ধোয়ার কুণ্ডলী। মনে করিয়ে দেয় এখানে আগ্নেয়গিরি আছে অথবা ছিলো। ভূমিকম্প প্রবণ পরিস্থিতির কারণে নিউজিল্যান্ডে পাতাল রেল নেই।
কয়েক বছর আগের এক ভূমিকম্পে ক্রাইস্টচার্চের বড় অংশ বিধ্বস্ত হয়। শহরের অনেক বাসিন্দা ক্রাইস্টচার্চ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। বাংলাদেশিদের যারা এখন ক্রাইস্টচার্চে আছেন তারা কিন্তু সেই ভূমিকম্পের পর সেখানে গেছেন। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত শহরটির পুনর্নির্মাণের কাজ পায় সিঙ্গাপুর ভিত্তিক একাধিক কোম্পানি। তারা তাদের পুরনো বেশকিছু স্টাফ-কর্মীকে ক্রাইস্টচার্চ নিয়ে যায়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সিংহভাগ এভাবে এদের সঙ্গে সিঙ্গাপুর থেকে শহরটায় গেছেন। এদের সংখ্যা এক-দেড়শ’র বেশি হবেনা। বাংলাদেশ দলের খেলা দেখতেও আশেপাশের বিভিন্ন শহরের অনেক বাংলাদেশি ওই সময়ে ক্রাইস্টচার্চ আসেন। বাংলাদেশি যারা অভিবাসন নিয়ে নিউজিল্যান্ডে গেছেন তাদের সিংহভাগ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক এবং প্রকৌশলী। কাজের সুযোগ কম থাকায় পড়াশুনা করতে খুব কমসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিউজিল্যান্ড যান। বিদেশে যারা অভিবাসন নিয়ে যেতে চান তারা সংশ্লিষ্ট দেশের পয়েন্ট পদ্ধতির গুরুত্ব বোঝেন। ক্রাইস্টচার্চের পুনর্নির্মাণে নিউজিল্যান্ড সরকারও অভিবাসন ইচ্ছুকদের সেখানে যেতে আগ্রহী করতে পয়েন্ট অফার করে। ক্রাইস্টচার্চ গেলে অত বোনাস পয়েন্ট। এরজন্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিউজিল্যান্ডের অন্য শহরগুলোর চাইতে ক্রাইস্টচার্চে অভিবাসন বেশি হয়েছে অথবা হচ্ছে।
এখন ক্রাইস্টচার্চে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার প্রসঙ্গে আসি। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনেক বছর ধরে ঘোরাঘুরিতে একটা বিষয় বরাবর মনে হয়, তাহলো এরা বিশেষ কোন এলাকা বা প্রতিষ্ঠান নয়, পুরো দেশটাকে নিরাপদ রাখতে চায়। গত বিশ্বকাপ ক্রিকেট কভার করতে বাংলাদেশি একজন টিভি সাংবাদিক সিডনি পৌঁছে অবাক বিস্ময়ে জানতে চান এখানে বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সাজসজ্জা কোথায়। অথচ এমন কিছুতে বাংলাদেশে পুরো ঢাকা শহরকে মায়াবী সাজানো হয়। তাকে বলা হয় এরা এদের দেশকে সারাক্ষণ ঝকঝকে সাজিয়ে রাখে। বিশ্বকাপ বা অন্যকিছুর জন্যে আলাদা করে সাজায়না। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা আড়াই কোটি, নিউজিল্যান্ডে পঁয়তাল্লিশ লাখ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের সম্পর্ক আবার ভাইবোনের মতো। নিউজিল্যান্ডের নাগরিক মাত্রই অটোমেটিক অস্ট্রেলিয়ার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট। দেশ দুটিতে যাতায়াতে নাগরিক অথবা পার্মানেন্ট রেসিডেন্টদের ভিসাও লাগেনা। সে জন্যে অস্ট্রেলিয়ান যে খুনি ক্রাইস্টচার্চে গিয়ে খুন করেছে তার সেখানে যেতে ভিসা লাগেনি। সেখানে বসে সে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে অস্ত্রও কিনতে পেরেছে।
এমনিতে নিউজিল্যান্ডে যেহেতু কাজ কম তাই অভিবাসীদের বেশিরভাগ দেশটির নাগরিকত্ব পাবার পর কাজের আশায় অস্ট্রেলিয়া চলে আসেন। বিশ্বের অন্যতম শান্তির দেশ বলা হয় নিউজিল্যান্ডকে। দুর্নীতি যেহেতু নেই সে কারণে বলা হয় এখানে এক বালতি পানিতে এক মগ পানি বেশি ঢেলে দিলে তাতে তা উপচে পড়ে বা এক মগ পানি সরিয়ে নিলে বালতির তলানি দেখা যায়। দেশটিতে হানাহানি বা নিকট সন্ত্রাসেরও কোন রেকর্ড নেই। যেহেতু ঘটনা কম সে কারণে নিউজিল্যান্ড গেলে সেদেশের পুলিশকে অতোটা একটিভ বা স্মার্টও মনে হয়না। হানাহানি না থাকায় দেশটার মন্ত্রীদের সঙ্গে কোন পুলিশ থাকেনা। ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার আগে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশ থাকতো মাত্র দু’জন।
বাংলাদেশ বা কোন দেশের ক্রিকেটারদেরই অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে কখনো নিরাপত্তা দেয়া হয়না। নিরাপত্তা কেউ চায়ও না। খেলার দিন পুলিশ মাঝেমাঝে মাঠে-গ্যালারিতে টহলে আসে। ক্রাইস্টচার্চের হত্যাকারী ক্রিমিনালকে আমার মুসলিম বিদ্বেষী, বর্ণবাদী এবং অভিবাসন বিরোধী মনে হয়েছে। ইউরোপের কিছু জঙ্গি হামলা তার মাঝে মুসলিম বিদ্বেষের সূচনা যে করেছে সে তা তার ম্যানিফেস্টোতে লিখেছে। কিন্তু সে কোন ধার্মিক লোক না। কোন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত মনে হয়নি। মুসলিম বিদ্বেষ তার মাঝে আরেক কারণে সৃষ্টি হতে পারে।