প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান | ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩
৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত দেড় মাসে ইসরায়েল গাজা উপত্যকার উত্তর অঞ্চলে হিরোশিমার চেয়ে দেড়গুণ বেশি বোমাবর্ষণ করেছে। গাজার উত্তরাঞ্চলের সমস্ত কিছু গুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট গাজা উপত্যকার তিনদিকে ইসরায়েল এবং একদিকে ভূমধ্যসাগর। ইসরায়েল গাজার ভূমি বেষ্টন করে তিনদিকে ৪২ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে এবং ভূমধ্যসাগরের দিকে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে রেখেছে। গাজাবাসীর কোথাও যাবার উপায় নাই। পৃথিবীর সাথে তাদের যোগাযোগ রুদ্ধ। এজন্য এতদিন গাজাকে বলা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার। গত দেড় মাসের ব্যাপক বোমাবর্ষণের ফলে গাজা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবরস্থান। ধ্বংসস্তূপের নিচেয় শুধু অসহায় শিশু, নারী ও পুরুষের লাশ আর লাশ। কবর দেওয়ার কোনো যায়গা নাই, সুযোগও নাই। লাস দাফনের পানি নাই, কাফনের কাপড় নাই। ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ বের করার উপায় নাই। লাশের গন্ধে সেখানে টেকা দায়।
গাজার প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের সাথে ইসরায়েল সেনাবাহিনী বা আইডিএফ-এর যে অসম যুদ্ধ হচ্ছে, ব্যক্তিগতভাবে এটাকে আমি যুদ্ধ বলতে নারাজ। কীসের যুদ্ধ! গরাদে বন্দি ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, পীড়িত, অসহায় গুটিকয়েক আশ্রয়হীন, ভূমিহীন, অসহায়, শরণার্থী মানুষের সাথে কী করে একটা দেশের শক্তিশালী প্রশিক্ষিত আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হতে পারে? এটা যুদ্ধ না, স্রেফ গণহত্যা। গণহত্যাকে বৈধতা দেবার জন্য এটাকে যুদ্ধ বলা হচ্ছে।
৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের গাজা উপত্যকার উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ এই তিনদিকে ইসরায়েল এবং এই পুরো সীমানা ৪২ ফুট উঁচু অভেদ্য চওড়া দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ-পশ্চিমে মিশরের সাথে একটুখানি রাফাহ সীমান্ত আছে যা ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর। ইসরায়েলের পুরো সীমান্ত কয়েক লাখ আইডিএফ সেনা আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঘিরে রেখে ইচ্ছেমত নিরস্ত্র সাধারণ গাজাবাসীকে হত্যা করছে। পশ্চিম সীমান্তের ভূমধ্যসাগরে আছে ইসরায়েলি নৌবাহিনী, আমেরিকার দুটি বিমানবাহী রণতরী ও ১২ হাজার সৈন্য। আমেরিকা সেখানে একটা পরমাণু চালিত সাবমেরিন মোতায়েন করেছে। তাদের তৃতীয় আরেকটি যুদ্ধজাহাজ ভূমধ্যসাগরের পথে রয়েছে। এছাড়া আছে ফ্রান্স, স্পেন ও পশ্চিমা বিশ্বের আধুনিক রণতরী। বাইরের কোনো আক্রমণ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে এরা ইসরায়েলকে রক্ষা করছে।
আমেরিকার বিমানবাহী রণতরী থেকে অসংখ্য গোয়েন্দা দ্রোণ পাখির মতো গাজার আকাশে টহল দিচ্ছে এবং ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর কাছে তথ্য পাঠাচ্ছে। সে অনুযায়ী ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজার আকাশে উড়ে যাচ্ছে এবং গাজার ভূখণ্ডে অনবরত বোমা ফেলছে। গাজা উপত্যকার উত্তর সীমান্ত থেকে শুরু করে গাজার মাঝামাঝি পর্যন্ত ইসরায়েল ঘিরে ফেলেছে এবং এর মধ্যের অংশটুকু দখল করার জন্য স্থল ও বিমান হামলা চালিয়ে ভূখণ্ডটুকুকে মানবশূন্য করছে। এখানে তারা ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করবে।
ইসরায়েল ইচ্ছা করলে গাজায় রকেট হামলা চালাতে পারে কিন্তু তাতে পুরো ভূখণ্ড পরবর্তীতে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের জন্য সমান হবে না, সমান করার জন্য তারা আকাশ থেকে বোমা ফেলে ভূখণ্ড সমান করছে। বলা হচ্ছে ইসরায়েল এ পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি সাধারণ গাজাবাসীকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে অধিকাংশই শিশু ও নারী। আহত হয়েছে ৪০ হাজারের বেশি। গত ২১ মাসে ৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে যে সাধারণ নাগরিক হতাহত হয়েছে, ২৩ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত গাজার এ সাধারণ জনগণ হত্যার সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি। অথচ ইউক্রেনে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কিন্তু গাজায় মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না! বড় অদ্ভুত এই আমেরিকা, বড় অদ্ভুত এই পশ্চিমা বিশ্ব, বড় অদ্ভুত তাদের মানবাধিকারের বুলি!
হামাস সদস্যদের হত্যার নামে ইসরায়েল সাধারণ গাজাবাসীকে হত্যা করছে। হামাস গাজার একটি রাজনৈতিক দল এবং গাজা উপত্যকার নির্বাচিত প্রতিনিধি। হামাসের একটি সামরিক শাখা আছে যার নাম আল-কাসাম ব্রিগেড। হামাস ছাড়াও গাজা ভূখণ্ডে অন্যান্য আরও রাজনৈতিক দল আছে এবং সাধারণ মানুষ আছে। গাজাবাসী মানেই হামাস নয়। ইসরায়েল সাধারণ গাজাবাসীকে হত্যা করে হামাস হত্যার কৃতিত্ব নিচ্ছে এবং গণহত্যাকে বৈধ করছে। ইসরায়েলের সাথে সুর মিলিয়ে চলছে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব। হায়রে মানবতা ও মানবাধিকার!
জোর করে আটকে রাখা গাজাবাসীকে হত্যা করার জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে আমেরিকা ও পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর এতো আয়োজনের দরকার পড়ে না। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে গ্রেটার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যাটো, আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য বিস্তার করাই এর উদ্দেশ্য। এই অজুহাতে ইরানকে ধ্বংস করতে পারলে সেটা আরও বড় সাফল্য। এতে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যের জমিদারি পুরোপুরি নিষ্কণ্টক হয়। ইরান আক্রান্ত হলে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ ইরানের পক্ষে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। শিয়া, সুন্নি, কুর্দি, ওহাবি, হানাফি ইত্যাদি বিতর্ক এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে রাজা-বাদশা, আমির-প্রিন্স খেতাব চলে যাওয়ার ভয়ে সবাই আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষেই থাকবে।
ইসরায়েলের পাশে থাকা মুসলিম দেশ মিশর, লেবানন ও জর্ডান আমেরিকার একচ্ছত্র দালাল। শিয়া সমর্থিত লেবাননের রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহ লেবানন সরকার বিরোধী। লেবানন সংসদে তাদের ১৩টি আসন আছে। রাজনৈতিক দল হিজবুল্লার একটি সামরিক শাখা আছে যা ইরান সমর্থিত। সৌদি আরব চিহ্নিত মার্কিন দালাল, তুরস্ক ন্যাটো জোটে থাকার কারণে বিবৃতি-বক্তব্য দেওয়া ও কিছু খাদ্য-ঔষধ সহায়তা করা ছাড়া গাজার জন্য কার্যকর কোনো সামরিক সহযোগিতা করতে পারবে না। মিশরের অবস্থাও তাই। ওদিকে ফ্রান্স লেবাননের সরকারি বাহিনীকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সাহায্য ও সৈন্য পাঠাচ্ছে যেন তারা হিজবুল্লাহকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে।
গাজাকে মানবশূন্য করে গাজাবাসীকে মিশরের সিনা উপত্যকায় স্থানান্তর করে বর্তমান গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বসবাসের পরিকল্পনা চলছে। মিশর গাজাবাসীকে সিনা উপত্যকায় আশ্রয় দিতে রাজি নয়, শুধু এ কারণেই তারা উচ্চবাচ্য করছে। এছাড়া মুসলিম দেশগুলোর সাধারণ জনগণের চাপে সরকারগুলোকে লোকদেখানো বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কার্যকরভাবে তারা কোনো সামরিক সহায়তা করবে না।
সুড়ঙ্গের মধ্যে থেকে হামাস যোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকারের জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে বেশি সময় আধুনিক যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বহির্বিশ্বের কোনো শক্তিশালী দেশের সরাসরি সামরিক সহযোগিতা ছাড়া এভাবে টিকে থাকা সম্ভব না। একসময়ে এসব টানেলগুলো হবে মৃত্যুপুরী।
গাজায় কত মানুষ মারা যাচ্ছে তার প্রকৃত হিসেব আসলে নাই। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, ঔষধপত্র, ইন্টারনেট, টিভি চ্যানেল, রেডিও চ্যানেল সব বন্ধ করে গণহত্যা চালানো হচ্ছে, যেন কোনো খবর বাইরে না আসে। ইসরায়েল প্রথমে গাজার উত্তর অংশ জনমানবশূন্য করে খালি করবে, পরে দক্ষিণ অংশে একই কাজ করবে। সমগ্র গজায়ই ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করবে।
ইসরায়েল পশ্চিম তীরেও মানুষ হত্যা করছে। যদিও সেখানে কোনো হামাস নাই। পশ্চিম তীর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বলে আংশিকভাবে স্বীকৃত থাকলেও মূলত ওখানকার সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে। মাহমুদ আব্বাস একজন পুতুল প্রেসিডেন্ট মাত্র। পশ্চিম তীরের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে। ওখানে কোনো সামরিক বাহিনী নাই। একটা সিকিউরিটি ফোর্স আছে যা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। এসব সিকিউরিটি ফোর্সের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ সবকিছু ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি সিকিউরিটি ফোর্স আসলে ইসরায়েলের। এই পশ্চিম তীর থেকেও ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং হবে। সেখানেও ইহুদি বসতি স্থাপিত হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান দেশগুলো ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেরা দেশের মালিক হয়েছিল। ব্রিটিশ ও মার্কিনীদের দালালি করে তারা রাজা-বাদশা হয়েছিল এবং তাদের বংশধররা রাজা-বাদশা হয়ে বহাল তবিয়তেই আছে। আমেরিকা ও ব্রিটিশের দালালি করা এসব দেশের সহযোগিতায়ই ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পরাক্রমশালী হয়ে টিকে আছে। ওদের পরোক্ষ সমর্থনেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে এবং ওদের সমর্থনেই এক সময়ে গ্রেটার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য