আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন ও আমার পর্যবেক্ষণ

রেজা ঘটক  

পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোটের চিত্র একদিনেই বদল হয়নি। বাংলার মানুষ গেরুয়া শিবিরকে বহিরাগত আখ্যা দিয়ে সত্যিই রুখে দিয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণে যাবার আগে একটু পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোটের চরিত্রগুলো নিরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করা যাক।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৫২ সালের প্রথম বিধানসভায় জয় পেল কংগ্রেস। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় কংগ্রেস রাজত্ব করল। এরপর ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ছন্দপতন। এই ৫ বছরে দু'বার নির্বাচন হলো পঞ্চম ও ষষ্ঠ বিধানসভার। ১৯৭২ সালে আবার কংগ্রেস সরকার গঠন করলো। সবমিলিয়ে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় কংগ্রেসের দাপট ছিল।

এরপর ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলো। ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ৩৪ বছর রাজত্ব করলো বামফ্রন্ট। এরপর ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান। ১৫তম ও ১৬তম বিধানসভায় রাজত্ব করার পর এবার ১৭তম বিধানসভায় টিএমসি'র হ্যাটট্রিক বিজয়। আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস বা টিএমসি!

একটা বিষয় খুব ক্লিয়ার- বাংলার মানুষ একটি দলকে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় দেখে পরখ করতে চায়। দলটি বাংলার মানুষের ভাগ্য ফেরাতে কেমন তা নিক্তির হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায়। ভোটের রাজনীতিতে বাংলার মানুষের যেন কোনো তাড়াহুড়ো নাই। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই ৫ বছরে তাড়াহুড়ো করে তারা বুঝতে পেরেছিল- স্বল্পমেয়াদী সরকার রাজ্যের উন্নয়নের জন্য এবং মানুষের ভাগ্যের চাকা বদলের জন্য মোটেও কোনো কার্যকর পন্থা নয়। তাই ভোট আসলেই কোনো একটি দলকে আরও সুযোগ দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করায় বাংলার মানুষের এই প্রবণতা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেছে। তার মানে বাংলার মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসকে আরও কয়েকবার সুযোগ দিতে চায়।

একটা জিনিস খেয়াল করুন- বিগত ৭৪ বছরের ইতিহাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটের রাজনীতি মোটামুটি এরকম একটি চক্র অনুসরণ করেছে। সেই চক্রে এখন তৃণমূল কংগ্রেস বা টিএমসি-কাল চলছে। শুরুতে ছিল কংগ্রেস-কাল, তারপর বামফ্রন্ট-কাল আর এখন চলছে টিএমসি-কাল।

এবার আসুন বাংলায় রাজনীতিতে দলের উত্থান-পতনের ইতিহাসে। কংগ্রেসের উত্থানকালে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধীদলে বসতে বাধ্য হয়েছে। এরপর বামফ্রন্টের উত্থান-কালে কংগ্রেস চলে গেল বিরোধীদলে। তারপর ভেতরে ভেতরে কংগ্রেসের ভাঙ্গন থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান। আর ২০১১ সালে এসে টিএমসি ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হলো।

এবার খেয়াল করুন- টিএমসি'র উত্থানে কংগ্রেস চলে গেল তলানিতে আর বিরোধীপক্ষে রয়ে গেল বামফ্রন্ট। কংগ্রেস বাংলার রাজনীতিতে জিরোতে চলে যাওয়ায় বাংলায় যে ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়েছে, সেখানেই গেরুয়া শিবিরের উত্থান। বিগত ১০ বছরে ধীরে ধীরে গেরুয়া শিবির শক্তি সঞ্চয় করছে। ২০১৬ সালের মাত্র ৩টি আসন থেকে এবার এক ধাক্কায় সেটি ৮০তে উন্নীত হয়েছে। এই ধাক্কা ২০২৬-এ হয়তো তিন অংকের কোঠায় যাবে।

আর বাংলার ভোটের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই গেরুয়া শিবির যদি এভাবে এই শক্তিমত্তা নিয়ে দাপট দেখাতে থাকে, তাহলে ২০২৬ নয় বরং ২০৩১ সালে গেরুয়া শিবির বাংলায় ক্ষমতায় যেতে পারে! এটি আমার একটি হাইপোথিসিস মাত্র। কারণ ততদিনে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভুলগুলো বাংলার মানুষের কাছে আরও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। আরেকটা জিনিস খেয়াল করুন- কংগ্রেসের পর বামফ্রন্ট বাংলায় শূন্যের দিকে যাত্রা করেছে। বামফ্রন্টের এই যে কংগ্রেসের মত শূন্যের দিকে যাত্রা, এটা বাংলার ভোটের রাজনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরই ফলাফল।

এবার আসুন ১৭তম বিধানসভা নির্বাচনের ভোটের রেজাল্ট নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক। টিমএমসি খুব শক্তভাবেই বাংলার মানুষকে বোঝাতে পেরেছে যে গেরুয়া শিবির বহিরাগত। বাংলার রাজনীতিতে বহিরাগত তকমাটি গেরুয়া শিবিরের জন্য ভালো ফল আনতে পারেনি। বিজেপি বা গেরুয়া শিবিরের প্রধান তিন সেনানি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং যোগী আদিত্যনাথ, এই তিনজনকেই টিএমসি'র নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুইলচেয়ারে বসে একাই সামাল দিয়েছেন!

মহাভারতে অর্জুনের বাহক ছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। কর্ণের রথের চাকা মাটিতে আটকে গেলে সেই দুর্বল মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধনীতি ভঙ্গ করে কর্ণকে আক্রমণ করতে অর্জুনকে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। এবারের ভোটে মমতাজি বারবার হুইলচেয়ারে বসে হুংকার ছেড়েছেন- খেলা হবে! খেয়াল করুন- হুইলচেয়ারের সেই খেলা শেষে বিজয়ী মমতাজি কিন্তু হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন।

বাংলার ভোটে গেরুয়া শিবির কেন্দ্রের ক্ষমতার দাপট দেখাতে চেয়েছে, বাংলার মানুষকে চোখ রাঙানি দিয়ে ভয় দিতে চেয়েছে, নির্বাচন কমিশনে পর্যন্ত দাপট দেখিয়েছে, আর অর্থের লোভ দেখিয়ে বাংলার মানুষকে পকেটবন্দি করতে চেয়েছে। সেই খেলায় বাংলার মানুষ খুব একটা উৎসাহ পায়নি। কারণ বাংলার মানুষ এই রাজ্যের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে কাবু করতে দেয়নি। বাংলাকে গুজরাট হতে দেয়নি।

এখন আর সাদাকালো যুগ নেই। এখন রঙিন যুগ। রঙিন যুগে গেরুয়া শিবির বাংলাকে যেভাবে মৌলবাদের উত্থান হিসেবে ঘাঁটি করতে চেয়েছিল, বাংলার মানুষ সেটি ভেতরে ভেতরে বুঝতে পেরেছে। ফলে টিমএসি'র হাজারো দুর্নামকে তোয়াক্কা না করে গেরুয়া শিবিরকে রুখে দিয়েছে। খেয়াল করুন- মমতাজি'র উপর বাংলার মানুষের ১০ বছরের যে ক্ষোভ, তা নন্দীগ্রামে প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু তার দলকে বিজয়ী করে গেরুয়া শিবিরকে ঠেকিয়ে দিয়েছে।

এবার আসুন বামফ্রন্টের কথায়। বিগত লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের চরিত্র বাংলার মানুষ হারে হারে বুঝে ফেলেছে। টিএমসিকে হারাতে তারা তখন গেরুয়া শিবিরে নিজেদের ভোট দিয়েছে। অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে নিজের নাক কাঁটার মত ন্যক্কারজনক কাজ করেছে। এবারও সেই আশংকা থেকে মানুষ বামফ্রন্টকে আস্থায় নিতে পারেনি। বামফ্রন্ট বেশকিছু তরুণ নেতৃত্বকে এবার নমিনেশান দিয়ে মানুষকে ভোলানোর চেষ্টা করেছিল।

বিশেষ করে করোনা মহামারীতে তারা বেশ ভালোই ক্যাম্পেইন করেছিল। জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বাংলার মানুষ ভোটের রাজনীতিতে একবার বিশ্বাসভঙ্গ হলে তাকে আবার বুকে তুলে নিতে অনেক হিসাব নিকাশ করে। ফলে বামফ্রন্টের এই ভরাডুবি টিমএমসি 'র ভোট নষ্ট করেনি বরং গেরুয়া শিবিরে যে ভোট যেতে পারতো তা রুখে দিয়েছে। ফলে আখেরে বামফ্রন্ট টিএমসিকে ক্ষমতায় রাখতে মমতাজি'র হুইলচেয়ারের শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা পালন করেছে। এজন্য নিশ্চয়ই টিএমসি বামফ্রন্টকে একটা বড় ধরনের ধন্যবাদ দিতেই পারে।

আবার বামফ্রন্ট যখন আব্বাসের মত একটি অতি-ডানপন্থী দলকে শরিক করেছে, তখন মানুষ আর বামফ্রন্টকে বিশ্বাস করেনি। লোকসভার মত তারা তলে তলে তারা গেরুয়া শিবিরেও ভেগে যেতে পারে, এরকম আস্থাহীনতার কারণে বামফ্রন্টকে ভোটাররা একদম পাত্তাই দেয়নি। ফলে বামফ্রন্ট এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের মত চরম ভরাডুবিতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

আরেকটা বিষয় খুব খেয়াল করার মত- বামফ্রন্টের নেতারা মনে করেন বাংলার মানুষ তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে চরম ভুল করেছে। অথচ নিজেদের ভুলগুলো নেতাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে। উল্টো তারা জনগণকেই দোষারোপ করে বেড়াচ্ছেন, যা বাংলার মানুষ মোটেও ভালো নজরে নেয়নি। কারণ লোকসভা নির্বাচনেই বামফ্রন্টের ভেলকি দেখে মানুষ তাদের উপর আস্থা হারিয়েছে।

ফলে চূড়ান্ত লড়াইটা হয়েছে সরাসরি টিএমসি বনাম গেরুয়া শিবির। সেই লড়াইতে বাংলার জনগণ চিরায়ত অভ্যাসমত টিএমসি'র উপর আরও ৫ বছরের জন্য আস্থা রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, অমর্ত্য সেনদের বাংলায় গেরুয়া শিবিরের উত্থানকে কঠোরভাবে রুখে দিয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকীর দিনে তাই বাংলার মানুষেরই জয় হয়েছে। টিএমসি'র কাছে বামফ্রন্টের যেমন ধন্যবাদ পাওনা, তেমনি বাংলার মানুষকেই সবচেয়ে বড় ধন্যবাদ দিতে হবে টিএমসি'র। তাই নরেন্দ্র মোদিজি'র সুরে সুর মিলিয়ে মমতাজিকে অভিনন্দন জানাতে চাই। জয় বাংলা।

রেজা ঘটক, সাহিত্যিক, নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ