আজ শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

জি-২০ সম্মেলন ও ভারত-বাংলাদেশের চাওয়া-পাওয়া

জুয়েল রাজ  

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্প্রতি ত্রিদেশীয় সফর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সর্বোচ্চ চর্চিত বিষয়। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং আগামী নির্বাচন ঘিরে এই সফর নিয়ে রাজনীতির মাঠ, টেলিভিশনের পর্দা পত্রিকার পাতা সব জায়গায় ব্যাপক আলোচনা চলছে। সেই আলোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি কূটনৈতিকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল করার ঘোষণা। আর এর সবকিছুই আলোচিত হওয়ার মূল কারণ আগামী জাতীয় নির্বাচন।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব কূটনৈতিক সম্পর্কে বিভিন্ন মেরুকরণ ঘটছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার মত ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলছেন। দিনদিন সেই বিষয়গুলো আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। নতুন মেরুকরণে রাশিয়া-চায়না বলয়কে বাংলাদেশ হয়ত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

এর বাইরে আমরা যতোই অস্বীকার করি বাংলাদেশের ভারতকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। তেমনি বাংলাদেশকে ও ভারতের অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। যে দলই রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকুক, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মেরুকরণ সব সময় ভিন্ন হয়। ভৌগলিক কারণও সেখানে একটি বড় ভূমিকা রাখে হয়তো।

আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৮তম জি-২০ সম্মেলন। বিশ্বের ১৯টি ধনী দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়ে জি-২০ গঠিত। সদস্য দেশগুলো হলো আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। আঞ্চলিক সংস্থা হিসাবে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সেই জোটে বাংলাদেশ নেই। তবুও জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশ থাকছে।

প্রথা অনুযায়ী, এ সংগঠনের সভাপতি বেশ কিছু দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বিভিন্ন বৈঠক ও শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশ, মিশর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে সভাপতি হিসেবে ভারত অতিথি দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ বাংলাদেশে যাকে ভারত সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এই আমন্ত্রণ বাংলাদেশের জন্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য অবশ্যই সম্মানের।

ভারত সভাপতি হিসাবে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশকে ২০২৩ সালের জি-২০ প্রক্রিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এটা বাংলাদেশকে আজকের দিনের বড় ইস্যুগুলো, সেটা খাদ্য এবং জ্বালানি নিরাপত্তা কিংবা পরিবেশের জন্য জীবনযাত্রা কিংবা নারীর নেতৃত্বে উন্নয়ন, সব ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ হওয়ার এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।

শুধু তাই নয়, এই জি-২০ সম্মেলনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারপ্রধান হিসাবে এই সরকারের শেষ আনুষ্ঠানিক বৈঠক। তাই দুই দেশেরই বেশ কিছু ইস্যু সেখানে গুরুত্ব পাবে। বিশেষ করে দুই দেশের নির্বাচনেই সেই বৈঠক প্রভাব ফেলবে। পশ্চিমা চাপে ভারতকে পাশে চায় বাংলাদেশ শিরোনামে গত ১০ মে আনন্দবাজার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে উল্লেখ করেছে, সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফর ঘিরে বাংলাদেশ আসলে কী চাইছে ভারতের কাছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে ইইউ, ব্রিটেন, জাপান বাংলাদেশের গত বারের নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে সমালোচনা করছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ চাইছে, বন্ধু দেশ হিসাবে ভারত কূটনৈতিক ভাবে ওই দেশগুলির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলুক। ঢাকার বক্তব্য, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নেতৃত্ব ভারতের হাতে, তাই পশ্চিমের কাছে নয়াদিল্লির বক্তব্যের গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান আগেই এই সম্মেলনকে বয়কট করেছে, সর্বশেষ ১৯ মে চীন জি-২০ সম্মেলন বয়কট করেছে, কারণ হিসাবে কাশ্মিরে জি-২০ সম্মেলন আয়োজনকে উল্লেখ করেছে দুই দেশ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, হিমালয়ের নিকটে অবস্থিত কাশ্মির, ভারত এর অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাকি অর্ধেক পাকিস্তানের অধীনে। যদিও উভয় দেশই পুরো কাশ্মিরকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মির নিয়ে তিনবার লড়াই করেছে। কিন্তু মোদি সরকার পাকিস্তান চীনকে পাত্তা না দিয়েই এই সম্মেলন কাশ্মিরে সম্পন্ন করবেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে কাশ্মির নিয়ে এবং আর্টিকেল ৩০৭ নিয়ে আর কোন সমালোচনা থাকবে না। এই একটিমাত্র ইস্যু মোদি সরকারের আগাম নির্বাচনে ভারতে বাজির তাস হবে। এই বাজি খেলেই বাজিমাত করতে চাইছেন মোদি। আর সেখানে প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে পাশে চাইছে।

কিন্তু শেখ হাসিনা কি শুধু দূতিয়ালী সাহায্যই চাইবেন ভারতের কাছে? তা মনে হয় না। ভারতের সাথে যে ইস্যুগুলো বহুল আলোচিত তার মধ্যে রয়েছে সীমান্ত-হত্যা ও তিস্তার পানির হিস্যা। যদিও তীরে এসে তরী ডুবার মত করে তিস্তা ইস্যুটি পশ্চিমবাংলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর এক তরফা বিরোধিতার কারণে আর চূড়ান্ত আলোর মুখ দেখে না।

ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের সমীকরণ বড় অদ্ভুত। রাষ্ট্র এবং সরকারের দেনদরবার, লেনাদেনা চলে এক পথ ধরে, আর সাধারণ মানুষের আবেগ চলে আরেক পথ ধরে। ভারত নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভিতর এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকেই নানা রকম ভাবে প্রচার প্রোপাগান্ডা চলে আসছে, ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস করতে চায়। আওয়ামী লীগ দেশটাকে প্রতিদিন একবার করে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে৷ দেশটাকে শেষ করে দিছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশ ভারত নিয়ে যাবে। অথচ ভারতীয় ভিসার জন্য প্রতিদিন মাইলের পর মাইল মানুষ লাইন ধরছে। চিকিৎসা, ভ্রমণ এমনকি ঈদ, পূজা বিয়ের শপিং করতে লোকজন ভারতে দৌড়ায়। এই সমীকরণ মেলানো কঠিন। ভারতকে বয়কট করার কথা কেউ ভাবতে পারে না। আর বাস্তবতাও তাই। কারণ আওয়ামী লীগ বিরোধীদের সবচেয়ে বড় বিদ্বেষ হচ্ছে ভারত বিদ্বেষ। আর উদাহরণ হিসাবে বারবার এই মানুষ হত্যা আর নদীর পানির বিষয়টি সামনে চলে আসে। এই ভারত বিরোধিতা মোকাবেলায় ভারতকে সেই দুইটি বিষয়ের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে।

সীমান্তে মানুষ হত্যা এবং তিস্তার পানির ইস্যু সমস্যার সমাধান ও আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য বাজির তাস হবে। জি-২০ সম্মেলন শেখ হাসিনার জন্য তুরুপের শেষ তাস হবে। কারণ, চলতি সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের বাংলাদেশ ভাবনা নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে সেসব আলোচনায় জল ঢালতে এই জি-২০ সম্মেলন বিরাট ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সেই সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন। ভারত শেখ হাসিনাকে সেখানে সম্মানিত করে সেই দরজাটা খোলে দিয়েছে।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৮ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন