প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. শামীম আহমেদ | ২৮ মার্চ, ২০২২
আমেরিকার হুমকি-ধমকিতে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয়নি চায়না, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চায়নার প্রেসিডেন্ট সি জিংপিং-এর মধ্যকার অনুষ্ঠিত ভিডিও কনফারেন্সের পর দুই দেশের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া থেকে অন্তত তাই মনে যাচ্ছে। পুরো উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপকে মোটামুটি নিজের নেতৃত্বে এনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্ভবত ভেবেছিলেন চায়নাকেও এই সুযোগে তিনি কাবু করতে পারবেন। রাশার উপর ক্রমাগত অর্থনৈতিক ও সামরিক চাপ প্রয়োগ করে তাদের সবচেয়ে নিকটতম রাজনৈতিক বন্ধু চায়নাকেও যে কিছুটা চাপে প্রয়োগ করা যাবে না– এটা সম্ভবত ভাবতে পারেনি মার্কিন কূটনীতিকগণ। জো বাইডেনের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে চায়নার প্রেসিডেন্ট পরিষ্কার করে বলেছেন তার দেশ ইউক্রেন থেকে সরে আসার জন্য রাশার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কোন চাপের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবে না। শুধুমাত্র তাই নয় চায়নার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী লে ইউচেং পরেরদিন দ্ব্যর্থহীনভাবে মন্তব্য করেন যে ইউক্রেনের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী আমেরিকা ও ন্যাটোর পূর্বমুখী দাপট বিস্তারের চেষ্টা, যা নিশ্চিতভাবেই রাশার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি আরও বলেন ন্যাটোর মাধ্যমে আমেরিকার প্যাসিফিকের পূর্বমুখী আধিপত্য বিস্তারের যে অপপ্রয়াস সেটি তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই ঝুঁকি তৈরি করবে। তিনি সাথে এও যোগ করেন আমেরিকার দাবি অনুযায়ী রাশার উপর কোন ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারি করার কোন পরিকল্পনা ও ইচ্ছা তার দেশের নেই।
আমার কাছে মনে হয়েছে ইউক্রেনের উপর রাশার সাম্প্রতিক আগ্রাসনে প্রথমদিকে আমেরিকা বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দুর্বল নেতৃত্ব ও নানা সময়ে মিডিয়াতে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে এর দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে তারা। চায়নার উপর এই সময়ে কূটনীতিক চাপ প্রয়োগের ভাল সম্ভাবনা থাকলেও বাইডেন শুরুতেই কোন আলোচনায় না গিয়ে দাম্ভিকভাবে তাদের হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করেন, যা চায়নার মতো পরাশক্তির পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। বরঞ্চ বাইডেন যদি এই সময়ে চায়নার সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে সম্পর্ক দৃঢ় করার চেষ্টা করতেন, তাতেই বরঞ্চ পশ্চিমা বিশ্বের বেশি লাভবান হবার সম্ভাবনা ছিল। যদিও রাশার ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরবর্তী অবস্থায় চায়না উদ্বেলিত এমনটা ভাবার কোন অবকাশ নেই, কিন্তু বাইডেনের বিদ্বেষমূলক আচরণের কারণে চায়নার রাশার পক্ষে থাকার সিদ্ধান্তই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হওয়া স্বাভাবিক। যদিও পশ্চিমা মিডিয়া ইউক্রেনে রাশার সামরিক অভিযান তাদের পরিকল্পনা মতো হচ্ছে না বলে ক্রমাগত রিপোর্ট করে বিশ্বের কাছে রাশার সামরিক শক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছে মনে হচ্ছে, কিন্তু আদতে বিষয়টি কী তা বলা মুশকিল। যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তির দেশ আমেরিকা যুগের পর যুগ চেষ্টা করেও ভিয়েতনাম, ইরাক বা আফগানিস্তানে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে, সেখানে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তির দেশ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশা মাত্র এক যুদ্ধে জয়ী হবে– এই ধারণাটির বহুল প্রচারও যে আমেরিকার গোয়েন্দাবাহিনীর ভাবনাপ্রসূত নয়, সেটি চিন্তা করার কোনও কারণ নেই। আমেরিকা যখন কোন দেশের সাথে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয় না, তখন তারা তাদের শক্তিশালী মিডিয়া ও গোয়েন্দাবাহিনীর মাধ্যমে নানারকম মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে এটি তো আর অজানা কিছু নয়। এখানেও যে তাই হচ্ছে না সেটি বলা যাবে না। এটি নিশ্চিত যে আপাতত দৃষ্টিতে রাশার সামরিক অভিযানে চায়নার কিছুটা বিব্রত হবার সম্ভাবনা আছে বলেই মনে হচ্ছে। ইউক্রেনে রাশার সামরিক অভিযানের আগে চায়না-রাশাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যতটা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ জোট বলে মনে হচ্ছিল, এখন তার চাইতে অনেকটাই কম শক্তিশালী মনে হচ্ছে। এটি সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক সামরিক মেরুকরণে রাশা ও চায়নার বিপক্ষে যেতে পারে।
এদিকে অনেকেই বলছেন রাশার উচিত ছিল তার সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউক্রেনের দখল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে, কিন্তু সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এখন পশ্চিম ইউক্রেন দখলে না নিলেই বরঞ্চ রাশার জন্য বিপদ। ন্যাটোর সদস্য না হওয়াতে ইউক্রেনের ভিতর অভিযান চালাবে না বলে আমেরিকা যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে কূটনৈতিক পরিপক্বতার নিদর্শন রয়েছে। কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পোল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে ন্যাটোর সদস্যরা ইউক্রেনে যত অস্ত্র সরঞ্জাম কিংবা যোদ্ধা পাঠাক না কেন, আন্তর্জাতিকভাবে তা অস্বীকার করা সহজ হবে তাদের জন্য। ইতিমধ্যে আমেরিকা ও ন্যাটো যে বিপুল পরিমাণ সামরিক সাহায্য ঘোষণা করেছে তার বেশিরভাগ যে পোল্যান্ড সীমান্ত দিয়েই ইউক্রেনের ভেতরে ঢুকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়াও রোমানিয়া, হাঙ্গেরি সীমান্ত দিয়েও সামরিক সাহায্য পৌঁছুতে পারে ইউক্রেনে। তাই পশ্চিম ইউক্রেনও যে রাশা এখন দখলে নিতে চাইবে এটিই স্বাভাবিক। সার্বিকভাবে রাশার ইউক্রেন অভিযান খুব দ্রুত শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। রাশার পক্ষে চায়নার সাম্প্রতিক অবস্থান ইউরোপের অনেক দেশকেও এখন আগের চাইতে একটু সতর্কাবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। আমি মনে করি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যদি এই মুহূর্তে চায়নাকে উস্কে না দিতেন তাহলে হয়ত রাশা ও ইউক্রেনের পক্ষে দ্রুত একটি সমঝোতার দিকে যাওয়া সহজ হতো। কিন্তু চায়নাকে উস্কে দিয়ে রাশার পক্ষে পরিষ্কার অবস্থান নিতে বাধ্য করিয়ে আমেরিকাই ইউক্রেনে যুদ্ধাবস্থার অবনতি ঘটালো। তবে এই কাজ যে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে করেছে তা মনে হয় না। আদতে এই যুদ্ধে সবচেয়ে উপকৃত হচ্ছে আমেরিকা, তাই তারা মিডিয়ার সামনে যাই বলুক না কেন নানাপক্ষকে নানাভাবে উস্কে দিয়ে বা পুরষ্কৃত করে যুদ্ধে সংযুক্ত রাখার তাদের যে চেষ্টা, তা অব্যাহত থাকবে।
সার্বিকভাবে আমেরিকার এই আগ্রাসী ভূমিকা চায়না আর রাশার বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করবে বলে মনে হচ্ছে। রাশার কৃষি ও খনিজ সম্পদে যে বিশ্বব্যাপী দাপট, তার অন্যতম সুবিধাভোগী চায়না। রাশার তেল-গ্যাসই শুধু নয়, গম ও ভুট্টার মতো কৃষিজ দ্রব্য, এলুমিনিয়াম ও প্যালাডিয়ামের মতো খনিজ সম্পদ ছাড়া আগামী কয়েক যুগ চায়নার পক্ষে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এছাড়াও রাশার সীমান্তবর্তী নর্দার্ন সমুদ্রপথ ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে চায়নার পণ্য পরিবহন ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যাবে। এই সমুদ্রপথ রাশা-চায়নাকে ইউরোপের উপর সামরিক প্রতিনিধিত্ব করারও একচ্ছত্র সুযোগ করে দিয়েছে যা চায়না কোনভাবেই হারাতে চাইবে না। তাছাড়া, ইউক্রেনের উপর রাশার দাবি যদি চায়না অস্বীকার করে, তবে ভবিষ্যতে তাইওয়ানের উপর তাদের যে দাবি, সেটির বাস্তবায়নে তারা একদমই একা হয়ে পড়তে পারে। চায়না খুব ভাল করেই জানে যে রাশার সাথে নানা কারণে তাদের জোট দীর্ঘমেয়াদী হবে তা সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা দুর্বল প্রতীয়মান হলেও। কিন্তু রাশার বিরুদ্ধে যেয়ে আমেরিকার সাথে জোট বাঁধা যে যেকোনো পরাশক্তির জন্যই আত্মহত্যার শামিল তা খুব ভাল করে জানে চায়না। আমেরিকার সাথে জোটবদ্ধ ইংল্যান্ড, জার্মানির মতো দেশগুলো রাশা যুদ্ধে একদমই দুর্বল ও নগণ্য প্রতীয়মান হবার মূল কারণ আমেরিকা ন্যাটোর মাধ্যমে তাদেরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। চায়না কখনও চাইবে না কোনভাবেই আমেরিকার সাথে আপাতত বন্ধুত্ব করতে যেয়ে দীর্ঘমেয়াদে নিজস্ব পরিচয় ও দাপট হারাতে।
সার্বিকভাবে তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশা-চায়নার কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক আরও জোরদার হচ্ছে। ইউক্রেনে রাশার আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে আমেরিকার চায়নাকে দূরে সরিয়ে নেবার যে কূটচাল, তা আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য