প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৭ জুন, ২০২০
আজই প্রথম ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করলো চীনের হামলায় তার সেনা নিহতের কথা। যদিও বেশ কিছুকাল ধরেই ভারতের লাদাখ সন্নিবর্তী এলাকায় চীনা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে; এমন খবর শোনা যাচ্ছিলো।
রাষ্ট্র পরিচালনা গরু চরানোর কাজ নয়। হিন্দুত্ববাদী কট্টরপন্থী নেতা নরেন্দ্র মোদি; উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থানের জন্য জনতুষ্টিকর কথা বলে; সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন দ্বিতীয় মেয়াদে। গরিবি হটানো আর কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যখন ভারতের সামনে একমাত্র লক্ষ্য ছিলো; ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এই রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন; পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে শিষ্টাচার ও ভারসাম্য রক্ষার কূটনীতিতে তিনি যখন ভারতকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন; তখন "হিন্দুত্ববাদ উদয়ের গেরুয়া ঝাণ্ডা উড়িয়ে মোদি আসেন পপুলিজমের ত্রিশূল হাতে।"
এই মোদি ভারতের ইতিহাস বিকৃত করার মতো অপ্রয়োজনীয় কাজে অনেক সময় নষ্ট করলেন। গুজরাটের পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে দিলেন জওহরলাল নেহেরুর নাম। মুসলমান নামের স্থানগুলোর নাম পরিবর্তনই যেন মোদির কাজের অগ্রাধিকার ছিলো। হুট করে নোট বাতিলের মতো জনতুষ্টিকর উদ্যোগ নিয়ে; দুর্নীতিবাজদের টিকিটিরও সন্ধান পাওয়া গেলো না; কষ্ট পেলো সাধারণ মানুষ। নরেন্দ্র মোদি যেন হিন্দু তুঘলক খান; যিনি তার তুঘলোকি কারবারে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন ভারতবাসীকে। ওদিকে মোদির গুজরাটের সহমত ভাইয়েরা ভারত লুণ্ঠন করে পশ্চিমে সেকেন্ড হোম বানিয়েছে এই ক'বছরে।
গরুর জন্য আধার কার্ড প্রবর্তন করে "গো-মাতা"-র অনুভূতিতে হাওয়া দিলেন মোদি; অথচ মানুষের অধিকারকে পায়ে মাড়িয়ে গেলেন।
এই মোদি গুজরাটের গণহত্যার সময়ের মুখ্যমন্ত্রী; যিনি তার অনুশীলিত নিষ্ক্রিয়তায় গুজরাটের মুসলমান গণহত্যা হতে দিয়েছিলেন। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম একটি কট্টর ধর্মীয় ও উগ্রজাতীয়তাবাদের অনুভূতির বলদায়তন হওয়ায়; ভারতে জনপ্রিয় ভোটে মোদি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হলেন। একবার নয়; দুবার ভোটাররা কট্টর হিন্দুত্ববাদের ত্রিশূলকে দিল্লীর মসনদ উপহার দিলো।
মোদি তার শাসনকালে হিটলারের অনুসরণে একটি উগ্রপন্থার শাসক সহিস হতে চেয়েছেন। সাধারণ দর্শক যেরকম দেশ চালানোর জাদু দেখে হাঁ হয়ে যায়; সেরকম সব গ্রামীণ যাত্রা করেছেন তিনি। ইয়োগার আসনে বসে কাশ্মীর গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। মোদির রানিংমেট অমিত শাহ; মুসলমান নিধনের সিপাহসালার হিসেবে ঘোড়া ছুটিয়ে আসমুদ্র হিমাচল ঘুরেছেন; ভারত বা ইন্ডিয়া নয়; হিন্দুস্তান প্রতিষ্ঠার হীন অভিলাষে।
ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে শুধু মুসলমানদেরই জবাই করেননি এই মোদি-শাহ রাজনৈতিক যুগল; তাদের এই নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন ও একে জটিল করে তোলার পরিণতিতে আসামের ডিটেনশান ক্যাম্পে হিন্দু নাগরিকদের মৃত্যু ঘটেছে; যাদেরকে রাষ্ট্রহীন করে; "বাংলাদেশে চইলা যাইতে" বলেছিলো মোদির সহমত ভাইয়েরা। ভারতের স্থানে স্থানে বিজেপির পাণ্ডার হাতে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নিগৃহীত হতে থাকে দলিতেরা। মোদির ভারত বর্ণবৈষম্যের এক বিষাদ সিন্ধু যেন।
মোদি যখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রেমে আলুথালু হলেন; ভারতের অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা হুঁশিয়ার করেছিলেন, এমেরিকা যার বন্ধু; তার শত্রু লাগে না।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কাশ্মীর সমস্যার সমাধান প্রায় করে ফেলেছিলেন; পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফের সঙ্গে বসে। ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে পূর্ণ মুক্তি দিয়ে জাতিসংঘের অধীনে তাদের স্ব-নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে পারেনি মোদির আগমনের কারণে।
ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক বাহিনী নিজেদের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে; একে অপরের ভূখণ্ডের মধ্যে ঢুকে নাশকতা করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক দাতা ও অর্থ সংস্থা গুলোর চাপে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের ভুতের নৃত্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
মোদি তখন একক অভিনয়ের নায়কের মতো মিথ্যাবাদী রাখাল হয়ে যান। একা একাই নিজের ওপর হামলার নাটক করেন; একা একাই পাকিস্তানের ওপর "সার্জিক্যাল হামলা"-র কৃতিত্ব সাজাতে চান। রিপাবলিক টিভি আর অর্ণব গোস্বামীদের মতো অনৈতিক সাংবাদিকেরা সেই মিথ্যাচারকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের টিভির কলতলা টকশোতে পৌঁছে দেন।
মোদি এক সকালে কল্পনায় বারাক ওবামা হয়ে পড়েন; ওবামা যেমন ভোটে জিততে আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের এবোটাবাদে ঢুকে হত্যার কৃতিত্বে এমেরিকাকে আবার গ্রেট করে তুলেছিলেন; মোদিও তেমনি পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে কী যে ঘোড়ার ডিম করলেন; কতগুলো গুগল ছবি আর গ্রাফিক্সের ফুটেজ নিয়ে; রিপাবলিকান টিভির "আশার সওদাগর" অর্ণব গোস্বামী ওবামার মতো হেসে হেসে মোদির সিন্ধু বিজয়ের আলাপ করেন।
পরে দেখলাম ভারতে দুর্নীতি করে কেনা লক্কড়-ঝক্কড় যুদ্ধ বিমান চালাতে গিয়ে বেচারা অভিনন্দন পাকিস্তানে ধপাস করে পড়ে গেলেন। পাকিস্তানে যেহেতু সেই ওল্ড স্কুল পরিবারতন্ত্রের বাতিল নেতারা ক্ষমতায় নেই; সেনাবাহিনীর আর সামর্থ্য নেই বিনাকারণে ভারতকে গিয়ে শিং দিয়ে ঢুস দেয়ার। ইমরান খান অতটুকু শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রী; যতটুকু শিক্ষিত হলে; ওটুকু কমনসেন্স থাকে যে, পারমানবিক শক্তিধর ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ মানে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় কেয়ামত হয়ে যাওয়া।
মোদির ব্যক্তিগত আচরণে শিষ্টাচার না থাকায়; তার রাজনৈতিক পার্টনার অমিত শাহ'র মুখের লাগাম না থাকায়; দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে মাত্র পাঁচবছরে শত্রু বানিয়ে ফেললো ভারত। অথচ ভারতের মানুষ অত্যন্ত সামাজিক-শিষ্টাচারসম্পন্ন-একবার বন্ধু হলে সারাজীবন বন্ধু থাকার মতো মানুষ।
ভারতের যে নাগরিক সমাজ পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের সঙ্গে "শান্তির আশা" আঙ্গিকের মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে "যুদ্ধ নয়; বন্ধুত্ব" এই চিন্তার শুভেচ্ছা দূত হয়ে উঠেছিলো; তাদের জন্য পরিস্থিতি জটিল করে তোলেন মোদি। নাগরিক সমাজের যে কোন সদস্য পাকিস্তানে গেলেই মোদির সহমত ভাইয়েরা তাকে পাকি-পাইক্কা গাদ্দার ইত্যাদি "সুচিন্তার ধারাপাত" বলতে শুরু করলো।
ভারতের চলচ্চিত্র পাকিস্তানে প্রদর্শিত না হওয়ায়; পাকিস্তানের সিনেমাগুলো রাতারাতি কবরস্থানে পরিণত হয়। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানকে হত্যা করে মোদি মাংসের কারবারে রক্তের হোলি খেলতে চেয়েছেন।
মায়ানমারের রোহিঙ্গারা যখন অন সান সুচি ও তার সামরিক জান্তার গণহত্যার মুখে জীবন বাঁচাতে ভারত সীমান্তে এসেছিলো; মোদি তখন তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে; তাদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন। আর অমিত শাহ নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের জোশে বাংলাদেশীদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করে বসে।
চীনের উহানে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মোদির সপ্তম শ্রেণী ফেইল করা ভক্তরা; চীনের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষের এসিড গঙ্গা বইয়ে দেয়। চীন তখন "আই হেইট চীন লেখা" টুপি-গেঞ্জি বানিয়ে ভারতের বলদায়তনে বিক্রি করে।
নেপাল সিদ্ধান্ত নেয়, আর মোদির দাদাগিরি তারা সহ্য করবে না। একবিংশে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধার। এর আগে কেরোসিন শিখা মোদি নেপালের মাটির প্রদীপকে বলেছিলো, ভাই বলে ডাকো যদি দেবো গলা টিপে। হেনকালে আকাশেতে উঠিলেন ট্রাম্প চাঁদা; বিগলিত হয়ে কেরোসিন মোদি বলে, এসো মোর দাদা।
এই ট্রাম্প দাদা নিজেই "ওয়ার অন করোনায়" গো-হারা হেরে এখন "ট্রাম্প মৃত্যুঘড়ি"র দিকে তাকিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। ফলে মোদি বড্ড একা; চীনের হামলার মুখে। রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব হারিয়েছে ভারত মোদিরই কল্যাণে।
আত্মঘাতী মোদি যখন কাশ্মীর গণহত্যা শুরু করলেন; তখনই ভারতের অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধের আলোকিত নাগরিক সমাজ, ভারত ভাঙ্গনের আশংকা প্রকাশ করেন। এখন চীনের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় দৃশ্যত চেইকমেট ভারত।
কূটনীতিতে এগ্রেসিভ দাবা খেলায় এমন চেইক মেট হয়; এ কারণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিটিকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।
আমরা রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকার আর এর নাগরিককে আলাদা করে দেখি। গুজরাট ও কাশ্মীর গণহত্যার খলনায়ক মোদির পরিণতি যাই হোক; ভারতের নাগরিকদের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকতে চাই; মানুষের জন্য মানুষের শুভ প্রত্যাশায়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য