প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ০১ জুন, ২০২৩
তুরস্কের নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এরদোয়ান পেয়েছেন ৫২ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট। আর প্রধান বিরোধী জোটের প্রার্থী কেমাল কিলিচদারওলু পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট। এতে এরদোয়ান বেসরকারি প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।
২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এরদোয়ান। ২০১৬ সালে তাঁর বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে তুরস্কে জরুরি অবস্থা চলছিল। পরে বিতর্কিত এক গণভোটে জয়লাভ করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ান এরদোয়ান। ওই গণভোটে প্রেসিডেন্ট শাসিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বাতিল হয়ে যায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। এরদোয়ান আবার দায়িত্ব পাওয়ায় পর থেকে বিলুপ্ত হয় প্রধানমন্ত্রী পদ।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পরাজয়ের পর, বিরোধী দলের নেতা মুহাররেম ইনজি বলেছিলেন, ‘এই সংবিধানের মাধ্যমে বিপজ্জনক একদলীয় শাসন কায়েম হলো। ২০১৪ সালে তুরস্কে নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়। সে সময় থেকে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে ভোট দিতে পারে মানুষ। দুই হাজার ষোলো সালে বানচাল হয়ে যাওয়া এক সেনা অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রীর পদ বাতিল করেন এবং ব্যাপক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন।
এরদোয়ানের সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নগরায়ণের ওপর উল্লেখযোগ্য জোর দিয়েছিল। সেতু, বিমানবন্দর, মহাসড়ক এবং উচ্চ-গতির রেলপথ নির্মাণের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলো শুধু দেশের অভ্যন্তরে যোগাযোগ এবং পরিবহনের উন্নতি করেনি বরং তুরস্ককে বাণিজ্য ও পর্যটনের একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসাবে স্থান দিয়েছে। এই উদ্যোগগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। প্রচুর সংখ্যক তুর্কী নাগরিক দেশটিতে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির জন্য এরদোয়ানকেই দায়ী করেন। এরদোয়ানের আরেক সমস্যা ছিল সিরিয়ান শরণার্থী। সিরিয়াকে নিয়ে তুরস্কের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হলো তুরস্ক থেকে কয়েক লাখ সিরিয়ান শরণার্থীকে ফেরত পাঠানো আর সীমান্ত থেকে কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পিছু হটানো। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখন শরণার্থী সংকট বড় একটা সমস্যা হয়ে উঠেছে। শরণার্থীদের নিয়ে সেখানে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। সব মোকাবেলা করে, এক সময় 'ইউরোপের রুগ্ন মানুষ' হিসেবে তিরস্কৃত তুরস্ককে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম ক্রীড়নকে পরিণত করেছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। আরেকটি মজার বিষয় হলো তুরস্ক ১৯৫২ সালে ন্যাটোয় যোগ দেয়। এবং এই জোটে যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা হচ্ছে তুরস্কের। অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এরদোয়ান ন্যাটোকে একপাশে রেখে তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছেন।
সিরিয়া সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ, মৌলবাদ তোষণ এইসব কারণে পশ্চিমা বিশ্ব কোনভাবেই চায়নি এরদোয়ান আবার ক্ষমতায় আসুক। এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই, সব কিছু মোকাবেলা করেই চতুর্থবার ক্ষমতায় এসেছেন এরদোয়ান। এরদোয়ানের বিজয়ের পর ইউরোপ, আমেরিকা রাশিয়া সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
তাহলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা নয় কেন? ইউরোপের রুগ্ন মানুষ খ্যাত তুরস্ককে বিশ্ব রাজনীতিতে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এরদোয়ান। আর বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' থেকে মধ্যম আয়ের দেশে দাঁড় করিয়েছেন শেখ হাসিনা। বরং এরদোয়ানের চেয়ে হাজার গুণ বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল শেখ হাসিনার।
বাংলাদেশের এই দ্রুত উন্নয়নের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যু মোকাবেলা দুইটাই সমান্তরাল ভাবে চালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সাজা নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং এর রায় কার্যকর করা। জঙ্গিবাদ নির্মূল করা, মাদক নিয়ন্ত্রণ করা। যা এরদোয়ানকে মোকাবেলা করতে হয়নি। সারা পৃথিবী অর্থনীতি করোনায় মুখ থুবড়ে পড়লেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে পেরেছিল। অবশ্যই সেই ক্ষেত্রে প্রবাসীদের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনার সমস্যা হচ্ছে, উনি পশ্চিমাদের চোখে চোখ রেখে এখন কথা বলেন৷ দরিদ্র বাংলাদেশে হাজার বাধা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সব কিছু খুব শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন।
তাই পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা চায় না শেখ হাসিনার সরকার আগামীতে বিজয়ী হউক। কারণ তারা চায় বাংলাদেশ তাদের হাতের পুতুল হয়ে নাচুক। তাদের দয়া দক্ষিণায় গৃহপালিত হউক। সেই শংকার কথা প্রকাশ্যে সংসদে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই ব্যক্ত করেছেন বেশ কয়েকবার। বাংলাদেশের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, পশ্চিমা বিশ্বও সোচ্চার হচ্ছে। আগে তো বিদেশী রাষ্ট্রদূতগণ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সরাসরি মতামত ব্যক্ত করতেন। সেই জায়গা থেকে এখন সরে এসেছেন। সেই সাহস আর করেন না। এই প্রেক্ষাপট কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে। বরং গণতন্ত্র, মানবাধিকার, এরদোয়ানের চেয়ে শতগুণ এগিয়ে শেখ হাসিনা। তিনি সংবিধান এর ভিতরে থেকেই নির্বাচন প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছেন। সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন কিংবা কাটাছেঁড়া করার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নেই। সংবিধান পরিবর্তন করে এরদোয়ানের মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত করেননি। আগামী নির্বাচনও সেই সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হবে।
সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে আমেরিকার নতুন ভিসানীতি। আমেরিকা কারো বন্ধু হলে, তার আর শত্রুর প্রয়োজন নেই। একটা প্রবাদ আছে, "গরীবের সুন্দরী বউ সকালের ভাবি"; বাংলাদেশের অবস্থা ও তাই। গরীবের বউ সকলের ভাবির মতো, আমেরিকাও একটু ফুর্তি করছে।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থনের অংশ। মার্কিন নতুন ভিসা নীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত অঙ্গীকারের প্রতি জোরালো সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা করেছে সরকার।
মার্কিন ভিসা নীতি কিন্তু কোন দল বা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেনি, তারা বলছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে, বা সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করবে, সহিংসতা করবে, যারা নির্দেশ দেবে, তাদেরকে ভিসা দেবে না। তাই বিগত দুই নির্বাচন পর্যালোচনা করলে ভিসা নীতির খড়গ নামবে বিএনপির উপর। আওয়ামী লীগ সংবিধান মেনেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিবে। এখন যারা সংবিধান মেনে নিয়ে নির্বাচনে আসবে না, সহিংসতা, জ্বালাও পোড়াও করবে, বরং তারাই সেই ভিসা নীতির আওতায় পড়বে। বরং এই ভিসা নীতি আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পথটি সহজতর করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বারবার বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহবান জানাচ্ছে। বিএনপি বারবারই বর্জনের পথে চলছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এই কাজ শুধু বাংলাদেশ নয়, উগান্ডা, সোমালিয়া নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দিয়েছে, কিন্তু কোথাও সময় সেটি কার্যকর হয়নি, বা প্রভাব পড়েনি। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ব্যক্তিগতভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল আমেরিকা। সেই আমেরিকাই তাঁকে আবার দাওয়াত দিয়ে গলায় মালা পরিয়েছে।
শেখ হাসিনা তাঁর অবস্থান খুবই পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন। তিনি নিজেও জানেন যুক্তরাষ্ট্রের 'গুডবুকে' তিনি নেই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকেও তাঁর গুডবুকের তালিকায় রাখেননি। আমেরিকা মূল যে চাপটি প্রয়োগ করতে চাইছে তা, যতটা না নির্বাচন ঘিরে, তারচেয়ে বেশি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা। বাংলাদেশ তার পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়া এবং ভারতকে হাতছাড়া করবে না কোনভাবেই, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল মাথা ব্যথার কারণ সেখানেই।
শেখ হাসিনাও নিশ্চয় এইসব মোকাবেলা করেই একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারও বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য