আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

পশ্চিমবঙ্গে ‘বামপন্থা’র বিজয়?

চিররঞ্জন সরকার  

সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মহাকাশে নতুন অধ্যায় রচনা করে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস৷

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে ভোটের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র যতটা গর্জেছিলেন, কার্যক্ষেত্রে ভোটবাক্সে দেখা গেল তার কিছুমাত্র বর্ষাল না! জোটের অন্যতম এই কাণ্ডারি স্বপ্ন দেখেছিলেন ২০০ আসনের। কিন্তু, জনতার রায়ে দু'শো দূর অস্ত, একশোর গণ্ডিও টপকাতে পারেনি জোট। নারায়ণগড়ে সূর্যকান্ত মিশ্রের সঙ্গেই ভরাডুবি হয়েছে বামেদের! তৃণমূল একক ভাবে লড়ে যেখানে ২১১টি আসন পেয়েছেন, সেখানে বাম ও কংগ্রেসের মিলিত আসন সংখ্যা ৭৬। বিজেপি-র দখলে এ বার তিনটি আসন। বাকি ৪টি পেয়েছে অন্যরা। এই চারটের মধ্যে তিনটিই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার।

পাঁচ বছর আগে পরিবর্তনের ভোটে প্রবল পরাক্রমী সিপিএম পার্টির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন এই মমতাই৷ এবার আক্ষরিক অর্থেই সূর্যকান্ত মিশ্রদের ‘ছাগলের তৃতীয় ছানায়’ পরিণত করলেন তিনি৷ তৃণমূল নেত্রী যখন ২১১ আসন নিয়ে বিধানচন্দ্র রায়কে ছাপিয়ে গেলেন, তখন বামেদের আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬৷ আর এবার বামফ্রন্ট (কথাটি অবশ্য এবারের ভোটে অনুচ্চারিত) ৩২৷ পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জেলা থেকে ধুয়ে-মুছে সাফ লাল পার্টি!

রাজ্যজুড়ে শুধুই সবুজ বিপ্লব৷ খানিকটা মুখরক্ষা কংগ্রেসের৷ সিপিএমকে নিজেদের ভোট হস্তান্তর না করে ডুবিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস৷ পক্ষান্তরে অবশ্য সিপিএমের ভোট পেয়েই তারা পেয়েছে ৪৪ আসন৷ গতবারের চেয়ে দু’টি বেশি৷ অর্থাৎ এই ফলাফলের জেরে বিধানসভায় সিপিএমের বিরোধী দলের মর্যাদাও আর থাকল না৷ চলে গেল কংগ্রেসের হাতে৷ বিজেপি এই প্রথম বিধানসভা ভোটে খাতা খুলল বাংলায়৷ তারা পেয়েছে তিনটি আসন৷ সব মিলিয়ে নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেছে, জোটকে কেন্দ্র করে এতদিন যা যা হয়েছে তা পুরোটাই ফাঁপা৷ বিশ্বাসযোগ্যতা, সংগঠন ও ভোটব্যাঙ্ক কিছুই নেই৷ ফলে ১৯ মে সকালে ভোটবাক্স খোলার পর থেকেই দেখা যেতে থাকে মমতা-ম্যাজিক৷ আবার স্পষ্ট হল, জনপ্রিয়তার নিরিখে মানুষের কোন মণিকোঠায় রয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী৷ লোকসভা ভোটের চেয়েও প্রায় ৬ শতাংশ ভোট বেড়েছে তৃণমূলের৷ অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ ভোট এককভাবে পেয়ে নজির গড়লেন মমতা৷

তৃণমূল কংগ্রেসের এই জয়ের সঙ্গেই আপাতত পশ্চিমবঙ্গে জোট রাজনীতির অধ্যায়ে ইতি পড়েছে। ৪৯ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে একদলীয় সরকার। আগামী ২৭ মে রেড রোডে যে সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। ১৯৬৭-র পর এই প্রথম কোনও একক দল বসছে পশ্চিমবঙ্গের মসনদে। প্রফুল্ল সেনের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হবেন সেই দলের মন্ত্রীসভার কাণ্ডারি।

মমতা ব্যানার্জি তথা ‘দিদি’র এই বিপুল বিজয় সত্যি বিস্ময়কর। অনেকেই বলছেন, এটা দিদির একক কারিশমা। জেদি, খ্যাপাটে, অসম্ভব পরিশ্রমী দিদি ক্লান্তিহীন ছুটে বেরিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। বলেছিলেন, ২৯৪টি আসনে তিনিই প্রার্থী। তাই ‘অভিমান’ থাকলেও মানুষ যেন ‘আশীর্বাদের’ হাত সরিয়ে না নেন! সেই কৌশলী কথাটাই ছুঁয়ে গিয়েছে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ! আগের থেকেও বেশি ভোট দিয়ে তাঁকে আশীর্বাদ জানিয়েছে আমজনতা!

কী ভাবে সম্ভব করলেন মমতা? বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগের অন্ত ছিল না। সারদা কাণ্ড ছিল, সিন্ডিকেট রাজ ছিল, শিল্পে বন্ধ্যা তথা কর্মসংস্থান না-হওয়া নিয়ে ক্ষোভও ছিল বিস্তর। তার ওপর ভোটের ঠিক আগে নারদা ছিল, উড়ালসেতু ভেঙে পড়া ছিল এবং বিরোধী ভোটের ভাগাভাগি রুখতে জোটও ছিল!

কিন্তু রাজনীতিকদের মতে, এই সব নেতিবাচক বিষয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে যে ইতিবাচক উপকরণ তার প্রথমটা অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিজে বামদের সব ভালো দিকগুলো আত্মস্থ করেছেন। খারাপগুলো বর্জন করেছেন। এর সঙ্গে নতুন কিছু উপাদান যোগ করেছেন। পুরানো বামফ্রন্টের সব কৌশল প্রয়োগ করেছেন। ফলাফল-তিনি এক ও অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছেন। তৃণমূল মানে মমতা। তিনিই প্রথম ও শেষ পুঁজি। দলে বেনোজল ঢুকলেও ব্যক্তি মমতার ওপর আস্থা টলেনি গ্রাম-শহরের বহু মানুষের। এবং সেটা আঁচ করেই ভোট প্রচারে দিদি বারবার বলেছেন, ‘আমি অন্যায় করলে ভোট দেবেন না।’ কিংবা, ‘আগে জানলে নিশ্চয়ই ভাবতাম।’ তাঁর সেই কৌশলটাই শেষমেশ তুরুপের তাস হয়ে উঠেছে।

তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নেওয়া মমতার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত। শহর ও গ্রামে রাস্তা তৈরির কাজ আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে। তস্য গ্রামের মধ্যেও এত দিন অবহেলায় পড়ে থাকা মোরামের রাস্তায় কংক্রিট-বিটুমিনের প্রলেপ পড়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আগের থেকে উন্নত হয়েছে। তা ছাড়া, প্রান্তিক মানুষের কাছে ব্যক্তিগত সুবিধা পৌঁছে দিয়েছেন দিদি। গ্রামের মানুষ ২ টাকা কেজি দরে চাল পেয়েছেন। পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা সাইকেল পেয়েছেন। ক্লাবে ক্লাবে অনুদান দেওয়া হয়েছে। ইমামরা ভাতা পেয়েছেন। বঞ্চিত হননি কীর্তনিয়ারাও। রাজ্যের যখন ভাঁড়ে মা ভবানী, তখন এই খয়রাতির অর্থনীতি নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু দিদির মা-মাটি-মানুষ এতেই খুশি। তারা প্রতিদান দিতে কার্পণ্য করেনি। তফসিলি জাতি ও উপজাতি এলাকা, সংখ্যালঘু শ্রেণি, আর্থিক ভাবে অনগ্রসর অংশে তৃণমূলের জনভিত্তি এ সবের জন্যই মজবুত থেকে মজবুত-তর হয়েছে। দিদির সাফল্যে ইন্ধন জুগিয়েছে বাম তথা জোটের ব্যর্থতা। বাম নেতারা অঙ্ক কষে বলছেন, গত লোকসভার তুলনায় শতাংশের হারে তাঁদের ভোট কমেনি। কিন্তু লোকসভা ভোটেই দেখা গিয়েছিল, বামেদের ছেড়ে বহু মানুষ চলে গেছেন বিজেপির দিকে। সেই ভোটার আর বামমুখী হয়নি। বিজেপির ভোট যা কমেছে, তা চলে গিয়েছে দিদির ভাঁড়ারে।

মানুষ মমতাকে সর্বাংশে হয়তো পছন্দ করেনি, কিন্তু বিকল্প হিসেবে বামেদের মেনে নিতে পারেননি । নতুন প্রজন্মের যে অংশ তৃণমূলকে পছন্দ করেননি, তাঁরাও ইভিএমে বাম প্রার্থীর দিকে না-তাকিয়ে নোটার বোতাম টিপেছেন। সন্দেহ নেই, জোট না হলে আরও শোচনীয় অবস্থা হতো বামেদের। দিদির আসন তখন আড়াইশো পেরিয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব ছিল না।

এই নির্বাচনের মাধ্যমে কী পশ্চিমবঙ্গে কোনো পরিবর্তন এসেছে? আনন্দবাজার পত্রিকার ভাষ্যমতে, পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন এলো না। ২০১৬ সালের ফল বলে দিল, ২০১১ সালেও পরিবর্তন আসেনি। বাঙালি বামপন্থী ছিল এবং আছে। পুরাতন বামপন্থা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় দফায় যে বামপন্থাকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করেছিলেন। বাঙালি সেই চেষ্টাকে ভাল চোখে দেখেনি। তাঁকে সরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রতিষ্ঠা করেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কায়মনোবাক্যে সনাতন বামফ্রন্টের বামপন্থায় হেঁটেছেন। সেই বামপন্থাই তাঁকে ক্ষমতায় এনেছিল, সেই বামপন্থাই তাঁকে আরও পাঁচ বৎসরের শাসনাধিকার দিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থীদের রাজনীতিটি কেড়ে নিয়েছেন। বামপন্থীরা যা করতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই করেন— অনুদানের অঙ্কে তাঁদের আলাদা করে চেনা যাবে না। মমতার বাড়তি সুবিধা, তাঁকে কোনও তামাদি আদর্শের ঝুলি বয়ে বেড়াতে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে আসবার আগে তাঁকে নিকারাগুয়া অথবা কিউবা ছুঁয়ে আসতে হয় না। তাঁর বামপন্থা ছিমছাম। তাঁর অনুদান আছে, কিন্তু তাত্ত্বিক বুলি নাই। তত্ত্বের চর্বিতচর্বণে বাঙালির অরুচি হয়েছে, কিন্তু অনুদানে নয়।

তবে মমতার এই বিপুল বিজয় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির জন্য কিছুটা শঙ্কাও তৈরি করেছে। একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের শঙ্কা। সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অবশ্য এটা মোটেই স্বস্তিদায়ক বার্তা বহন করে না। গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে শক্তিশালী বিরোধী শক্তি আবশ্যক। নচেৎ শাসকদলের মধ্যে এবং সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর একাধিপত্যের অহং পশ্চিমবঙ্গকে সংকটে ফেলতে পারে!আগামী দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানতম দায়িত্ব এই আশঙ্কাটিকে ভ্রান্ত প্রমাণ করা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ