আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

এনআরসি-অনুপ্রবেশ ঠেকানো এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেন জরুরি

দেব দুলাল গুহ  

আমি ছোট মানুষ, তবুও সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে আগেই সতর্ক করে পত্রিকায় লিখেছিলাম। বিজ্ঞজনদের ধারণা, রোহিঙ্গাদের জায়গা দেওয়াটাই হয়েছে প্রথম ভুল। সেটা দেখে অন্যরাও আসার সাহস পাচ্ছে। একবার বর্ডারে যেতে পারলে আর ফিরে আসতে হবে না- এমন ধারণা এখন সবার। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন- আগে তাদেরকে তাড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হোক, দরকার হলে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হোক, দরকার হলে সীমান্তে ফাঁকা ব্রাশফায়ার করা হোক, এমনিতেই সীমান্তের দিকে আসা বন্ধ হয়ে যাবে। আমার মত একটু ভিন্ন।

এখন এক দেশে নাগরিকত্বের কড়াকড়ি আর সহজ রোজগারের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের দৃষ্টিতে অপেক্ষাকৃত 'ঘুষ-দুর্নীতির অভয়ারণ্য' দেশে তো দলে দলে লোক ঢুকবেই! এমনিতেই আমার দেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ, তার ওপর এত বাড়তি লাখ লাখ মানুষকে জায়গা দিলে আমরা আগামীতে থাকবো কোথায়, খাবো কী আর করবোটাই বা কী? আমরা নাহয় কোনোমতে জীবনটা কাটিয়ে দেব, কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্ম? তাদের জন্য কেমন দেশ রেখে যাচ্ছি? জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঠেকাতে অনুপ্রবেশ বন্ধের পাশাপাশি অচিরেই পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর মতো 'দুটি সন্তানই যথেষ্ট' এর বদলে 'দুটি সন্তানই কাম্য/আবশ্যক' নীতি নেওয়া দরকার।

মমতা ব্যানার্জি যতই বলুন, 'এনআরসি করতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে..', বাস্তবতা হচ্ছে তিনি নিজেও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নন। তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সবার উপস্থিতিতে শপথ নিয়েই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। সেগুলো তিনি মানছেন কিনা, তা দেখার জন্য সেখানে কেন্দ্র সরকার নিযুক্ত রাজ্যপাল আছেন। আপনারা ভারতীয় মিডিয়ার কল্যাণে জানেন, এই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয়। ভোট ব্যাংকের কথা ভেবেই হোক, কিংবা সত্যিকারের মানবতার খাতিরে, এ নিয়ে ঐ দুই-তিনদিন রাস্তায় নামা বা অনশন করা পর্যন্তই- এর বেশি করতে গেলে রাজ্যপাল তাকে শপথ ভঙ্গ ও দায়িত্বে অবহেলার কারণ দেখিয়ে সরিয়ে বাংলায় রাষ্ট্রপতির শাসন কায়েম করতে পারেন। তারপর সুবিধাজনক সময় পর্যন্ত সেটা রেখে মমতাদির জনসমর্থন ও ক্ষমতা নাই করে দিয়ে বিজেপির দিলীপবাবুকে বসিয়ে দিতেই পারেন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে। এটাই হতে যাচ্ছে আসলে। তাই, মমতাদি চাইলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না।

কোনো পড়ালেখা বা কর্মগুণ ছাড়াই এক দেশে শুধু নেতাদের সাথে থেকেই যখন কেউ কোটিপতি হয়ে যেতে পারে, সেই লোকটাই বর্ডার পেরিয়ে ভারতে গেলে দেখবেন হয় রাস্তার পাশে ভাসমান টংয়ের দোকান চালায় নতুবা অন্য কোনো ছোট কাজ করে। একসাথেই দেশান্তরি হলেও দেখা যায় ওদেশে কোনো আত্মীয় কাউকে দেখে না। এখনও পর্যন্ত ভারত পুশব্যাক শুরু করেনি, যারা আসছে আগাম ভয়ে স্বেচ্ছায় আসছে। তবে এনআরসি এর কারণে কেউ কখনও সেখানে বিপদে পড়লে আপন আত্মীয়ই পরিচয় দেবে না, উল্টো কুকুর তাড়ানোর মতো পেটাতেও ছাড়বে না। কাজেই, যাদের নাগরিকত্ব নেই, তারা তো ভয় পাবেই! আধার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি মমতাদি আসার পর সহজেই পাওয়া গেছে কিছুদিন আগে বিজেপি আসার পরেও। তাই, এগুলোকেও আসলে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে নিতে পারছে না কেন্দ্র।

এদেশের জেলা পর্যায়ের কোনো কোনো বড় সরকারদলীয় হিন্দু নেতারও একসাথে দুইদেশের নাগরিকত্ব আছে বলে অভিযোগ ও তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। এমন যারা দ্বৈতনাগরিক আছেন, তাদেরকে বরং সপরিবারে ঐদেশে পাঠিয়ে দিলে দেশের বোঝা কিছুটা কমবে। এদেশে রোজগার করা অবৈধ টাকা খাটিয়ে ওখানে করছেন বিশাল সম্পদের পাহাড়, দোকান, বাড়ি, বাস ইত্যাদি কিনে সময় খারাপ হলেই সটকে পড়বেন এমন চিন্তায় আছেন যারা, তারা এবার কেটে পড়ুক এটাই আমাদের কাম্য। পাশাপাশি আমাদেরকে এটাও বুঝতে হবে যে বন্ধু দেশ বলেই তারা একাত্তরে যুদ্ধের সময় আমাদের ১ কোটি মানুষকে সীমান্ত খুলে দিয়ে আশ্রয় খাদ্য ট্রেনিং দিয়েছিলো এবং বন্ধু দেশ বলেই যে তারা সারাজীবন তাদেরকে রেখে দেবে- এমনটা করতে তারা বাধ্যও নয়। মমতাদির ঐ মমতাও শুধুমাত্র ভোটের জন্য, এই যাত্রায় তিনি অল্পের জন্য গেরুয়া ঝড়ের থেকে বেঁচে গেছেন টলিউডের তারকারাজি ও দেশান্তরি ভোটারদের কারণেই- এমনটাই সবাই বলে।

এখন যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই মানুষের ঢলকে জায়গা দেবেন নাকি সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেবেন। আসলে, ফিরিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, কারণ এমনিতেই আমাদের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। নিজের দেশ ও দেশের মানুষকে নিরাপদ করতে শুধু বর্ডাররক্ষা বাহিনীই হয়তো যথেষ্ট নয়, দরকার আছে কাঁটাতারের বেড়ারও। ভারত আমাদের অধিকাংশ দিক ঘিরে আছে বিধায় আমাদের সেটা না থাকলেও এতদিন চলেছে ওদের আছে বিধায়। মায়ানমারের সাথে আগেই থাকলে এই রোহিঙ্গারা আসতে পারতো না, আমার 'আমরা যেন নিজের লড়াই রেখে অন্যেরটা লড়ছি' শীর্ষক লেখাটি প্রকাশিত হবার বেশ পরে যার নির্মাণকাজ চালু হয়েছে। নিজস্ব বর্ডার থাকলে আর আমাদের অভিযোগ করতে হবে না যে 'বিএসএফ এর সহযোগিতায় ওরা বর্ডার দিয়ে ঢুকে পড়ছে', কারণ ওরা খুলে দিলেও আমাদেরটা তো বন্ধ থাকবে! আবার এদেশের যারা অবৈধ সুবিধা নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে পাহারা দিয়ে অলক্ষ্যে অনেককে আসার ও থাকার সুযোগ করে দিচ্ছেন, তারাও পারবে না বেড়া থাকলে। তবে প্রচুর খরচ করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের দরকার হবে না যদি ভারত-বাংলাদেশের মানুষ আন্তরিক ও সৎ হয় এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলো ও সরকারকে সহযোগিতা করে।

নতুন নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাশ হলেও নানা ধর্ম-বর্ণ-জাতের বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে লোক যাওয়া আপনি কিছুতেই ঠেকাতে পারবেন না, যদি না দেশের মানুষ দেশটাকে ভালোবাসতে পারে এবং পর্যাপ্ত কাজ ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পায়। পাশাপাশি সংখ্যালঘু নির্যাতনকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে। এখন আর মুসলিম কর্তৃক হিন্দু নির্যাতন করে সাম্প্রদায়িক ইস্যু হতে না দিয়ে সংখ্যালঘুদের কিছু অসৎ লোককে অবৈধ সুবিধা দিয়ে নেতা বানিয়ে নিরীহ ও বুদ্ধিজীবী সংখ্যালঘুদেরকে শায়েস্তা করা হয়, যেটা বন্ধ করতে হবে। আবার হিংসাসহ নানাবিধ কারণে এক সংখ্যালঘু অন্যকে দেখতে পারে না বিধায় শত্রুতা করে এমন নজিরও আছে। আমি নিজেই ভুক্তভোগী। অচিরেই এসব বন্ধ করতে হবে।

তবে ভারতের এই আইনের কারণে এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জেনে গেছে, নির্যাতিত হয়ে বর্ডার ক্রস করলেই নাগরিকত্ব দেবে ভারত। তাই কেউ কেউ উন্নত জীবনের আশায় ও নির্বিঘ্নে ধর্মকার্য পালনের আশায় দেশান্তরি হতে উদ্বুদ্ধ হতেই পারে। আবার পাশের বাড়ির মুসলিম ভাইটি বা এলাকার মোড়লও চাইতে পারে এলাকার অবস্থাসম্পন্ন হিন্দু বসতিটিকে নতুন উদ্যমে খোঁচাখুঁচি শুরু করতে, যাতে তারা একটু ভালো থাকার আশায় সব বিক্রি করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। এসব দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

তবে সবার আগে রোহিঙ্গাদেরকে যে করেই হোক ফেরত পাঠাতে হবে। নাহলে সামনে এনআরসির মতো আরও অনেক অনেক বিপদ আসবে- খাদ্য-আবাস-কর্মসংকট হবে, দুরারোগ্য ব্যাধির মহামারি হবে, উচ্চশিক্ষিত প্রজন্ম দেশ ছেড়ে উন্নত দেশে যেতে বাধ্য হবে। আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে আমরা আগামীতে কাদেরকে এই দেশে রাখতে চাই। সেই অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে ঠিক এখন থেকেই।

দেব দুলাল গুহ, প্রভাষক, লেখক ও কলামিস্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ