আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আবারও কি মদদ জঙ্গিবান্ধব রাজনীতিতে

বিজন সরকার  

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনে ২৯৪টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের ‘জোড়া ফুল’ পেয়েছে ২১১টি আসন। কংগ্রেসের ৪৪ আর বামফ্রন্টের ৩৩ আসন মিলিয়ে বিরোধী জোটের সংগ্রহ ৭৭টি। মমতা বন্দোপাধ্যায় দ্বিতীয়বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন।  

২০১১ সালের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনটি ভারতের লোকসভার নির্বাচনের মতোই আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রে বিন্দুতে। ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে যখন ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মমতা ক্ষমতায় আসলেন, ঠিক তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিয়ে আমাদের মধ্যে কৌতূহল-উদ্দীপকতা বেড়ে যায়।

২০১১ সালের পর পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় জঙ্গি হামলা, সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি, তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনে বাংলাদেশের জামায়েত ইসলামের অর্থায়নের অভিযোগ, সারদার টাকা জামায়েত ইসলামের বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ এবং সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির টাকা জেএমবির মত জঙ্গি সংগঠনের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিনিয়োগের খবরাখবর পশ্চিমবঙ্গের উপর আমাদের আগ্রহ নতুন করে জন্ম দেয়।

মমতা ক্ষমতায় আসার পরই আমরা বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছি। বিশেষ করে তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে আমাদের আগ্রহ অনেক। কারণ মমতার বাঁধার কারণেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সেই চুক্তি করতে পারছে না। বাস্তবতা হল, মমতায় পক্ষে তিস্তা চুক্তি করা খুবই দুরূহ। আঞ্চলিক রাজনীতি ও ভোট-ব্যাংকের হিসাব এখানে বড় বিষয়। এবারও মমতা নানান উছিলায় বিষয়টিকে এড়িয়ে যাবেন।

মমতায় ক্ষমতায় আসায় বরং বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার কথা। আগামী কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় বছর খানিক থেমে থাকা জঙ্গিবাদ মাথা ছাড়া দিয়ে উঠবে। দিদির রাজের আই-এসের ঘাঁটি এবং একাধিক নাশকতার ছক জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএর হাতে। দুর্নীতি গ্রস্ত তৃনমূলের সাংসদদের বড় একটি অংশ আবারো জঙ্গিদের সাথে মোলাকাতে মেতে উঠবে। বাংলাদেশের উগ্রবাদ রাজনীতির কনসোর্টিয়াম প্রধান জামায়েত সাথে তৃনমূলের দ্বিতীয় পর্যায়ের হানিমুন শুরু হয়ে যাবে।

এইসব ধারনা একেবারেই অমূলক নয়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যদি তৃনমূলের রাজনীতির বেপরোয়া মনোভাব পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে এটি বিশ্বাস করতেই হবে যে তৃনমূলের ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য স্তুতির নয়। বরং দুচিন্তার।   

ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, ২০১২ সাল থেকেই বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীর আদর্শিক ছায়া জামায়েত ইসলামকে দেশের ভিতর অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরানের মাধ্যমে অর্থ লগ্নি-কারী প্রতিষ্ঠান সারদার কেলেঙ্কারির টাকা বাংলাদেশ জামায়েত ইসলামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে।   

বিষয়টি তদন্তের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে অভিযোগটি যে গুরুতর, তাতে সন্দেহ নেই। এসব বিষয় বন্ধু-প্রতিম ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল। তেমন গুরুতর না হলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মাথা ব্যথা হওয়ার কথা নয়।   

আহমেদ হাসান ইমরান ২০০১ সালে ভারতে নিষিদ্ধ মৌলবাদী সংগঠন ‘স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ (সিমি)-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মনে করে, সময়ের পরিক্রমায় সিমি বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে ভারত-বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। সিমির প্রাক্তন অনেক নেতারা এখন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে যুক্ত।  

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগও ইমরানের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে একই ধরনের রিপোর্ট করেছিল। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নলিয়াখালিতে জঙ্গি-গোষ্ঠীর সংঘর্ষের ঘটনায় ইমরানের সক্রিয় সম্পৃক্ততাও পাওয়া যায়। রিপোর্টটি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দেওয়ার পরেও কেন মনোনয়ন দিয়ে দুবার ইমরানকে রাজ্যসভায় নিয়ে আসা হল, সেই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মমতাই দিতে পারবেন। প্রসঙ্গত, মমতার  বাংলাদেশ সফরের সময় ইমরানের নাম সফর সঙ্গীর তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশে জঙ্গি মদদের অভিযোগ থাকায় মমতা তাঁকে নিয়ে আসতে পারেনি।    

ইমরানের সাথে মানবতা বিরোধী অপরাধী গোলাম আযমের ছেলে মামুন আল আযমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ইমরান ভারতের জামায়েত ইসলামের হিন্দের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন বেশ কয়েক বছর। আল আজম আইডিবি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর থাকা অবস্থায় ভারতে পূর্বাঞ্চলে ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে ইমরান। সেই থেকে ইমরান আর আল আজমের সম্পর্ক।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির হওয়ায় কলকাতার ধর্মতলায় কিছু ইসলামিক সংগঠন প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। পরবর্তীতে জানা যায়, বাংলাদেশের জামায়েত ইসলাম এবং সিমির মদদেই মিছিলগুলি হয়। আহমেদ হাসান ইমরান এই মিছিলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কেন্দ্রীয় সরকারকে তা নিশ্চিত করে।

তৃণমূলের আরেক সদস্য মুনমুন সেন ও পাকিস্তানের তেহরিক-ই ইনসাফ নেতা ইমরান খানের মধ্যে এখনো নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে বলে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দার সংস্থার দাবি। মুনমুন সেন পাকিস্তানের আইএসআইএর সাথে সরাসরি জড়িত, সেই সন্দেহও রয়েছে কিছু কিছু মহলের। গোয়েন্দারা বলছে, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।

২০১৩-২০১৪ সালে ভারতের গোয়েন্দাদের যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য মরিয়া ছিল সেটি হল ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেইসব জানতেন কি না?’। তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের উগ্র-গোষ্ঠীর মধ্যকার নিবিড় যোগাযোগ মুখ্যমন্ত্রী মমতার গোচেরই হয়েছিল বলেই মনে হয়। যদিও তাঁর দল অস্বীকার করেছিল। বলেছিল, এটি বিজেপির রাজনীতি।  

কিন্তু তাদের দাবি তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। সারদার মাধ্যমে জামায়েত ইসলামের কাছ থেকে টাকা নেওয়া দেওয়া ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা তাই প্রমাণ করে।  

প্রথমত: সেই সময়টিতে পাকিস্তানি হাইকমিশনারের কলকাতা সফর ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মমতার সাথে পাকিস্তানের হাইকমিশনারের সাক্ষাতকারের পিছনে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল মুনমুন সেন ও ইমরান খান আগ্রহ এবং ঘনিষ্ঠতা। ভারতের চির বৈরি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সাথে দেশটির একজন মুখ্যমন্ত্রীর দেখা হতেই পারে। কিন্তু সেই সাক্ষাতটি যখন আইএসআইপন্থি পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আগ্রহে অনুষ্ঠিত হয়, তখন এর পিছনের উদ্দেশ্য বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়।   

দ্বিতীয়ত: সাক্ষাতের পরপরই কলকাতার একটি সাংবাদিক দলকে পাকিস্তানে সফরের ব্যবস্থা করা হয়। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে তেমন প্যারা-ডিপ্লোম্যাসি স্থান পায় না। কেন্দ্রকে আড়ালে রেখে পাকিস্তানের সাথে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্যারা-ডিপ্লোম্যাসির চালিয়ে যাওয়ার সাথে অন্যান্য পাকিস্তানপ্রেমি কর্মকাণ্ডগুলি মিলে যায়। খোদ পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ জনগণেই বিশ্বাস করে যে, মমতা সরকার বেশকিছু পদক্ষেপে এই অঞ্চলের উগ্রপন্থীদের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন হচ্ছে।  

তৃতীয়ত: কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার কাছে রাজ্যের মুসলিমদের জন্য পাকিস্তানে যাওয়ার ভিসা প্রসেস সহজ করার অনুরোধের অভিযোগও ছিল মমতার বিরুদ্ধে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যও মুসলিম বাস করে। সেই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা পাকিস্তানি ভিসা সহজ করার জন্য অনুরোধ করেনি। আজ যদি মমতা সারা ভারতের মুসলিমদের জন্য ভিসা পদ্ধতি সহজ করার কথা বলতেন, কারো তেমন কিছু বলার থাকত না।

চতুর্থত: উর্দুভাষীর মানুষের আনাগোনা কলকাতায় উল্লেখ্যযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে, যা সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের ধারনা, মমতার উগ্র রাজনীতি প্রীতির জন্যই রাজ্যের ভিতর অন্য দেশের মানুষদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ আমাদের প্রতিবেশী হওয়ায় মমতার এই ধরনের কর্মকাণ্ডে আমরাও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হই বৈকি। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্তে গরু চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায় সারদার কেলেঙ্কারি টাকার একটি বিরাট অংশ বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগের লভ্যাংশ দিয়ে দেশের ভিতর অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ব্যয় হচ্ছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা।    

গোয়েন্দা তথ্যে আরও জানা যায়, ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্য সভার নির্বাচনে জামায়েত ইসলামের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছিল। গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত বলা যায়। সারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম মূল অভিযুক্ত কুণাল ঘোষ অর্থের আদান প্রদান বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছিলেন। কিন্তু মমতা সরকারের নির্দেশে গঠিত কল্যাণ কমিশন ঘোষকে এড়িয়ে গিয়েছিল। কুণাল নিজে থেকেই কমিশনের সাথে এই বিষয়ে কথা বলার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন। কুনালকে মুখ খুলতে দিলে বহু তথ্যই রের হয়ে আসত।  

২০১১ সালের বিধানসভা এবং লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাতে বাংলাদেশের জামায়েতের নেতা কর্মীরা তৃণমূল পক্ষে কাজ করেছিল। এবারের নির্বাচনেও অনেক বাংলাদেশি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেছে। বিশেষ করে মালদা, দক্ষিণ এবং উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ জেলা সহ বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকাতে জামাতের কর্মীরা তৃনমূলের পক্ষে গণসংযোগ করে।  

ভারতের জাতীয়, আঞ্চলিক এবং স্থানীয় নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটির ইলেক্ট্ররাল আচরণ পর্যালোচনা করলে মমতার বিতর্কিত রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলির কারণ বুঝা যায়।    

ঐতিহাসিকভাবে ভারত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা(বাংলাদেশের মত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয় না) প্রবল। বিশেষ করে সিপিএম ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা প্রায়ই হত এবং সংখ্যালঘু মুসলমানেরা নিরাপত্তা-হীনতায় দিনানিপাত করত। সিপিএম ক্ষমতায় আসার পর তেমন দাঙ্গা হয়নি এবং ফলে সংখ্যালঘু ২৭ শতাংশ ভোট সিপিএমের কোষাগারে যায়। সিপিএম মুসলমানদের মধ্যে ভূমি বিতরণ করেও মুসলমান সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করেছিল। একই সাদৃশ্য দেখা যায় বিহারে। ১৯৯০ সালে লালু প্রসাদ যাদব ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। দীর্ঘ ১৫ বছর সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি ব্যবহার করে লালু ক্ষমতায় থাকেন। একই পদ্ধতিতে উত্তর প্রদেশে মুলায়েম সিং যাদব ক্ষমতায় আসেন।   

এখন নিরাপত্তা সংখ্যালঘু মুসলমানের অগ্রাধিকার তালিকাতে নেই। তাদের সচেতনতা বেড়েছে। তারা শিক্ষা, চাকুরী ও দরিদ্রতা অগ্রাধিকার তালিকাতে নিয়ে এসেছে। সেইসব ইস্যুকে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য লালু প্রসাদ যাদবের ক্ষমতা চলে গিয়েছিল নিতিশের হাতে। ঠিক একই কারণে মুলায়েম সিং ইউপিতে মায়াবতীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।     

পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানরাও আগের মত নিরাপত্তার নিয়ে শঙ্কিত নন। সিপিএমের জমানায় সরকারি চাকুরী সহ অন্যান্য আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে থাকার কারণেই বামফ্রন্টের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। যেখানে সারা ভারতে স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ, সেইখানে পশ্চিমবঙ্গের ২৮ শতাংশ ভোটের মালিক সংখ্যালঘু মুসলিমদের হার ৫৭.৫। এমনকি বাম শাসিত কেরালাতে সংখ্যালঘুদের স্বাক্ষরতার হার ৮৯.৪ শতাংশ। একটি গবেষণায় দেখা যায় কেরালাতে মুসলিমদের দরিদ্রতা ১৫ বছরে (১৯৮৭-২০০৪) ৫৬ থেকে ৩১ নেমে এলেও পশ্চিমবঙ্গে নেমেছে ৫৩ থেকে ৪৪ শতাংশে।

মুসলিমদের প্রতি অবহেলার কারণেই সিপিএম ২০১১ সালে ক্ষমতা হারায়। মমতা ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৮৪ আসন পেয়ে রাজ্যের ক্ষমতায় যায়। এবারের নির্বাচনেও মমতার জোড়া ফুল ২১১ আসনে জয় লাভ করেছে। রাজ্যসভার মত লোকসভার নির্বাচনেও সিপিএমের শোচনীয় পরাজয় হয়। পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি আসনের মধ্যে ২০টিতে জয় নির্ধারণী ভোটের মালিক ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।

পাশাপাশি মমতার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত আচার আচরণ নির্মোহ-ভাবে বিশ্লেষণ করলে অসহনশীলতা, নীতি-হীনতা, রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা মমতার রাজনৈতিক বিকাশ ধারায় প্রবল ভাবেই পাওয়া যায়।    

জীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরী শুরু করলেও, কংগ্রেসের রাজনীতি দিয়েই মমতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু। মমতা ১৯৮৪ সালে বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে সাড়া ফেলে দেন। এরপরে সারা ভারতের যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন।

১৯৯১ সালে লোকসভায় আবার নির্বাচিত হয়ে নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রী সভায় মমতা মানব সম্পদ ও ক্রীড়া মন্ত্রী হিসাবে স্থান পান। কলকাতায় ক্রীড়া উন্নয়নের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতার অভিযোগ এনে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৯৬ সালের দিকে নিজ দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সিপিএমকে সহযোগিতার অভিযোগ আনেন এবং পরিচ্ছন্ন কংগ্রেসের দাবি জানিয়ে প্রকাশে জনসভায় শাল পেঁচিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দেন।

১৯৯৬ সালে পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মমতা সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিংহের জামার কলার ধরে টানাহ্যাচড়া করেন। রেলের প্রতি অবহেলার অভিযোগে ১৯৯৭ সালে সংসদে তৎকালীন রেল-মন্ত্রী রাম বিলাসের দিকে নিজের শাল ছুড়ে মারেন। ১৯৯৮ সালে লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিলের বিরোধিতা করতে গিয়ে সমাজবাদী পার্টির সাংসদ দারোগা প্রসাদ সরোজকে জামার কলার ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৭ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করে। তৃণমূল কংগ্রেস খুব অল্প সময়ে বামফ্রন্টের প্রধান প্রতিদ্বন্ধি হিসাবে প্রকাশ পায়।   

তৃণমূল ১৯৯৯ সালে বিজেপির নেতৃত্বে সরকারে সামিল হলে রেলের দায়িত্ব পান মমতা। রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে তৃণমূল সরকার থেকে বাহির হয়ে যায়। ২০০১ সালের শেষের দিকে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী জোট করেন। তারপরেও নির্বাচনে বামফ্রন্ট জয় লাভ করে। ২০০৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনেও বড়োসড়ো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে মমতার তৃণমূল।

মমতা ২০০৪ সালে আবার ফিরে যান বিজেপির কোয়ালিশন সরকারে। তখন কয়লা এবং খনির দায়িত্বে ছিলেন। এটিই হিন্দুত্ববাদি বিজেপির সাথে মমতার শেষ কোয়ালিশন। কারণ বর্তমান ভোটের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিজেপির সাথে জোট করা আর মমতার পক্ষে সম্ভব নয়।

২০০৬ সালে সিপিএম সরকারের শিল্প নীতির বিরোধিতা এবং ২০০৭ সালের নন্দী গ্রামের গণহত্যার প্রতিবাদের ফলে মমতার জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটি বৃহৎ অংশ বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। বামফ্রন্টের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।   

২০০৯ সালে লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনের মধ্যে ১৯টি জয় করে তৃণমূল। নিজেদের উত্থানের ঘণ্টা বাজায়। মমতা কংগ্রেসের নেতৃত্বের সরকারে আবারও রেলের দায়িত্ব পান। ২০১১ সালের বিধান সভার নির্বাচনে ৩৫ বছরের ক্ষমতায় থাকা সিপিএমকে হারিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে। অভিযোগ ছিল, সারদা ১৩০ কোটি টাকা তৃণমূলের নির্বাচনে অর্থায়ন করেছিল, যার একটি বড় অংশ বাংলাদেশের জামায়েত ইসলাম দিয়েছিল।

সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংকটিই মমতার ক্ষমতার প্রাণশক্তি। প্রতিটি নির্বাচনের আগে জামা মসজিদ শাহির ইমাম বুখারি এবং টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বারখাতি তৃণমূলের পক্ষে ভোট দেওয়া যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে মুসলমানদের তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার আহবান জানান।  

মমতার মত পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ জানে, কেন লালু প্রসাদ যাদবকে সরিয়ে নিতিশ, মুলায়েম সিং কে সরিয়ে মায়াবতী ক্ষমতায় ছিল। এমনকি খোদ পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসের কাছ থেকে সিপিএম, এবং সিপিএমের কাজ থেকে নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এবং লোকসভায় শক্তিশালী বিরোধী দল। গত লোকসভার সংসদে তৃণমূল কংগ্রেস দ্বিতীয় বিরোধী দল হিসাবে ভূমিকা পালন করে।  

মমতা এমন কিছু করতে চাইবেন না যেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তার বিপক্ষে চলে যায়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই ত্রিশ হাজার ইমামকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা প্রদান হাইকোর্ট দ্বারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলেও মমতার প্রতি সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস বেড়ে যায়। তিস্তা পানি চুক্তি না করার পিছনেও অন্যতম কারণ হল, তিস্তার তীরে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই ধর্মীয় সংখ্যালঘু। মমতা জানে ভারতের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি কোন দলের জন্য নির্দিষ্ট নয়। আগে ভারতে প্রোগ্রেসিভ অল্টারনেটিভ তেমন ছিল না, এখন অনেক আছে।  

মমতার নিজেও জানেন ইমরানের মত সিমির অনেক প্রাক্তন নেতার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি? সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি ব্যবহার করে ইমরান মত সিমির নেতারা ভারতের ভিতরে ও বাইরে ভারতের স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, তা খোদ পশ্চিমবঙ্গের সরকারে গোয়েন্দারেই সন্দেহ করে।

সারদা কেলেঙ্কারিতে তার নিজ দলের জঙ্গি-বান্ধব রাজনীতিবিদ আহমেদ হাসান ইমরান থেকে শুরু করে মুনমুন সেনের মত অনেক সেলিব্রেটি জড়িত। যদি ইমরানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জামায়েত ইসলামের টাকা নিয়ে ২০১১ সালের বিধান সভা ও ২০১৪ সালে লোকসভার নির্বাচন করা যায়, প্রশ্ন থেকে যায় কোন নৈতিক ক্ষমতার জোরে মমতা সারদার টাকা জামায়েত ইসলামের প্রয়োজনে দিতে না করবেন?   

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, দেশের ভিতর জঙ্গি উত্থান ঘটল কিনা, তাও মমতার কাছে মুখ্য নয়।  মুখ্য সংখ্যালঘু ভোটের কিছু সুবিধাবাদী প্রতিনিধিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকা। এই ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশ, অনেক দুরের বিষয়।  

মমতা এমন এক রাজনীতিবিদ, যার কাছে নিজ দলের স্বার্থই প্রাধান্য পায়। নিজের স্বার্থের জন্য প্রথমে বিজেপি, পরে কংগ্রেস, আবার বিজেপি, আবার কংগ্রেস জোটে গিয়েছিল। গত লোকসভার নির্বাচনের আগে বিজেপি থেকে কোয়ালিশনের জন্য ইঙ্গিত দিলেও মমতার সাড়া পাওয়া যায়নি। কারণ বিজেপির পক্ষে গিয়ে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি হারাতে হবে এই ভয়ে।

বিজন সরকার, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ