প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শ্যামলাল গোসাঁই | ১০ নভেম্বর, ২০২৩
গাজায় হামাসের হামলার জের ধরে ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর ফিলিস্তিনি নিধন অভিযান শুরুর এক মাস পূর্ণ হয়ে আজ আরও একদিন অতিবাহিত হলো। বিশ্ব ইতিহাসে না হলেও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এই সময়টি নিদারুণ একটি কালো ক্ষত হয়ে থাকবে। ফিলিস্তিন ইসরায়েলের এই যুদ্ধের পরিণতি কোনদিকে যাবে তা এখনি নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কিন্তু, এরমধ্যেই গাজায় চার হাজার আটশোর বেশি শিশুর হত্যা আলোড়ন তুলেছে বিশ্বে। বিশ্বের নেতারা আর চুপ করে থাকতে পারছেন না যেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস তো বর্তমান গাজা উপত্যকাকে শিশুদের কবরস্থান বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিক কিছু পত্রিকার খবরে বলা হচ্ছে- গাজায় এখন আর এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে শিশুদের নিরাপদে রাখা যাবে এবং যেখানে শিশুদের কবর নেই।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রসঙ্গ আসলেই শিশু হত্যার বিষয়টি সামনে চলে আসে। এর কারণও আছে। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী যতবার হামলা চালিয়েছে। নৃশংস এসব হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারাদের অধিকাংশই শিশু ছিলো। তবে, দুই হাজার তেইশ সালে শুরু হওয়া ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধে শিশু মৃত্যুর হার আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এজন্য, জাতিসংঘ মহাসচিবের মন্তব্যটি যে মিথ্যে নয় তা সহজেই অনুমান করা যায়।
সম্প্রতি আল জাজিরায় আমেরিকান নারী সাংবাদিক বেলেন ফার্নান্দেজ তাঁর এক কলামে লিখেছেন- গাজায় এখন যে ইসরায়েলি হামলা চলমান আছে, তাঁর নয় বছর আগে ২০১৪ সালে একই এলাকায় অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ নামের একটি সামরিক অভিযান (হামলা বললে ভুল হবে না) চালিয়েছিল। একান্ন দিন ধরে চলা সেই হামলায় দুই হাজার দুইশো একান্ন জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন। যাদের মধ্যেই শিশুদের সংখ্যাই ছিলো ৫৫১ জন! এরপর ২০২১ সালে গাজায় আরেকটি ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৬০ জন ফিলিস্তিনি শিশুর মৃত্যু হয়। যাদের মধ্যে এমন কিছু শিশুও ছিলো, যারা যুদ্ধাতঙ্কে ভুগছিলেন এবং এর জন্য ওই সময় তারা চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ইসরায়েলের চলমান হামলায় গেল এক মাসে ৪ হাজার ৮০০ শিশুর প্রাণ গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে এখন প্রতিদিন গড়ে ১৬০টি শিশু ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় মারা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গাজার ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ কমাতে চলমান সংঘাতে মানবিক বিরতি কার্যকর করা ‘জরুরি প্রয়োজন’ বলে জানিয়েছেন ডব্লিউএইচওর কর্মকর্তা ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডমেয়ার। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী কোনও পক্ষের কথায় কর্ণপাত করছে না। শুধু ইসরায়েল কর্ণপাত করছে না বললে ভুল হবে। আসলে আমেরিকাও আরব নেতাসহ বিশ্বের কোনো আহ্বানেই কর্ণপাত করছে না। বরং, সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী সাবমেরিনসহ আরও রণ উপকরণ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে আমেরিকা। তারা সরাসরি হুমকি দিয়ে আসছে, ইসরায়েলে ফিলিস্তিন ছাড়া লেবানন বা ইরান থেকে কোন হামলা করলে তারা তাদের জ্ঞাতিভাইদের উদ্ধার করতে রণাঙ্গনে নেমে যাবেন। এতে করে যুদ্ধবিরতি দূরে থাক আমেরিকা ও ইসরায়েলের মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম নিধনের বিষাক্ত নোংরা আকাঙ্ক্ষাই সামনে আসছে বেশি।
হামাস কর্তৃক গেল ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নৃশংস হামলাকে দীর্ঘসময় ধরে চলা অবরুদ্ধ শোষিত জীবনের একটি বাহ্যিক প্রকাশ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা এর জন্য রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরায়েলের ফিলিস্তিন বিশেষ করে গাজা উপত্যকা শাসনকে দায়ী করছেন। কিন্তু, ইসরায়েল হামাসের এই হামলার জের ধরে গোটা ফিলিস্তিন জাতীকে নিধনের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছেন। এবং সেটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ একাধিক মার্কিন নেতা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের শয়তান বলে কটূক্তি করছেন। তারা ইসরায়েলের হামলাকে প্রতিরোধ বলা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। তাদের এ কাজে সহযোগিতা করছে পশ্চিমপন্থী কিছু সংবাদ মাধ্যমও।
সবকিছু দেখলে আর পড়লে মনে হবে, আমেরিকা-ইসরায়েল মাথায়, কোমরে গামছা বেঁধে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে রণাঙ্গনে নেমেছেন! অথচ এটা যে প্রকাশ্যে মানবাধিকারবিরোধী একটি হামলা, এখানে অকাতরে শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে সে বিষয়ে কেউ কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছেন না। তারা শুধু পরিস্থিতি বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তো জাতিসংঘ মহাসচিবকে ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে কথা বলায় ইসরায়েলিদের সামনে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছে। হিউম্যান রাইটসের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সারাবছর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার ও তাঁর লঙ্ঘন নিয়ে গলা ফাটিয়ে আসলেও আজকে যখন ফিলিস্তিনে প্রতিদিন ১৬০টি শিশু হত্যার শিকার হচ্ছে তখন তারা নির্বিকার। তারা ইসরায়েলের সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা আমেরিকাকে বড় গলায় বলতে পারছে না- তোমরা এটা ঠিক করছো না। এটা স্পষ্টত যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার লক্ষ্যবস্তু এখন হাসপাতাল, শরণার্থীশিবির, ধর্মালয় সবকিছু। তারা গাজাকে এরিমধ্যে দুইভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। স্থল হামলা, বিমান হামলা জারি রেখেছে। যেই শিশুগুলো মরে যাচ্ছে তাদের ব্যাপারে কোনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না ইসরায়েলকে! এটা যেন পৃথিবীর সবচাইতে দুঃসহ সময় ফিলিস্তিনিদের জন্য। তাদের সামনে তাদের সন্তানেরা রক্তাক্ত অবস্থায় পাখির মতো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। চোখের সামনে তাদের সন্তানেরা বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাদের চোখের সামনে তাদের সন্তানের শরীরের মাংসের দলা উড়ছে তারা দেখছেন কিন্তু দেখছে না শুধু বিশ্ববাসী। এই দৃশ্যগুলো চোখে পড়ছে না হিউম্যান রাইটস কিংবা আফ্রিকার নয়া ত্রাতা বিল গেটসের মতো মানববাদ নিয়ে চিন্তা করা মুখোশধারী সংগঠন বা ব্যক্তিদের।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো অনেকদিন ধরে পশ্চিমা সংগঠন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকর্তৃক বানানো মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ব্যাপারে একটি বিষয় লিখে আসছে ধারাবাহিকভাবে। সেটা হলো, পশ্চিমা দেশগুলো বা সংগঠনগুলো মুখে মুখে বিশ্বের পীড়িত অঞ্চলের মানবাধিকার নিয়ে কথা বললেও বা প্রচার করলেও আসলে তারা মূলত, পশ্চিমা সংস্কৃতি ও পুঁজিবাদকে বিস্তৃত করার লক্ষ্যেই কাজ করে যান। তারা সেইসব জায়গাকেই এসব বুলি আওড়ানোর জন্য বেছে নেন যেখানে পশ্চিমা স্বার্থ লাভের সম্ভাবনা থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর বা সংগঠনগুলোর অসহযোগী মনোভাবের পেছনে এটিও একটি কারণ। ফিলিস্তিনে আমেরিকার স্বার্থ ক্ষীণ। সেই তুলনায় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে থাকা আমেরিকার স্বার্থে অনেক লাভজনক।
পশ্চিমা বিশ্ব ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর আক্রমণের জের ধরে গোটা ফিলিস্তিনি জাতীকে সন্ত্রাসী বলে প্রচার করছে। তারা ফিলিস্তিনের হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা বলে প্রচার করছে। আর ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংস হামলাকে প্রশংসনীয় এক প্রতিরোধ অভিযান হিসেবে দেখছে পশ্চিমা বিশ্ব। সারাবছর গণতন্ত্র আর মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা ভণ্ড আমেরিকান কূটনীতিবিদরা আপাতত মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কম বক্তৃতা করছেন। কারণ, তারা নিজেরাই যে এখন যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধগুলো করছে তা নিজেরাও জানেন বলেই হয়। আমেরিকার সাম্প্রতিক তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হলেও যেকোনো মূল্যে তারা মিত্র ইহুদিদের জয় চায়। এর সাথে জড়িয়ে আছে বাইডেন প্রশাসনের নির্বাচনী ঘাট পার হবার স্বার্থ।
ভূরাজনৈতিক এই স্বার্থ আর লাভ লোকসানের রেসে এখনো প্রতিদিন ফিলিস্তিনে ১৬০টি শিশু মারা যাচ্ছে কিন্তু আমরা নির্বাক বসে আছি এটাকে বিশ্ব মানবতার সবথেকে দুঃখজনক পর্ব বলে ধরে নেয়া যায়। যখন দুইটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র মিলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষে পুরো জাতীকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমরা দূর দেশে বসে সেই দৃশ্য দেখছি। আমাদের চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু পরক্ষণেই মুছে নিতে হচ্ছে আরেকটি মৃত্যুর খবর শুনে কাঁদবার জন্য!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য