আজ বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

মহাত্মা গান্ধী আজও অমর!

রণেশ মৈত্র  

ভবিষ্যতের খবর তো জানিনা। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা নই বলে তো বলে ও পারবো না। বর্তমানটা তো দেখছি ভালভাবেই- তার বিভীষিকা মনকে অনেকাংশেই উদ্বেগাকুল করে তুলছে যে কোন দেশপ্রেমিক বাঙালির। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না- একটি মৌলবাদী উত্থান-সাম্প্রদায়িকতার বিষ দাঁত পুনরায় মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠা। না, এগুলি প্রত্যাশিত ছিল না আদৌ- অন্তত: আমাদের মত সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুক্তিযুদ্ধের মত সশস্ত্র লড়াই এ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনকারী এই স্বাধীন মাতৃভূমিতে। জোর করে অন্তর দিয়ে বলতে পারছি কৈ “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্ম ভূমি? তবুও দেহের সমগ্র শক্তি উজাড় করে দিয়ে এবং মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে, সকল আন্তরিকতার পরশ বুলিয়ে অতীতের মতই দৃঢ়তার সাথেই বলছি, “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্ণাদপি গরীয়সী” অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চাইতেও পবিত্র। কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায় তবুও কেন তা হলে আমাদের মাতৃভূমির এমন এক বিপর্যস্ত চেহারা আজ আমাদের দেখতে হচ্ছে সুকরুণ দৃষ্টিতে। মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পরেও কেন প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে আমাদের গৌরব মণ্ডিত দেশটি ক্রমান্বয়েই পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গন্তব্যের দিকে? তা হলে কি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে আমরা সঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারিনি-না কি তখন আমরা বা আমাদের পূর্বসূরিরা এমন কোন কিছু করেছিলেন- যার পরিণতিতে আজকের এমন একটি বর্তমান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে?

সেই কবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তৎকালীন বিশ্বজয়ী নেতা, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অগ্রদূত মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধী হিসেবে দেশ বিদেশে পরিচিত- আর দেশের অভ্যন্তরেও “বাবুজি” বা “গান্ধীজী” হিসেবে। না, তাঁর কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে নি-তাঁকে হত্যা করা হয়েছিলো প্রকাশ্য দিবালোকে-পিস্তলের গুলিতে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে- কাপুরুষের মত অতর্কিতে। গান্ধীজীকে হত্যা করেছিলো নাথু রাম গডমে নামক একজন উগ্র মৌলবাদী সংগঠন, হিন্দু মহা সভার লেলিয়ে দেওয়া কর্মী। বাংলাদেশের বিরাজমান প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধীর এই নির্মম হত্যালীলা এবং তার কারণাদিসহ একাধিক গান্ধীজীকে নতুন করে ভাবা-অপরদিকে মৌলবাদীদের নিষ্ঠুর অস্তিত্বকে ঠিকমত উপলব্ধি করা বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশের জন্যই নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করেছে। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিকে মেনে নিয়ে বৃটিশ শাসন বিরোধী, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট “মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি” হিসেবে পাকিস্তান নামক অপর একি স্বাধীন সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের উদ্ভবকে মেনে নিয়েছিলো। অখণ্ড ভারতবর্ষ ঐদিন বিভক্ত হলো-দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলো, দুটি পৃথক জাতীয় পতাকা দুদেশে উড্ডীন হলো। পাকিস্তান নামক নবীন রাষ্ট্রটি ছিলো মুসলিম লীগের দাবী। তা পূরণ হলো-বিনা লড়াই এ- বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সামান্যতম বিরোধিতা না করে। ইংরেজরা চেয়েছিল এ ধরণের বিভক্ত ভারতবর্ষই- যাতে দুটি দেশের সম্পর্ক কদাপি মধুর বা সৎ প্রতিবেশীসুলভ না হয়- যাতে তাদের মধ্যে সদা সর্বদা বিরোধ লেগেই থাকে- যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং সাম্প্রদায়িক হানাহানি নিয়েই যাতে রাষ্ট্র দুটি ব্যস্ত থাকে এবং তার ফলে তারা যেন সদা-সর্বদা বিদেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে তাদের উন্নয়নের জন্যে তাদের সামরিক সাজ-সরঞ্জামের জন্যে এবং সর্বোপরি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে।

এই উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ ভারতবর্ষকে খণ্ডিত করে দুটি বিবদমান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে এবং পরবর্তীতে তাদের মধ্যে নানাবিধ ঝগড়া বিস্বাদ বাধিয়ে রেখে ইংরেজরা তাদের প্রভুত্ব এবং প্রভাব উভয় রাষ্ট্রের উপরই বজায় রাখতে সক্ষম হবে ভেবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম লীগের ধর্মাশ্রিত রাজনীতি এবং কংগ্রেসের মধ্যেকার কট্টর হিন্দুত্ববাদী অংশের নেতৃত্বের মাধ্যমে ভারতবর্ষের নানাস্থানে যেমন উত্তর ভারত, বিহার, পাঞ্জাব ও বাংলায় চল্লিশের দশকে দফায় দফায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান নর-নারী শিশু হত্যা, উভয় সম্প্রদায়ের হাজার হাজার নারী এ কে অপররে দ্বারা ধর্ষণ, লুটপাট, ব্যাপক অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির মাধ্যমে এমন একটি ভয়াবহ পরিবেশ রচনা করা হলো যার ফলে একনিষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক নেতা মহাত্মা গান্ধীসহ কংগ্রেসের আরও অনেক অসাম্প্রদায়িক নেতা এবং পরবর্তীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও মনে করেছিলেন যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হলেও, ধর্মের ভিত্তিতে হলেও, ভারত বিভাগ এবং দুটি পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি করা তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী মেনে নেওয়া ছাড়া এই ক্রমবর্ধমান দাঙ্গা, প্রাণহানি ও সম্পদহানির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার আর কোন বিকল্প নেই। এমনকি তার এও ধরে নিয়েছিলেন, দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে একদিকে যেমন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, তেমনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিষবাস্পের হাত থেকেও চিরতরে রেহাই পাওয়া যাবে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ বা শেষতক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিই বা কেন শান্তিকামী কল্যাণকামী তৎকালীন কোটি কোট মানুষও সম্ভবত: এমনটিই ধারণা করেছিলেন। কিন্তু মওলানা আবুল কালাম আজাদ, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফ্ফার খান, কিষাণ চন্দর, সহ বহু রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী তখন এই সিদ্ধান্তের চরম বিরোধিতা করে বলেছিলেন সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপ দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত অবাস্তব ও আত্মঘাতী।

সে যাই হোক, অবশেষে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা এলো, ইংরেজরা আমাদের দেশ ছেড়ে যেতেও বাধ্য হলো। কিন্তু ঐ যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, মানুষে মানুষে বিভাজন- তার কি হলো? ভারত বিভাগ তো আমরা মেনেই নিয়েছিলাম এবং তা জোড়া লাগানোর কোন প্রস্তাব আদৌ আমরা মানতে পারি নি। কিন্তু আমরা মনে প্রাণে কামনা করেছিলাম, দৃঢ়তার সাথে দাবী করেছিলাম যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উগ্র ধর্মান্ধতা প্রভৃতি প্রতিরোধের জন্য এবং সাম্প্রদায়িকতার সমাধি রচনার জন্য সেদিন দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো- সেই আকাঙ্ক্ষার, সেই প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়ন যেন হয়।

এখন ফিরে আসি মহাত্মা গান্ধী প্রসঙ্গে। লক্ষ্য করা প্রয়োজন, তিনি অভিহিত হলেন ভারতের নন্দিত নেতা হিসেবে, কংগ্রেসের এবং গোটা ভারতবর্ষসহ বিশ্বের একজন নন্দিত নেতা হিসাবে। সেই মহাত্মা গান্ধী নিহত হলেন ভারতবর্ষের মাটিতে প্রকাশ্য দিবালোকে এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের (১৫ আগস্ট ১৯৪৭) এর মাত্র ছ’ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে। গভীরভাবে ধর্ম বিশ্বাসী এবং সকল ধর্মবিশ্বাস, ধর্ম ও ধর্ম বিশ্বাসীদের প্রতি অসাধারণ শ্রদ্ধাশীল, বর্ণবাদ, গোষ্ঠীবাদ এবং এমন কি ভোগবাদ-বিরোধী এই জননেতা প্রাণ হারালেন একজন “হিন্দুর” হাতেই। ঐ হিন্দু, যার নাম নাথুরাম গজসে, কিন্তু ব্যক্তি গান্ধীজীকে আদৌ অশ্রদ্ধা করতো না, বরং ছিলো তাঁর প্রতি গভীর ভাবেই শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু তার দল হিন্দু মহাসভা ছিলো অসাম্প্রদায়িক আদর্শের এবং হিন্দু মুসলমানের সৌহার্দের সম্প্রীতির ঘোরতর বিরোধী এবং সে কারণেই গান্ধীজী ছিলেন হিন্দু মহাসভা রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আর.এস.এস) প্রভৃতি নামক উগ্র হিন্দু মৌলবাদী দলের আদর্শিক শত্রু। তাই তারা তাঁকে হটিয়ে দিলো এই পৃথিবী থেকে। প্রমাণিত হলো যে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর সাথে আপোষের মাধ্যমে যেমন সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটানো যায় না- তেমনি যায় না সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করতে। বরং এমন আপোষ আত্মঘাতী পরিণতিই ডেকে আনে-নির্মম সত্য হলো- তার প্রথম শিকারই হলেন মহাত্মা গান্ধী- যাকে নিয়ে আজও সভ্য দুনিয়ার অহংকারের সীমা –পরিসীমা নেই। শুধু তাই নয়, এহেন আদর্শ-বিসর্জনতুল্য আপোষের মাধ্যমে ঐ উগ্র মৌলবাদী শক্তিগুলি সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করলো, হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আর.এস.এস) সহ আরও আরও হিংস্র মৌলবাদী দলের বিস্তার লাভ হলো এবং বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে তারা অন্যদের সাথে নিয়ে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও দখল করেছিলো। আজও তারা ভারতের মাটিতে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং যথেষ্ট প্রভাব ও বিত্তশালী একটি দল। সর্বাপেক্ষা পরিতাপের বিষয়, মহাত্মা গান্ধীর জন্ম যে প্রদেশে-সেই গুজরাটে অপ্রতিহতভাবে রাজত্ব করে চলেছে উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং দাঙ্গার প্রশ্রয় দানকারী নেতা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এক প্রাদেশিক সরকার। ঐ বিজেপি দিল্লীর মসনদ দখলে নিয়েছে বহু রাজ্যে ও মন্ত্রীসভা গড়েছে।

তবে কি গান্ধীজী জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই? না- তা আদৌ সত্য নয়। মহাত্মা গান্ধী জাতির পিতা ছিলেন-আজও ভারতবর্ষের সকল মহল কর্তৃক তিনি সেইভাবেই নন্দিত-কিন্তু তিনি মন্ত্রিত্ব বা কোন রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা গ্রহণ করেন নি। ছিলেন সাধারণ একজন। কোন সম্পত্তি তাঁর ছিল না, বিত্ত ও নয়, জৌলুষ না- কিন্তু বিশ্বজনীন মানবতার পূজারী হিসেবে, অজেয় একজন মানবতাবাদী হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী ঈর্ষণীয় ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। লুই ফিসারের প্রখ্যাত বই () এ ঐ প্রখ্যাত লেখক- সাংবাদিক লিখেছেন, () (বঙ্গানুবাদ: তবুও সরকার অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা এবং তাঁদের পিছনে সমবেত বাহিনীরা ৭৮ বছর বয়স্ক এই ক্ষীণকায় ব্যক্তির মৃত্যুতে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। ভারত সরকার সহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ শেকেই ৩৪৪১টি শত:স্ফূর্ত শোকবাণী পেয়েছিলেন। পোপ, তিব্বতের দালাইলামা, ক্যান্টাববেরীর আচৃবিসপ, লন্ডনের চিফ রাকী, চীনের চিয়াংকাইসেক, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সহ প্রায় সকর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রেরই প্রধানরা এবং পৃথিবীর প্রায় সকল ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির প্রধানরাও গান্ধীজীর মৃত্যুতে শোকবাণী পাঠিয়েছিলেন। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, () অর্থাৎ আমাদের এই নৈতিক অবক্ষয়ের চরম লগ্নে, তিনিই দাঁড়িয়েছিলেন রাজনৈতিক পর্যায়ে উন্নত এক মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তাঁর মৃত্যুতে জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গভীর শোক প্রকাশ করে। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিনিধি আঁদ্রে প্রোমিকো নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, () অর্থাৎ গান্ধীজী ছিলেন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে বলিষ্ঠ একজন যার নাম চিরকাল ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে। জাতি সংঘ তাঁর মৃত্যুতে তাঁর পতাকা অর্ধনমিত করে। লুই ফিসার লিখেছেন, () অর্থাৎ মানবতাও তার পতাকা অর্ধনমিত করেছিল।

গোটা ভারতবর্ষ সেদিন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। সারাটি দেশ জুড়ে অসংখ্য বিশাল বিশাল শোক সমাবেশ, সকল মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদুয়ারসহ সকল প্রার্থনালয়ে শত:স্ফূর্ত প্রার্থনা সভা, দেশ জুড়ে গান্ধীজীর অতি প্রিয় রামধূন গীত, “ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম, সব কো সুমতি দে ভগবান” গীত হয়েছিল। বহু বাড়ির লাখো-কোটি মানুষ উপবাস থেকেছে, রোজা পালন করেছে ইত্যাদি।

আমার চোখের সামনে সেই দিনের পাবনার চেহারাটি আজও উজ্জ্বল। বেতার যোগে (তখন তো টেলিভিশন আসেনি) মহাত্মা গান্ধীর হত্যার সংবাদ প্রচার হওয়ার সাথে সাথে (সন্ধ্যার পর) সকল দোকান-পাট শত:স্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়, পরদিন পাবনা শহরের সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষিত হয়, পূর্ণ হরতাল পালন করা হয় এবং হাজার হাজার মানুষের এক বিশাল শোক মিছিল সারা পাবনা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক পরিভ্রমণ করে। পাকিস্তানী শহর পাবনায় কেন, বাংলাদেশের পাবনাতেও এত বড় এবং স্বত:স্ফুর্ত শোক সমাবেশ আজতক আমি আর দেখিনি। পরে যেদিন গান্ধীজীর মৃত্যুতে নাগরিক সমাবেশ শোক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় পাবনা টাউন হল ময়দানে-তাও ছিল এক অনন্য সাধারণ শোক সমাবেশ। নির্মিত বিশেষ উঁচু মঞ্চে স্থাপিত গান্ধীজীর ছবি, দলমত নির্বিশেষে প্রতিনিধিত্বশীল সকল স্তরের মানুষের পুষ্পর্ঘ প্রদান , গীতা, কোরআন ও বাইবেলসহ সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ, নেতৃবৃন্দের ভাষণ, শিল্পীদের পরিবেশিত রামধুন গীত ও শোকসঙ্গীত এক অবিশ্বাস্য পরিবেশের রচনা দৃশ্য সকলকে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলো।

যা হোক, গান্ধীজী তবে কেন এত মহান? সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের এবং তার প্রণেতা অপশক্তি গুলির সাথে সমবেদনা সত্বেও? কারণগুলি হলো ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবীতে তিনি বিচিত্র ধর্মীয় অহিংস আন্দোলনের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা, হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান অর্থাৎ ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায় ও জাতি গোষ্ঠীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাহসী বিরোধিতাকারী, একই ধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে নানা গ্রুপিং ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে সোচ্চার (যেমন প্রাক্ষ, কায়স্থ, বৈশ্য, শুদ্র, নারী-পুরুষ) এবং সকল প্রশ্নে তিনি আপোষহীন আন্দোলন সূচনাই শুধু করেন নি-জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোন নিরাপত্তা বাহিনীর আশ্রয় না নিয়ে খালি পায়ে ছুটে গেছেন সকল দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায়, ঘুরেছেন ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি বাড়ি, ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য করেছেন জাতীয় নেতৃত্বকেও এবং বিলম্ব ঘটলে বহুবার তিনি আমৃত্যু অনশন শুরু করে দাঙ্গাপীড়িত মানুষদের (সে হিন্দুই হোক, মুসলমানই হোক, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানই হোক) পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এভাবে কোটি কোটি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টানসহ গোটা মানবজাতির বিশ্বস্ততম নেতায় পরিণত হয়েছেন- তাঁদের মনের মণিকোঠায় তিনি স্থান করে নিয়েছেন। এবং তাঁর এই অবদান আজও অম্লান। আমি তাঁর আফ্রিকায় বর্ণবাদ বিরোধী গৌরবময় আন্দোলনের কথায় স্থানাভাবে আর গেলাম না।

এই নিবন্ধের মাধ্যমে গান্ধীজীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাঁকে নতুন করে ভাবতে, তাঁর আপোষহীনতার ক্ষেত্রগুলি থেকে ইতিবাচক শিক্ষা এবং যেখানে তিনি সমঝোতা করেছিলেন তার যে করুন পরিণতি ঘটেছিলো এবং আজও যে গোটা ভারতবর্ষ এবং আমাদের এই উপমহাদেশটি জুড়ে এখনও রক্তক্ষয়, দেশত্যাগ প্রভৃতি ঘটছে তা থেকেও শিক্ষা নিয়ে নিজ নিজ দেশে সাম্প্রদায়িকতার মৌলবাদ বিরোধী লড়াইতে সকল গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তির আপোষহীন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শুরুর প্রয়োজনীয়তার প্রতি সংশ্লিষ্ট মহলগুলি তথা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মহলগুলির বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিশেষ করে আজ স্বাধীন বাংলাদেশেও যখন সাম্প্রদায়িকতা নতুন করে বিষাক্ত ফণা তুলেছে।

তাঁর প্রিয় রামধূন গীত “ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম, সবকো সুমতি দে ভাগবান” আজও প্রেরণা যোগাক সকল কল্যাণকামী মানুষের মনে আমাদের উপমহাদেশটিতে।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন