আজ শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

সৌদি-ইরান বিরোধ : পাল্টে যেতে পারে ইউরোপের মানচিত্র!

রেজা ঘটক  

খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের ২০১৬ সালের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি শুক্রবার প্রখ্যাত সৌদি শিয়া ধর্মীয় নেতা শেখ নিমর বাকের আল-নিমরসহ ৪৭ জন কথিত সন্ত্রাসীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সৌদি আরব। শেখ নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর নতুন বছরে হঠাৎ করেই মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে এখন যুদ্ধ-যুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছে।

নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ইরানের রাজধানী তেহরানে সৌদি দূতাবাসে এবং মাশহাদে সৌদি কনস্যুলেট অফিসে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ ইরানি জনগণ। যার প্রতিবাদে ইতোমধ্যে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সৌদি আরবের বন্ধুরাষ্ট্র বাহরাইন ও সুদান। একই দিন আফ্রিকান দেশ জিবুতি ইরানের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। জর্ডান তার দেশে ইরানের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে।

এছাড়া ইরানের প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। যার জেদ হিসেবে ইরানে সকল ধরনের সৌদি পণ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ইরান। ঘটনা পরম্পরায় ৪ জানুয়ারি ইরাকে এক সুন্নি ইমামকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া, হামলা চালানো হয় দুটি সুন্নি মসজিদে। এতে মসজিদের এক মুয়াজ্জিন নিহত হন। বিবিসি জানায়, বন্দুকধারীর গুলিতে ব্যাবিলনের উত্তরে আলেক্সান্দ্রিয়ার একটি মসজিদের ইমাম নিহত হন। আর রাজধানী বাগদাদের ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে হিলা এলাকায় ও এর পাশের দুটি সুন্নি মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এদিকে ইরান অভিযোগ করেছে, ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ইরানি দূতাবাসে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়েছে। ইরান দাবি করেছে, এতে তাদের বেশ কয়েকজন দূতাবাসকর্মী আহত হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হোসাইন জাবের আনসারিকে উদ্ধৃত করে এ খবর জানায়।

যুদ্ধবিদ্রোহ মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের একটি স্থায়ী সংকট। যার নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাদার ইসরাইল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত শতাব্দির মাঝামাঝিতে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রের আবির্ভাব দিয়েই মূলত মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সর্বশেষ পর্বের সূচনা। ইসরাইল-ফিলিস্তিন নাটকের পর মধ্যপ্রাচ্যে অনেক তেল গড়িয়েছে। কিন্তু সংকটের কোনো সুরাহা হয়নি। বরং টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক হামলায় সেই সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট একচেটিয়া তেল ও অস্ত্র বাণিজ্য চালিয়ে নেবার জন্য নানান কিসিমের ফন্দি বের করে। একবিংশ শতাব্দির প্রথম দশকে সরকার পতনের নামে কথিত আরব বসন্ত বিপ্লবে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরো প্রকট হয়েছে। আরব বসন্ত বিপ্লবে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ব্যর্থ হবার পর, সেখানে গত পাঁচ বছর ধরে চলছে মার্কিন মদদপুষ্ট আসাদ বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি দলের গৃহযুদ্ধ। যে যুদ্ধে কমপক্ষে আড়াই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ আর উদ্বাস্তু হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।

মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে স্থায়ী করার পশ্চিমা কৌশলেই সৃষ্টি করা হয়েছে ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী যা সংক্ষেপে আইএস নামে পরিচিত। আইএস ইরাক ও সিরিয়ার একটি বিশাল অংশ দখল করে সেখানে ইসলামিক স্টেট ঘোষণা করেছে। দৃশ্যপটে হঠাৎ রাশিয়া আসাদের পক্ষে যোগ দেওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা কৌশল অনেকটাই কুপোকাত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে বিগত চার বছর মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট আইএস-এর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলেছে, সেটা ছিল স্রেফ নাটক। আসলে আইএস দমনের নামে গোপনে এতদিন মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট আইএস-এর কাছ থেকে কম মূল্যে তেল কেনার একটা বাণিজ্য করছে। আর আইএসকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা করছে সৌদি আরব, বাহরাইন, ইয়েমেন, কুয়েত, কাতার, তুরস্ক ও ইসরাইল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের মিত্র হওয়ায় এবং আসাদ সরকারকে প্রোটেকশান দেওয়ায় সিরিয়া সংকট এখন বিশ্ববাসীর কাছে মোটামুটি উন্মুক্ত।

মধ্যপ্রাচ্যে এখন একদিকে আসাদ সরকারের পক্ষে খোদ রাশিয়া, ইরান ও লেবাননের হিযবুল্লাহ গ্রুপ। অন্যদিকে আসাদ বিরোধী জোটে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটসহ সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরাইল ও তুরস্ক। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে কেবল ২০১৫ সালে দেশটি থেকে প্রায় ১১ লাখ মানুষ ইউরোপে পাড়ি জমায়। যাদের প্রধান অংশকে আশ্রয় দেয় জার্মানি। জার্মানি প্রায় পাঁচ লাখ সিরিয়ান উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে। সিরিয়া ইস্যুতে দীর্ঘদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বাটপারি করেছে। এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সেই একক তুঘলকিতে বাম হাত ঢুকিয়েছেন। এখন পুতিন যেভাবে চাইবেন সিরিয়া ইস্যু'র সেভাবে একটা সমাধান মেনে নেবার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। কারণ পুতিনের মাত্র কয়েকটি মিসাইল আক্রমণেই আইএস জঙ্গিদের প্রায় বারোটা বেজেছে। রাশিয়ার হামলায় আইএস সহ আসাদ বিরোধী জোটের ব্যাপক ক্ষতির কারণে স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন নেতৃত্বে একটা চপেটাঘাত লেগেছে। যে কারণে আমেরিকার দরকার ছিল সিরিয়া ইস্যুর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি সংকট। সৌদি আরবের শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকে কেন্দ্র করে সেই সংকট এখন তীব্রভাবেই আবির্ভূত হয়েছে সৌদি বনাম ইরানের যুদ্ধংদেহী অবস্থানে।

এমনিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের মধ্যে নানান ঘরানার গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, গোপনে তাদেরকে অস্ত্র-গোলাবারুদ দিয়ে এতদিন তেল বাণিজ্য করত। হঠাৎ সেখানে রাশিয়া একটি বড় ধরনের ভাগ বসানোর কারণে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। যে কারণে মার্কিনীদের নতুন আরেকটি সংকট খুব প্রয়োজনীয় ছিল। এবার মার্কিন মিত্র সৌদি আরব মার্কিনীদের সেই অস্তিত্ব সংকটকে বাঁচানোর একটা মোক্ষম দায়িত্ব নিয়েছে। যা মার্কিনীদের অন্তরে পুষে রাখা আসল কৌশলকে বাস্তবায়নের একটা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত করবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আর সেই গোপন অস্ত্রটি হল মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম শিয়া-সুন্নি স্থায়ী দ্বন্দ্বকে নতুন করে উসকে দেওয়া।

এমনিতে সৌদি আরবে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রায় ২০ লাখ মানুষ বসবাস করে। ২০০৯ সালে সৌদি পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের শিয়া অধ্যুষিত কাতিফ এবং আল-ইহসা অঞ্চলকে সৌদি আরব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিয়া অধ্যুষিত বাহরাইনের সাথে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন সৌদি শিয়া নেতা শেখ নিমর আল নিমর। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ নিমরের এই আহ্বানকে সৌদি সরকার হুমকি হিসেবে মনে করছে। কারণ সৌদি তেল ক্ষেত্রগুলোর একটা বড় অংশই এই শিয়া অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। আর তাই এ অঞ্চল সব সময়ই সৌদি রাজতন্ত্রের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ। ২০১১ সালে সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে যে ব্যাপক সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, সেই বিক্ষোভে জোরালো সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন শিয়া ধর্মীয় নেতা শেখ নিমর। দুই বছর আগে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শেখ নিমরকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারবিরোধী বিক্ষোভের কারণে গত বছরের অক্টোবরেই তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হয়েছিল। নিমরের ভাই দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করলেও আদালত তা খারিজ করে দেয়। এর আগে শেখ নিমরের দণ্ডাদেশ কার্যকর না করতে সৌদিকে সতর্কও করেছিল ইরান। ইরান তখন বলেছিল, নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে সৌদি আরবকে বড় খেসারত দিতে হবে।

একদিকে মার্কিন মিত্র সুন্নি প্রধান সৌদি আরব অন্যদিকে রাশিয়ার মিত্র শিয়া প্রধান ইরান। সৌদি আরব ইরান যুদ্ধ লাগলে সেই যুদ্ধে পশ্চিমাদের কে কোন পক্ষে যাবে তা অনেকটাই দৃশ্যপটে স্থির। ছলে বলে কৌশলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ন্যাটো জোট সৌদিদের সমর্থন যোগাবে। অন্যদিকে রাশিয়া ও তার মিত্ররা যেমন আসাদ ও হিযবুল্লাহ ইরানকে সমর্থন যোগাবে। এছাড়া শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ মানে গোটা মধ্যপ্রাচ্য সহ মুসলিম দেশগুলোকে যার যার পক্ষে টানার চেষ্টা করবে সৌদি আরব ও ইরান। ইতোমধ্যে গত সপ্তাহে সৌদি আরব ৩৪টি মুসলিম দেশকে নিয়ে একটি সামরিক জোট গঠনের উদ্যোগ নেয়। যেখানে ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানকে কৌশলে বাদ দেওয়া হলেও ইন্দোনেশিয়া এই সৌদি সামরিক জোটকে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু ভালো মত বুঝুক না বুঝুক সেই সৌদি টোপ গিলেছে। এমনকি সৌদি আরব ইস্যুতে সৌদি বন্ধুত্ব জাহির করতে নানান কিসিমের নিন্দাও জানাচ্ছে বাংলাদেশ।

মধ্যপ্রাচ্য সংকটের উল্টোপাশে এখন আরেকটি বিপরীত চিত্র ধরা পড়েছে ইউরোপে। সিরিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকার যুদ্ধ বিগ্রহে বিপর্যস্ত কয়েকটি দেশের কয়েক লাখ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে লিবিয়া, সিরিয়া, তুরস্ক থেকে ইউরোপে আশ্রয়ের জন্য নেমেছে। জাতিসংঘের হিসাবে ২০১৫ সালে দশ লাখেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপের মাটিতে এসে নেমেছে। তাদের ৯৫ শতাংশই এসেছে নৌকায় করে। এদের সিংহভাগই লেসবস ও কোস সহ গ্রিসের কয়েকটি দ্বীপে নামছে। তারপর গ্রিস থেকে বাসে, ট্রেনে, মহাসড়ক এমনকি ফসলের ক্ষেতে ধরে পশ্চিম এবং উত্তর ইউরোপ মুখী হাজার হাজার অভিবাসীর কাফেলা ইউরোপ জুড়ে এক নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। যে আতঙ্কে এখন খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিরো সিরার সম্প্রতি বলেছেন, ইউরোপ এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। কোন সমাধানে যদি দ্রুত একমত হওয়া না যায়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধ্বংসের সূচনা হবে। কিভাবে ইউরোপে অভিবাসীর এই স্রোত ঠেকানো যাবে, তার একটি রাস্তা খুঁজে বের করাটা এখন জরুরি।

কিন্তু গত এক বছরেও ব্রাসেলস থেকে ইউরোপীয় নেতারা ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে কোনও ফর্মুলা বের করতে সক্ষম হননি। এমনকি যে দশ-এগার লাখ মানুষ গত এক বছরে ইউরোপে ঢুকেছে, তাদের দায়িত্ব কে কতটা নেবে, তা নিয়েও এখনো কোনও ঐক্যমত্য হয়নি। ফলে এসব উদ্বাস্তু অভিবাসীরা যে দেশে যে রুট নিয়ে চলছে, সেই দেশ তাদের মত করে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। হাঙ্গেরি এবং মেসিডোনিয়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া উঠিয়ে অভিবাসীর স্রোত আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি দেখে ইউরোপের শীর্ষ নীতি নির্ধারণী পরিষদ ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক অভিবাসী সমস্যার পরিণতি নিয়ে তার উদ্বেগ জানিয়েছেন। সম্প্রতি ডোনাল্ড টাস্ক বলেছেন, অভিবাসী সঙ্কট ইউরোপকে বদলে দিতে পারে। যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমরা গড়েছি, শরণার্থী সমস্যার কারণে তা বদলে যেতে পারে। অভাবনীয় যেসব সাফল্য যেমন এতদিন শেঙ্গেন দেশগুলোর মধ্যে সীমান্তে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই যে চলাচল ব্যবস্থা ছিল, তা বরবাদ হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হল, এই সমস্যার কারণে ইউরোপের রাজনীতির মানচিত্র আমূল বদলে যেতে পারে।

১৯৯৫ সালে ইউরোপের ২৬টি দেশের মধ্যে পাসপোর্ট ছাড়া অবাধে চলাচলের লক্ষ্যে শেঙ্গেন চুক্তি হয়েছিল। যে চুক্তির কারণে ইউরোপের ২৬ দেশের নাগরিকরা পাসপোর্ট ছাড়াই এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবাধে যাতায়াত করতে পারত। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া সংকট ঘনীভূত হওয়ায় সেই শেঙ্গেন চুক্তি এখন ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। এতদিন এই শেঙ্গেন চুক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হতো। এদিকে জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়ামের পর চলতি সপ্তাহে সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে সুইডেন ও ডেনমার্ক। যে কারণে এখন উদ্বেগ বাড়ছে শরণার্থীর চাপে কি তাহলে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে আবার দেয়াল উঠতে শুরু করেছে?

ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর গবেষণা সংস্থা ওপেন ইউরোপের কর্মকর্তা নিনা শিক বলছেন, এখনও ইউরোপের নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, এসব পদক্ষেপ অস্থায়ী। কিন্তু আসল ব্যাপার হল ইউরোপে অবাধে চলাফেরা সুবিধা প্রচণ্ড হুমকিতে পড়েছে সন্দেহ নেই। এই সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ হল, শরণার্থীদের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত উদার যেসব দেশ যেমন জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপে ঢুকে প্রথমেই সেসব দেশেই অভিবাসীরা যেতে চাইছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেষ্টা করছে জোটের সমস্ত দেশগুলো যেন শরণার্থীদের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। আর তা নিয়েই বেধেছে সমস্যা। ইউরোপের অনেক দেশই শরণার্থীদের নেবার কথা মানতে চায় না।

এদিকে শেঙ্গেন চুক্তি রক্ষার জন্য নতুন করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তৈরি করতে যাচ্ছে ইউরোপীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। শেঙ্গেন চুক্তি অর্থাৎ ইউরোপের ভেতর অবাধ চলাচল অব্যাহত রাখতে এখন পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যৌথভাবে শেঙ্গেন চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সীমান্ত পাহারা দেওয়ার। যে লক্ষ্যে এখন একটি ইউরোপীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইউরোপের নেতারা এখনো যে প্রশ্নের কোনো জবাব জানে না সেটি হল, সাগরপথে রাবারের ডিঙ্গিতে করে আসা মহিলা-শিশুদের কি তারা ফিরিয়ে দেবে নাকি ডুবিয়ে দেবে? সীমান্তে পাহারা বাড়িয়ে দিলেই যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ অভিমুখে অভিবাসনের স্রোত বন্ধ করা যাবে, তা নিয়েও খোদ ইউরোপের ভেতরে অনেকেই সন্দিহান। তেমনই সন্দিহান জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান আন্তোনিও গুতেরেজ। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান আন্তোনিও গুতেরেজ বলেছেন, আমরা ইউরোপে যা দেখছি তা একটি গভীর সমস্যার উপসর্গ মাত্র। প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এত মানুষ একসাথে তাদের দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। কারণ, পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলে যুদ্ধ বিগ্রহের নাটকীয় প্রসার ঘটেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেই সংঘাত নিরসনের বা সংঘাত এড়ানোর সক্ষমতা হারিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, যে যুদ্ধ বিগ্রহের কথা মি গুতেরেজ বলেছেন, তা যে অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হবে বা প্রশমিত হবে তার কোনো লক্ষণ কিন্তু এখনো দেখা যাচ্ছে না। উল্টো নতুন করে সৌদি আরব ও ইরান যুদ্ধ লাগার মত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে সর্বশেষ যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তাতে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক অশান্তির আশঙ্কাই এখন দৃশ্যমান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবার অর্থ হল, ভবিষ্যতে লেসবস বা কোসের সৈকতে রাবারের ডিঙ্গি করে শরণার্থীদের স্রোতও হয়ত অব্যাহত থাকবে নতুবা আরো বাড়বে। সেক্ষেত্রে গত কয়েক দশক ধরে ইউরোপে যে ইর্ষর্ণীয় সমাজ, রাজনীতি, প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে, তাকে এই উদ্বাস্তু সমস্যা নতুন করে সমূলে নাড়া দেবে। যা ভেঙ্গে ফেলতে পারে গোটা ইউরোপেরই মানচিত্র। আর এই সংকট যতোই ঘনীভূত হবে, ততো দ্রুতই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজার আশংকা রয়েছে।

এমনিতে ইউরোপের শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে জার্মানি। গত এক বছরেই দেশটিতে দশ লাখের বেশি শরণার্থী আবেদন জমা পড়েছে। শরণার্থীদের এই অব্যাহত স্রোতের প্রভাব পড়ছে এখন জার্মানির সর্বত্র। ১৫ হাজার বাসিন্দা নিয়ে জার্মানির একটি ছোট শহর অ্যাবেন্সবার্গে আশ্রয় পেয়েছেন অন্তত দুইশো শরণার্থী। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। এতদিন লাল রঙের ছাদের ঘরবাড়ি আর চার্চের টাওয়ার, সাজানো রাস্তা আর দোকানপাটে অ্যাবেন্সবার্গ শহরটিকে সহজেই আলাদা করা যেত। কিন্তু শরণার্থীদের এই স্রোতে শহরটিও এখন বদলাতে শুরু করেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় এখন শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় দিতে নতুন বাড়িঘর তৈরিও শুরু হয়েছে। এমনিতে জার্মানির অ্যাবেন্সবার্গের মানুষ অনেকটা রক্ষণশীল। ফলে শরণার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি স্থানীয় বাসিন্দাদের সমর্থন বাড়ছে। ২০১৫ সালে জার্মানিতে রেকর্ড সংখ্যক শরণার্থী আবেদন পড়েছে। এই ঢল যদি এ বছরেও অব্যাহত থাকে, তাহলেও হয়তো শুধু অ্যাবেন্সবার্গ কেন, হয়তো গোটা জার্মানির চেহারাই বদলে যাবে। আর জার্মানির চেহারা একবার বদলে গেলে জার্মানি যে বাকি ইউরোপকে মোটেও স্বস্তি দেবে না, সেই ইতিহাস তো সবারই জানা। দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারিগর যে জার্মানি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া সংকটের সম্মানজনক সমাধান হওয়ার আগেই আবার নতুন করে যদি সৌদি আরব ও ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য সংকট আরো ঘনীভূত হবে। আর সেই সংকটের জের ধরেই পাল্টে যেতে পারে ইউরোপের হালচাল। সেক্ষেত্রে নতুন করে ইউরোপ অভিমুখে শরণার্থীদের ঢল বাড়বে। আর সেই শরণার্থীদের ঢল সামাল দিতে গিয়েই ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আর যা থেকেই সূচনা হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। কেননা গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া সফলভাবে হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। যাদের প্রধান টার্গেট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে নিশ্চিত ভাবেই ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারমানবিক সমঝোতা ভেঙ্গে পড়বে। আর সেখানে রাশিয়া নতুন করে ইরানকে সমর্থন যোগাতে পারে। যা মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে আরো গভীর খাদে ফেলতে পারে। শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে তেলের দাম বাড়বে। মাঝখান থেকে চোরাকারবারিদের থেকে সেই তেল কম দামে কিনবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু এর জের হিসেবে অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। যার খেসারত দেবে সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ লাগলে সেই ঝড় বাংলাদেশেও লাগবে। ইতোমধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি মসজিদে একজন শিয়া ইমামকে হত্যা এবং মোহররমের সময় শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার ঘটনায় সেই আলামত অনেকটাই প্রমাণিত। যে কারণে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যেকার সাম্প্রতিক বিরোধ যুদ্ধে রূপে নিলে তার প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী হবে। আর সেই দুর্ভোগ গোটা বিশ্ববাসীকেই ভোগাবে।

রেজা ঘটক, সাহিত্যিক, নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৮ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন