আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘মহাপাপের’ পথে মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়!

চিররঞ্জন সরকার  

মিডিয়া আর শিক্ষার যুগপৎ অধঃপতন, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে যখন আমরা মেতে আছি, তখন পৃথিবীতে প্রথম বারের মতো আমেরিকার মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাস্তিকতা বিদ্যা চর্চায় একটি চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফ্লোরিডার এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী লুই আপিগনানি এর জন্য ২.২ মিলিয়ন ডলার অনুদান ঘোষণা করেছেন।

বারবিজোন আন্তর্জাতিক মডেলিং বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ৮৩ বছর বয়সী আপিগনানি ‘মানবতাবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের মানসে’ এই বড় অংকের অনুদান দিয়েছেন। আপিগনানি বলেছেন, আমি নাস্তিকদের বিরুদ্ধে বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করছি। নাস্তিকতা বৈধ করার পথে এই উদ্যোগটি পথ দেখাবে বলেও তিনি মনে করেন।

যখন দুনিয়া জুড়ে ধর্ম নিয়ে এক ধরনের অসহিষ্ণু আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে সেই সময় মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাস্তিক্য পড়াবার জন্য একটি অধ্যাপকের আসন সৃষ্টি করাটা কৌতূহলোদ্দীপক। এই পূর্ণ পাঠ্যক্রমটির নাম দেওয়া হয়েছে: ‘নাস্তিকতা, মানবতাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন।’ বহু বছর ধরে পরিকল্পনা হচ্ছিল আসনটি প্রতিষ্ঠার, নাস্তিক হিসেবে পরিচিত ধনকুবের লুই আপিগনানি অনুদান দিতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহস হচ্ছিল না সরাসরি ‘নাস্তিকতা’ শব্দটি ব্যবহারের। অথচ দাতার শর্তই ছিল, এটা ব্যবহার করতেই হবে, কারণ তিনি নাস্তিকদের প্রতি সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ কমাবার জন্যই এই অর্থ প্রদান করছেন।

আমেরিকায় নাস্তিকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০৭ সালে নাস্তিকরা ছিলেন মার্কিন জনসংখ্যার ১৬%, ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৩%, আর তরুণ-তরুণীদের ৩৫%-ই নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী বা ধর্ম নিয়ে আদৌ উৎসাহী নন।
অবিশ্বাসীরা ওয়াশিংটনে ‘যুক্তি মিছিল’ সংগঠিত করবার চেষ্টাও করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছেন, নতুন আসনটি নিয়ে অহেতুক উত্তেজিত হয়ে উঠবার কোনো কারণ নেই, ঈশ্বরের ধারণা ছাড়া চতুষ্পার্শ্বের পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করবার প্রয়াস বহু দিন ধরেই চলছে, এটা তার বিন্যস্ত গবেষণা মাত্র, এটা কোনো মতেই নাস্তিকতা প্রচারের যন্ত্র নয়।

আবার অনেক পণ্ডিত উৎফুল্ল হয়ে বলছেন, ধার্মিকতার সঙ্গে নীতিনিষ্ঠতা গুলিয়ে ফেলবার যে ঐতিহ্য রয়েছে, এটা তা ভাঙতে সক্ষম হবে। অবশ্য, অনেকে বলতে পারেন, ভাঙবার আগ্রাসী আকাঙ্ক্ষা থাকলে কেউ নাস্তিকতার ঝাঁঝ কমাতে সঙ্গে ‘মানবতাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ গুড়ে দেয় না!

নাস্তিকতাকে কেবল নাস্তি-তে সীমাবদ্ধ না রেখে, তার এক সুসংবদ্ধ ইতিহাস পড়বার অভ্যাস ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তৈরি করলে, নতুন ব্যাপার হবে সন্দেহ নেই। নাস্তিকতাকে অধিকাংশ সমাজে ও কালে মহাপাপ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তার্কিক, যুক্তিনিষ্ঠ, নাস্তিককে পরজন্মে শৃগাল হয়ে জন্মাতে হয়েছে, মহাভারতে এমন আখ্যান পাওয়া যায়।

ধর্মশাস্ত্রগুলিতে স্বাভাবিক ভাবেই নাস্তিকদের ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে। নাস্তিকরা অনেক দেশেই নিন্দিত। কিন্তু এটাও সত্য, যে কোনো দেশে কালে নাস্তিকতার অস্তিত্ব রয়েছে, প্রাচীন ভারতে চার্বাকপন্থী, লোকায়ত, সাংখ্যপন্থী মানুষেরা বেদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রাচীন গ্রিসে আদি নাস্তিক হিসেবে পরিচিত এপিকিউরাস ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে প্রাচ্যের মানুষ এসব কথাকে মোটে গ্রাহ্য করেনি। বরং নাস্তিকতাকে তারা ঘৃণা করে এসেছে।

এর আগে পিউ-এর এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে মোট জনসংখ্যার ৪০%-ই হবেন নাস্তিক, ইউরোপের ২৩%-এর কোনো রূপ ধর্ম নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে না। সমগ্র পৃথিবীতেই নাকি নাস্তিক্য বেড়ে গেছে ৩%, ধার্মিকতা কমেছে ৯%। ২০১০-এ, বিশ্বে ছিলেন ১.১ বিলিয়ন নাস্তিক, ২০৫০ সালে এই সংখ্যা ১.২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।

সমাজে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন আচরণ ও বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যুগে যুগে ঘটেছেও তাই। মানুষের মধ্যে বিশ্বাস যেমন স্বাভাবিক, অবিশ্বাসটাও অস্বাভাবিক নয়। মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাসের পৃথিবীর বাইরেও এক বিশাল পৃথিবী রয়েছে এবং তার প্রভাব বাড়ছে বলেই মনে হয়।

মিয়ামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাস্তিকতা অধ্যয়নকে ধর্মবাদীদের কাছে মহাপাপের পথে যাত্রা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এর বিপরীত মতও সমাজে একেবারে কম নয়। চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী মানুষেরা সব সময়ই মনে করেন, কোনো লেখার বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে লিখেই বলতে হবে। কারও বলার বিরুদ্ধে বক্তব্য থাকলে, তা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বলতে হবে- এটাই সভ্যতা; এটাই ধর্ম।

উদারনৈতিক ধর্মবাদীদের কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে, ধর্মে বলপ্রয়োগের কোনো স্থান নেই। জোর-জুলুম করে, ভয় দেখিয়ে, কুৎসা রটিয়ে বা খুন করে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। রক্ত, জিঘাংসা, প্রতিহিংসা কী কখনও ধর্ম প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হতে পারে? কাজেই আমাদের সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। পরমত সহিষ্ণুতা। কেবল সহিষ্ণুতাই পারে একটি হিংসাহীন প্রেমময় সমাজের ভিত্তি গড়তে। এমনকি ধর্মের সমাজ গড়তেও হিংসা কিংবা রক্ত নয়, বরং ক্ষমা ও ভালোবাসাই হতে পারে প্রধান নিয়ামক।

সূত্র: ইনডিপেনডেন্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ