আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

জাপানের ‘সেরা তরুণ বিজ্ঞানী’ নিয়ে মিথ্যাচার ও গণমাধ্যমের ভূমিকা

এস এম নাদিম মাহমুদ  

একাডেমিক ব্যস্ততায় মাস খানেক ধরে ফেইসবুকের বাহিরে ছিলাম। এর মধ্যে ঘটে গিয়েছে অনেক কিছু। ফেইসবুকে না থাকায় আমি সম্ভবত এই একটি খবর মিস করেছিলাম। তবে আমার বিশ্বাস যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তাদের একটি বড় অংশ  ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক খবরে জেনেছেন ‘এবার জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী নির্বাচিত হয়েছেন মো. আরিফ হোসেন।

গত ২৪ অক্টোবর জাপানিজ সোসাইটি ফর ইনহ্যারিটেড মেটাবোলিক ডিজিজের ৬১তম বার্ষিক সম্মেলনে জাপানের জিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আরিফ হোসেন ‘সেরা তরুণ বিজ্ঞানী’ হিসেবে যে স্ব-ঘোষিত ঘোষণাটির পর দেশের গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশের হিড়িক পড়ে গিয়েছে।

এই ধরনের পুরস্কার শুধু জাপানে কেন বিশ্বের যেকোনো দেশে যদি কোন বাঙালি পায় তাতে আমাদের গর্বে বুক ফুলে উঠে। আমরা সত্যি আনন্দবোধ করি।

আরিফ হোসেন আমাদের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন ২০১৪ সালের এপ্রিলে । এই ক্ষেত্রে এমন সংবাদ নিয়ে আমারও গর্ব করা কথা ছিল। প্রথম দিকে করেছিলামও, কিন্তু পরবর্তীতে যখন এই পুরস্কারের রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছি, তখন সত্যি নিজের কাছে অসহায় লাগছে। এতো বড় একটি পুরস্কার নিয়ে যে মিথ্যাচার হয়েছে তা পাঠক আপনারা জানলেও গা শিউরে উঠতে পারে। একজন বাঙালি হিসেবে আমি লজ্জিত। তাই বিবেকের তাড়নায় আরিফ হোসেনের বর্ষসেরা তরুণ বিজ্ঞানীর খবর নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজনবোধ করছি। এই বিষয়টি আলোচনার আগে চলুন দেখি, আরিফকে নিয়ে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে কী কী খবর এসেছে তা একটু দেখে আসি।

গত ২৬ অক্টোবর যুগান্তরে তাদের অনলাইন সংস্করণে শিরোনাম করেছিল ‘জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হলেন বাংলাদেশের ডা. আরিফ', যে খবরটিতে বলা হচ্ছে, এ বছরের জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের ডা. আরিফ হোসেন। জাপান মেডিকেল সায়েন্সের ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ৬১ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোন নন-জাপানিজকে এ গৌরবময় পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হলো।

প্রায় একই ধরনের শিরোনামে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী নির্বাচিত হলেন ডা. আরিফ হোসেন খবর প্রকাশ করলেও তারা ২ নভেম্বর একটি বিশেষ প্রতিবেদন জাপানের সেরা বিজ্ঞানী বাংলাদেশের আরিফ যেখানে তারা বলছেন, লাইসোসোমাল রোগের চিকিৎসাব্যবস্থা উদ্ভাবনের জন্য এ বছর জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে নির্বাচিত হন ডা. আরিফ হোসেন। এ সংস্থাটি প্রতি বছর সেরা জাপানিজ তরুণ বিজ্ঞানী নির্বাচন করে।

একই তথ্য দিয়ে দৈনিক সমকাল গত ২৮ অক্টোবর শেষের পাতায় প্রথম কলামে জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী গোপালগঞ্জের ডা আরিফ খবর ছাপে। গত ৯ নভেম্বর  কালের কণ্ঠও তাকে নিয়ে বড় স্টোরি করেছে। এছাড়া চ্যানেল আইসহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল সেরা বিজ্ঞানীকে নিয়ে সংবাদ করেছে।

এই বিষয়টি নিয়ে বার্তা সংস্থা ইউএনবির রাজশাহী প্রতিনিধির করা এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা টিব্রিউন, ডেইলি স্টার, ডেইলি সান, প্রথম আলো (ইংরেজি সংস্করণ) Bangladeshi researcher best young scientist in Japan শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছে। যে খবরগুলোতে বলা হয়েছে, Arif Hossain, a Bangladeshi national doing his PhD in Japan, has been recognised as the best young scientist of the far-eastern country.  

এমনকি মুঠোফোন কোম্পানি (গ্রামীণফোন) ফেইসবুকে আরিফ হোসেন অভিনন্দন জানিয়ে একটি স্টিকারও শেয়ার করা হয়।
 
পত্রিকার শিরোনাম ও খবরের মিছিল দেখে যে কারও মনে হতেই পারে  আরিফ হোসেনকে ধরা যেতে পারে জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী। কিন্তু অসততার আশ্রয় নিয়ে স্ব-ঘোষিত সেরা বিজ্ঞানী বনে যাওয়া এই গবেষক গত ২৪ অক্টোবর জাপানিজ সোসাইটি ফর ইনহ্যারিটেড মেটাবোলিক ডিজিজের ৬১তম বার্ষিক সম্মেলনে যে পুরস্কারটি গ্রহণ করেছেন সেই পুরস্কারে আসলে কী লেখা আছে, পাঠক আসুন একটু জেনে নিই।

পুরস্কারের শুরুতে জাপানিজ ভাষায় লেখা হয়েছে ‘নিহন সেনতেন তাইশো ইজো গাক্কাই শোরেশো’ এর অর্থ হলো জাপানিজ সোসাইটি ফর ইনহ্যারিটেড মেটাবোলিক ডিজিজের পুরস্কার’।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্যারায় প্যারায় লেখা হয়েছে নোশিনকে নিক্কোন কেনকিউজো হুজোকো। সেনতান ইডিও কেনকিউ সেন্টার ইদেন বিজ্জও টিরিও কেনকিউশো হোসেন মুহাম্মদ আরিফ, কিদেননো লাইসোসোমরিও নো বিউতাইসা নানাবিনি রিরিওনি কাইসুরো কেনকিওয়া লাইসোম বিউনো বুংয়া নিউইতে হিজোনি জোইয়োনা কেনকিউ দে আয়ারি কোনগোনো হাতেনগা কিতাই সারেমাস।

এর অর্থ হলো অ্যাডভান্সড মেডিকেল স্টাডি সেন্টারের জেনিটিক রিসার্স ইন্সটিটিউট পক্ষ থেকে মুহাম্মদ আরিফ হোসেন আপনি লাইসোসোম কেন্দ্রিক রোগের মেটাবোলিক ও থেরাপি নিয়ে কাজ করেছেন। আপনার গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা ভবিষ্যতে আপনার কাছ থেকে আরও ভাল কিছু প্রত্যাশা করি।

এই স্মারকের সর্বশেষ লাইনে বলা হয়েছে, ইউতো কোকোনি নিহন সেনতেন তাইশো ইজোও গাক্কাই সোরেশোও জিও ইতাশিমাস।

যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, আর এইজন্য আপনাকে এই পুরস্কার দেয়া হলো।

পাঠক লক্ষ্য করুন, এই স্মারকের কোন শব্দে বা বাক্য ‘জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী’ শব্দটি উল্লেখ করা নেই। এমনকি কোথাও বলা হয়নি, আরিফ হোসেন প্রথম নন-জাপানিজ যে কিনা ৬১ বছরের ইতিহাসে প্রথম এই পুরস্কার পেয়েছেন।

কিন্তু চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন আরিফ হোসেন। স্মারকটিতে জাপানিজ ভাষায় লেখায় আমরা বাঙালিরা হয়তো বিষয়টি বুঝতেই পারিনি। এমনকি সোসাইটির ওয়েব সাইটটি জাপানিজ সংস্করণে হওয়ায় কেউ সঠিক তথ্য পাবে না। এই কৌশলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক এই শিক্ষার্থী সফলও হয়েছেন। কিন্তু পাঠকদের জন্য জাপানিজ ভাষাটি ভাষান্তর করে দিয়েছি।

বিষয়টি জানতে গত ২৮ অক্টোবর জাপানিজ সোসাইটি ফর ইনহেরিটেড মেটাবোলিক ডিজিসস (জেএসআইএমডি) প্রেসিডেন্টের  সাথে যোগাযোগ করা হলে তার পক্ষ থেকে সোসাইটিটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক হিরোইউকি ইডা আমাদের বিস্তারিত তথ্য দেন। যদিও তারা কিছু সময় নিয়েছে, তবে সঠিক তথ্য পেয়ে একজন বাঙালি হিসেবে এমন মিথ্যাচার সবাইকে জানানো নিজের দায়িত্বও কর্তব্য বলে মনে করি।

তাদের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, জাপানে সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হতে গেলে এই ধরনের পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা কী? কিভাবে তাদেরকে নির্বাচিত করা হয়।

এই প্রশ্নের উত্তরে  হিরোইউকি ইডা বলেন, মূলত এই কমিউনিটির যারা আবেদন করেন, তাদের বয়স ৪৫ বছরের নিচে হতে হবে এবং গত দুই বছরের ভালো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে সেই তথ্য লাগবে। আবেদন জমা হওয়ার পর কমিটির সাতজন স্পেশালিষ্ট যদি মনে করেন, যে কোন আবেদনকারী আরও ভাল কিছু গবেষণা করতে পারবে তখন এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।

আরিফ হোসেন জাপানের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন কী না এমন প্রশ্নের উত্তরে জিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রেডিয়াট্রিকস বিভাগের সভাপতি বলেন,  এই পুরস্কারের কোন ইংরেজি নাম নেই। তরুণ গবেষকরা যাতে আরও বেশি ভালো করতে পারে তার জন্য আমরা ‘উৎসাহ পুরস্কার’ দিই।

লাইসোসোমাল সংরক্ষণে যে রোগ হয় তা গবেষণার আরিফ হোসেনকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। এটি কোন বর্ষ সেরা তরুণ বিজ্ঞানী পুরস্কার নয় বলে তিনি দাবি করেছেন।

অথচ আমাদের গণমাধ্যম এই সংবাদটি যাচাই করার কোন প্রয়োজনবোধ করেননি।

জাপানে যারা পড়াশুনা করছেন, সায়েন্টিফিক কমিউনিটিগুলো সব সময় যে সব কনফারেন্স সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে সেখানে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়। মূলত যারা গবেষণায় ভাল করছে, ওরাল ও পোস্টারে ভাল করেছে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়। এটি বলতে গেলে গবেষণা জগতের  একটি মামুলি বিষয়। শুধু জাপানে নয়, প্রায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাঙালিরা যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, তাদের এই  পুরস্কারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রায় প্রতিটি গবেষক কমিউনিটি বা সোসাইটির পুরস্কার পেয়ে থাকেন। আর ডা. আরিফ হোসেন যে পুরস্কারটি পেয়েছেন সেটিও এই ধরনের পুরস্কার।

এখানে আরিফ হোসেনের পুরস্কারকে ছোট করে দেখার বিষয় নয়। নিশ্চয় এই ধরনের পুরস্কার অবশ্যই সম্মানের। কিন্তু বিষয়টি হলো, যে পুরস্কারকে ‘বর্ষসেরা’ পুরস্কার দাবি করা হয়, সেটি নেহাত কম মিথ্যাচার নয়। এটি একজন ভালো সাইন্টিস্টের ইন্ট্রিগ্রিটির বাহিরে। যা আমাদের গবেষণা নীতির বিরুদ্ধাচারণ।

যিনি বছর সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে দাবি করেছেন, তার জন্য আমরা সত্যি লজ্জিত। এটা কোন সেলিব্রেটি শো না যে এখানে এসে পারফর্ম করে বর্ষসেরা বিজ্ঞানী হতে হয়। এছাড়া কোনদেশের সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে চিহিৃত করার কোন ইন্ডিকেটরও নেই। বিজ্ঞানের গবেষণায় নানার ফিল্ড রয়েছে। একেক ফিল্ডে একেকজন সেরা হতে পারেন। কিন্তু সমগ্র দেশজুড়ে সেরা বিজ্ঞানী হওয়ার নজির জাপানে আমি কখনো দেখিনি।

সবচেয়ে মারাত্মক মিথ্যাচার হয়েছে এইখানে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ৬১ বছরের ইতিহাসে তিনি প্রথম কোন নন-জাপানিজ যাকে এই পুরস্কারটি দেয়া হয়েছে।

কিন্তু আমাদেরকে  জিকেই বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালেরও প্রেসিডেন্ট হিরোইউকি ইডা জানিয়েছেন, এই সোসাইটির অধীনে ১৯৮৪ সাল থেকে ৫৯ জনকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। যদিও অধিকাংশ সময় জাপানিজরা পেলেও সেখানে ২ জন চীনা গবেষকও পেয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য জিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের গবেষক আরিফ হোসেনের সাথে গত ১ নভেম্বর কথা হয়েছিল আমার তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, গণমাধ্যমগুলোর খবরে ‘জাপানের বছরের সেরা তরুণ বিজ্ঞানী’ আপনি কিভাবে নিজেকে সেরা বিজ্ঞানী মনে করছেন?

আরিফ হোসেনের দাবি, এটি কোন প্রতিযোগিতামূলক কোন পুরস্কার নয়। একুশে পদক যেভাবে সিলেকশন করা হয় সেই উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর কেউ সেরা বিজ্ঞানী নয়। নোবেলজয়ী জাপানি অধ্যাপক ইয়ামানাকা কি পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী?

একজন নোবেল বিজয়ীকে যিনি সেরা মনে করেন না, তাহলে তিনি কিভাবে নিজেকে জাপানের বর্ষসেরা তরুণ বিজ্ঞানী বলে প্রচারণা করেছেন তার ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। এমনকি সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে যখন কেউ থাকে না তাহলে তিনি কিভাবে বর্ষ সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হলেন?

উৎসাহমূলক পুরস্কারকে কেন বর্ষসেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে গণমাধ্যমে তথ্য দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বারবার এড়িয়ে যান।

৬১ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোন বিদেশীকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে বলে আপনি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু জাপানিজ সোসাইটি ফর ইনহেরিটেড মেটাবোলিক ডিজিসস (জেএসআইএমডি) বলছেন পুরস্কারটি শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৫ বছর আগে যেখানে ২ জন চীনা গবেষককে এই পুরস্কারের আওতায় আনা হয়েছে বিষয়টিকে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলে উঠেন, হ্যাঁ আমি প্রথম।

অথচ পুরস্কার প্রদানকারী সোসাইটির দাবি ২ জন চীনের গবেষক ইতিমধ্যে এই পুরস্কার পেয়েছেন তাদের গবেষণার উৎসাহ হিসেবে। খোদ গত বছরই একজনকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে যে কিনা চীনের যা জেএসআইএমডির ওয়েবসাইটই বলছে।

এমন মিথ্যাচার যে গবেষক দিনের আলোতেই করতে পারে তাকে নিয়ে কিছু বলার আর প্রয়োজনবোধ করছি না।

সত্যি কথা বলতে কি আমার বিশ্বাস ডা. আরিফ হোসেন নিজেই জানেন না এই  জাপানিজ সোসাইটি ফর ইনহেরিটেড মেটাবোলিক ডিজিসস (জেএসআইএমডি) কত সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

সোসাইটি বলছে তারা ১৯৬৫ সালে প্রথম তা প্রতিষ্ঠা করেন। ২০ সদস্যের এই সোসাইটির শুরুতে উপ-পরিচালক ছিল তেরো কিতাগাওয়া। সেই হিসেবে বর্তমান পর্যন্ত এই মেটাবোলিক সোসাইটির বয়স হচ্ছে মাত্র ৫৪ বছর। কিন্তু ডা আরিফ গণমাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করেছেন ৬১ বছরের। ছয় বছর আগে কোথায় এই সোসাইটি গঠিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা ডা. আরিফ হোসেন দিবেন কোথায় থেকে?

তাকে যখন সর্বশেষ জিজ্ঞাসা করেছি, উৎসাহমূলক পুরস্কারকে আপনি কেন বর্ষসেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে দাবি করেছেন? তার উত্তর তিনি দিতেই পারেননি। এমনকি তাকে যখন বললাম, যে আপনি যে পুরস্কার পেয়েছেন, তা অনেক বাঙালি বিভিন্ন কনফারেন্সে পেয়ে থাকেন তার মানে কি সে বর্ষসেরা বিজ্ঞানী? এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। তাই তিনি এটিওর সঠিক জবাব দেননি।

আরিফ হোসেন পুরস্কৃত হয়েছেন, সাধারণভাবে এই তথ্যটি দিয়ে গণমাধ্যমে খবর এলেও সমস্যা ছিল না, কিন্তু যখন তিলকে তাল মনে করে প্রচার করা সেটা এক ধরনের অপরাধই বটে। যে সোসাইটি তাকে গবেষণা সামনে আরও ভাল করার জন্য উৎসাহ দিতে পুরস্কৃত করলো, সেই সোসাইটির নাম ভাঙিয়ে পুরো জাপানকে হেয় প্রতিপন্ন করে সেটিকে আমি কখনোই সুবোধ বলে মনে করি না।

ডা. আরিফ হোসেন কেন, আমি চাই প্রতিটি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসা বাঙালি দেশে ফিরুক, ভাল গবেষণা ও চিকিৎসা সেবা দিক কিন্তু মিথ্যাচার করে, সারা বাংলাদেশকে বোকা বানিয়ে দেশে ফেরার ইচ্ছে হয়তো ম্লান হওয়ার শামিল। এমন জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরার প্রয়োজন ছিল না, নিজেরে গবেষণায় পারে নিজেকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে।

কিন্তু আরিফ হোসেনের এই মিথ্যাচারের টোপ কিভাবে আমাদের দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো গিলে ফেললো তা নিয়ে আমার মত ক্ষুদ্র একজন সংবাদকর্মী হিসেবে লজ্জিত। সেরা সাইন্টিস্ট, ৬১ বছরের ইতিহাসে প্রথম নন-জাপানিজ এই বিশেষণ পাওয়া সংবাদের গুরুত্ব হাউজগুলো বুঝলেও সত্যতা যাচাই করতে ব্যর্থ হয়েছে।

হয়তো এইসব গণমাধ্যমের জাপান প্রতিনিধি না থাকায় হয়তো কিছু করার ছিল না, কিন্তু এমন একটি সংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশন নিয়ে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।

একজন সংবাদকর্মী হিসেবে, আমি হয়তো জাপানের এই ভুয়া খবরটি নিয়ে লিখতে পারছি বিস্তারিত, কিন্তু এমন অনেক সংবাদ আমাদের সংবাদ মাধ্যমে আসে, যাদের তথ্যগুলো মূলত স্টোরি হোল্ডারের কাছ থেকে নেয়া, উনি যা বলবেন, সেটাই বিশ্বাস করতে হবে এমন সাংবাদিকতা কিছুটা হলেও পাঠকদের ভোগান্তিতে ফেলে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ একজন যদি বলে দেয়, আমি জাপানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছি সেই তথ্য নিয়ে যেমন সংবাদ করা যায় না, তেমনি আমি কোথাও আমি অপরাধ করেছি সেটি নিয়েও নয়।

ক্রস চেকিং করা না গেলে আরিফ হোসেনদের তথ্যে এতো বড় প্রচারণার সুযোগ দেয়া দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার মধ্যে পড়ে না বলে বিশ্বাস করি।

আমাদের সামান্য একটু সর্তকতার অভাবে হয়তো কখনো কখনো ফেইসবুকে উগ্রবাদের চর্চাকারী কিংবা প্রবাসে বসে কেউ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের মিছিলকারীদের প্রমোট হয়ে যেতে পারে।

বিষয়গুলো এমনই হয়ে যেতে পারে, দেশে কেউ বড় মাপের দাগি আসামী ছিলেন পরে বিদেশে এসে পুরস্কার নিয়ে দেশের মানুষের কাছে নিমিষে সাধু বনে চলে যেতে পারেন। ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য কোন কোন সংবাদের জন্য বেশি কাজে দেয়।

তাই,  দলবেঁধে সংবাদ করার চেয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর উচিত হবে, প্রবাসী বাঙালিদের এমন প্রাপ্তিকে রগরগে শিরোনামে সংবাদ করার চেয়ে বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করা।

আশাকরি, আমরা সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারবো। প্রবাসে বাঙালিদের ছোট-বড় প্রাপ্তিগুলোকে দেশবাসীকে জানাবো। অন্তত আরিফ হোসেনের মত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়াদের তথ্য প্রকাশ করা থেকে আমরা সচেতন থাকবো।

এস এম নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ