প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সূচনা হয়েছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমানা লঙ্ঘন করে একাধিক এলাকা দিয়ে রাশিয়ার বাহিনী অগ্রসরমান, ইতিমধ্যেই এই হামলায় যুক্ত হয়েছে বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী। ওডেসার বন্দরে রাশিয়ার সৈন্যরা অবতরণ করেছে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুটি এলাকা – যেখান রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ২০১৪ সাল থেকে দখল করে আছে তাদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রাশিয়া এই যুদ্ধের যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করছে। রাশিয়ার এই আচরণ কেবল যে আন্তর্জাতিক আইনের নগ্ন বরখেলাফ তাই নয় ১৯৯৪ সালের একটি স্মারকের বরখেলাফও। ১৯৯৪ সালে ইউক্রেন যখন তার হাতে থাকা সব ধরনের পারমানবিক অস্ত্র ধ্বংস করে নন-প্রলিফিরেশন অব নিউক্লিয়ার উইপেন ট্রিটি বা পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার নিয়ন্ত্রণ যুক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হয় সেই সময় একটি স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাতে স্বাক্ষর করেছিলো ইউক্রেন, রাশিয়া, ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র। বুদাপেস্টে ৫ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সই করা এই স্মারকে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিলো যে তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হবে না।
মাত্র ৬ অনুচ্ছেদের এই স্মারকের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিলো “রাশিয়ান ফেডারেশন, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকি বা বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের বাধ্যবাধকতা পুনর্ব্যক্ত করছে, এবং তাদের কোনও অস্ত্রই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা বা জাতিসংঘের সনদের আওতায় গৃহীত ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনও কারণে ব্যবহার করা হবে না” (ইংরেজি ভাষ্য -The Russian Federation, the United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland and the United States of America reaffirm their obligation to refrain from the threat or use of force against the territorial integrity or political independence of Ukraine, and that none of their weapons will ever be used against Ukraine except in self-defence or otherwise in accordance with the Charter of the United Nations.)। রাশিয়ার আগ্রাসন সেই চুক্তির বরখেলাফ এবং ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। যারা রাশিয়ার এই আগ্রাসনের পক্ষে কথা বলছেন তারা এই স্মারকটি পাঠ করতে পারেন। এই চুক্তিতে কোথাও বলা হয়নি যে, ইউক্রেন চাইলে ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবেনা। ফলে রাশিয়া এবং তার সমর্থকরা নিশ্চয় এটা বিস্মৃত হবেন না যে, বড় এবং শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতিবেশীদের জন্যে এই আগ্রাসন কী বার্তা পাঠাচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার এই আগ্রাসনের ফল কেবল ইউক্রেন বা ইউরোপ ভোগ করবে বলে যারা মনে করছেন তারা আগামীকাল বিশ্ব বাজারের দিকে নজর রাখুন। এর আশু অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া আপনার ঘরে পৌঁছুতে দেরি হবে না। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে এর দীর্ঘমেয়াদী ফল হচ্ছে সারা বিশ্বে অস্থিরতার নতুন যুগের সূচনা হলো। আর এই যুদ্ধে, যে কোনও যুদ্ধের মতোই, যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শুরু হলো তা শিগগির শেষ হবে না।
বস্তুত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ইউক্রেন বৈশ্বিক আলোচনায় আসে ২০১৩ সালের দিকে। ওই বছর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সরকার ইউক্রেন-ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি স্থগিত করে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘ইউরোমাইদান’ নামে বিক্ষোভ দানা বাঁধে। এই বিপ্লবটা ইয়ানুকোভিচের উৎখাত এবং একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করে। ২০১৪ সালে ইয়ানুকোভিচের পতনের পর ভলোদিমির জেলেনস্কি ক্ষমতায় আসেন। প্রসঙ্গত, ইয়ানুকোভিচ রাশিয়াপন্থি, অপরদিকে জেলেনস্কি অনেকটা পশ্চিমা-ঘেঁষা মার্কিনপন্থি হিসেবে পরিচিত। ২০১৪ সালে জেলেনস্কি ক্ষমতায় আসার পরে রাশিয়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তবে ইয়ানুকোভিচের পতনের পর জেলেনস্কি ক্ষমতা এলেও বিদ্রোহীদের দমনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হয়। বিশেষ করে পশ্চিম অঞ্চলে দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক এলাকায় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যায় সরকার এবং বিদ্রোহীরা। এই বিদ্রোহীদের শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছিল রাশিয়া। ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া ঘিরে রাশিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব অনেক বেশি। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে পানি ও বন্দরের বিষয়টি। ক্রিমিয়ার সেভেস্তাপোল বন্দরটি বাল্টিক সাগরে রাশিয়াকে প্রবেশ এবং সারা বছর উষ্ণ গরম পানি পাওয়ার উৎসের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তবে বাল্টিক সাগরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে রাশিয়া। বন্দর ছাড়াও ক্রিমিয়া প্রায় ২০০ বছর রাশিয়ার অংশে ছিল এবং সেখানকার জনগণ জাতিগতভাবে রুশ। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের হাতে হস্তান্তর করে। তখন নিশ্চয়ই ভাবনায় ছিল না, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেতে পারে এমনকি রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। এ ছাড়া ন্যাটোর মতো সামরিক জোটের সদস্য হওয়ার চেষ্টা করতে পারে ইউক্রেন।
অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়ায় পরমাণু শক্তির পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো গ্যাস। সমগ্র ইউরোপের তেল এবং গ্যাসের চাহিদার ২৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাটভিয়া, এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো গ্যাসের জন্য শতভাগ রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। জার্মানির ৫০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। এই ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাস সরবরাহের জন্য ইউক্রেনকে প্রবেশদ্বার বলা হয়ে থেকে। রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৪০ শতাংশ পাইপলাইন গেছে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে। তাই ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া বিকল্পভাবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে জার্মানিতে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পকে অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। কারণ, ভবিষ্যতে রাশিয়া গ্যাসকে ইউরোপে রাজনৈতিক প্রভাবের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ইউক্রেন ঘিরে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের নিজেদের আন্তর্জাতিক প্রভাব ধরে রাখার জন্য পশ্চিমা এবং রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতের বিষয়টি দেখছে বিশ্ব এবং বিশ্ব সংস্থা। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে ইউক্রেনে যুদ্ধ না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তবে, মস্কো কোনো কিছুই গ্রাহ্য করছে না। কারণ, যেভাবেই হোক তাদের ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে। গণমাধ্যমের বরাতে জানা যাচ্ছে, কিয়েভে মুহুর্মুহু আক্রমণ চালাচ্ছে রাশিয়া। এমনকি ইউক্রেনের দাবি, রাশিয়া তাদের রাজধানী কিয়েভে রকেট হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে ন্যাটো থেকে পূর্ব ইউরোপে স্থল এবং বিমানবাহিনী বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ইউরো-আটলান্টিক সাগরের নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনী মোতায়েন করতে যাচ্ছে পশ্চিমা গোষ্ঠী। যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কায় লাখ লাখ মানুষ ইউক্রেন ত্যাগ করে সীমান্তবর্তী এলাকা বা পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাচ্ছে। ইউক্রেনকে ঘিরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেন বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে!
রাশিয়ার এই আক্রমণ ঘিরে যেমন একদিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে তেল ও জ্বালানির দাম হু হু করে বাড়ছে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এটি খুব দ্রুত ১১০ ডলার ছাড়াতে পারে। এরই মধ্যে রুশ মুদ্রা রুবলের দাম দ্রুত পড়ছে। ৬ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে লেনদেন স্থগিত করেছে মস্কো এক্সচেঞ্জ। এছাড়াও বিশ্ববাজারে অস্থিরতার পাশাপাশি মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পূর্ব ইউক্রেনে মানবিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, ইউক্রেনে দ্রুত মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এ জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোকে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য দ্রুত সীমান্ত খুলে দেয়ার আহ্বান জানায় সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক রেডক্রস সংস্থা-আইসিআরসিও মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনীয়দের নিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে ফিনল্যান্ড।
এরই মধ্যে রাশিয়ায় যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন করে মানবাধিকারকর্মীসহ অন্তত ১৬৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। অধিকারকর্মী মারিয়া লিটভিনোভিচ বলেছেন, মস্কোসহ ২৪টি স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন দেশটির ৫০০ সাংবাদিক-বিজ্ঞানী। পাশাপাশি এতে সংহতি জানিয়ে বহু সরকারি কর্মকর্তাও সই করেছেন।
ইতিহাস কারও অজানা নয়। রাশিয়ার একেবারে আঙিনায় অবস্থিত ইউক্রেনে প্রবেশের সুযোগ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে কৌশলগত এক বিরাট সুবিধা দেবে। কিন্তু এ উদ্বেগের নিরসন ঘটাতে পুতিন 'দুর্বল' প্রতিবেশীর ওপর রীতিমতো যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে দেশটাকে দখল করে নেবে- এটা কোনো যুক্তিতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা মনে করি, এখানেই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে জন্ম নেয়া জাতিসংঘের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। সংস্থাটির উচিত অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমরা একই সঙ্গে ইউক্রেন সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকেও সমর্থন করি। আমরা ইউক্রেনে যে সহস্রাধিক বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন তাদের দ্রুত উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য