আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

লিদিৎসে’র শিশুরা

কাজী মাহবুব হাসান  

Each man’s death diminishes me,
For I am involved in mankind.
Therefore, send not to know, For whom the bell tolls,
It tolls for thee. (John Donne (1572–1631)

যুদ্ধের নামে মানুষের বর্বরতার উদাহরণের কোনো অভাব নেই ইতিহাসে। তবে বর্বরতার এই ইতিহাসটির সাক্ষী চেকোস্লোভাকিয়ার ছোটো একটি গ্রাম লিদিৎসে (Lidice)। ১৯৪২ সালের ১০ জুন নাৎসি জার্মানির এসএস সেনাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছিল  এই গ্রামটির নিরীহ বেসামরিক অধিবাসীরা: শিশু, নারী এবং পুরুষ।

১০ জুন সেই গণহত্যার ৭৪তম বার্ষিকী। এই ৭৪ বছরে আরো অসংখ্য গণহত্যা হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য,ধর্ম আর সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়েছে নিরীহ শিশু, নারী ও পুরুষ। আমরা কিছুই বদলাতে পারিনি এবং পারবো বলেও অনেকের মত আমি আশাবাদী না। তাই হয়তো এই লেখা : সব গণহত্যার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিস্মৃতির প্রতি,  ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির প্রতি অসহায় কিছু শব্দমালা।

লিদিৎসে’র শিশুদের স্মরণে চেক ভাস্কর মারী উচাইতিলোভার  The Memorial to the Children Victims of the War

বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাহা ( Prague) থেকে প্রায় ২০ কিমি দুরে উত্তর পশ্চিমেই অবস্থিত লিদিৎসে; ১৯৪২ সালে যেখানে মুল গ্রামটি ছিল, তার কাছেই আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে লিদিৎসে, পুরো গ্রামটাই এখন এক ভয়াবহ ইতিহাসের স্মৃতি সৌধ। ৭৪ বছর আগে নাৎসি জার্মানির নিয়ন্ত্রণাধীন বোহেমিয়া ও মোরাভিয়ার একটি গ্রাম ছিল লিদিৎসে।১০ জুন, ১৯৪২ সালে হিটলারের জার্মান সরকার ঘোষণা করেছিল, তারা চেকোস্লোভাকিয়ার একটি গ্রাম লিদিৎসে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, এর সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং প্রায় ৫২ জন নারীকে হত্যা করে এবং বাকী জীবিত নারী এবং শিশুদের (  করা সম্ভব এমন কয়েকটি শিশু ছাড়া, যাদের জার্মানিতে পাঠানো হয়েছিল) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। নাৎসিরা এরপর দম্ভ করে ঘোষণা দেয়, লিদিৎসে, এর অধিবাসীদের, এই গ্রামের নাম পর্যন্ত স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। কিন্তু লিদিৎসে’র নাম নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি হিটলার।

লিদিৎসে এখন শান্ত একটা শহর, যার পাশেই এখন আছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পুরনো গ্রামের কিছু পাথূরে অবশেষ, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মরণে গড়া স্মৃতি সৌধ, লিদিৎসের হারিয়ে যাওয়া শিশুদের স্মরণে একটি হৃদয়স্পর্শী একগুচ্ছ ব্রোঞ্জ মূর্তি, একটি গোলাপ বাগান, মিউজিয়াম, লিদিৎসে মেমোরিয়াল।           

কি হয়েছিল সেদিন লিদিৎসে গ্রামটিতে?  তার আগে কিছুটা ইতিহাস বলতে হবে।

১৯৩৮, মিউনিখ চুক্তির পরেই হিটলারের সেনাবাহিনী জাতিগতভাবে জার্মান প্রধান বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়ার বেশ কিছু এলাকার দখল নেয়, এর কিছু দিন পর অন্যদিকে হাঙ্গেরি দক্ষিণ স্লোভাকিয়া এবং রুথেনিয়া এলাকার দায়িত্ব  গ্রহণ করে। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে হিটলার আরো কিছু চেক অংশ দখল করে নিলে, চেকোস্লোভাকিয়ার আর কোনো অস্তিত্ব থাকেনা, আর বাকী স্লোভাকিয়া তখন একটি নাৎসিদের     পুতুল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। নাৎসি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এরপর দ্রুত বাড়তে থাকে চেকদের প্রতিরোধ আন্দোলন। আর সেই আন্দোলন দমন করতে, এসএস (SS বা Schutzstaffel, যার আক্ষরিক অর্থ প্রতিরক্ষা বাহিনী, যা নাৎসি পার্টির অধীনে একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী ছিল) এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইনহার্ড হেইড্রিশকে ১৯৪১ এর সেপ্টেম্বরে জার্মান দখলকৃত এলাকায় উপপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয় জার্মান হাই কম্যান্ড।

রাইনহার্ড  এর সংক্ষিপ্ত ত্রাসের রাজত্বে প্রায় ৫০০০ ফ্যাসিবাদ বিরোধী যোদ্ধা এবং তাদের সাহায্যকারীদের বন্দী করা হয়। মার্শাল কোর্টের দ্রুত বিচারে বা কখনো বিনা বিচারে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, রাইনহার্ড এই সময় কুখ্যাত ছিলেন ‘প্রাহার কসাই’ নামে।

The Memorial to the Children Victims of the War
 
(জার্মান অধিকৃত এলাকার উপ প্রধান প্রাহার জল্লাদ রাইনহার্ড হেইড্রিশ এবং নিষ্ঠুর গেষ্টাপো প্রধান লিদিৎসে গণহত্যার প্রধান কার্ল হেরমান ফ্রাঙ্ক। কার্ল হেরমান ফ্রাঙ্ক মার্কিন বাহিনীর কাছে পরে আত্মসমর্পণ করেন, ১৯৪৬ সালে তার বিচার হয় প্রাহাতে। প্রায় ৫০০০ মানুষের সামনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।)

তখন লন্ডনে নির্বাসিত চেকোস্লোভাক সরকারের প্রধান এডভার্ড বেনেস, চেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান ফ্রান্টিসেক মোরাভেক এর সাথে নাৎসিদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। জার্মান নাৎসিদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধটি ছিল জল্লাদ রাইনহার্ডকে হত্যা করার অপারেশনটি (  যার কোড নাম ছিল অপারেশন অ্যানথ্রোপয়েড); দুজন সাহসী চেক মুক্তিযোদ্ধা জান কুবিস এবং জোসেফ গাবসিক ( তখন ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনীর পোলিশ ফোর্সের সদস্য) এই অপারেশনটির দায়িত্ব     নেন এবং  প্রাহার কাছাকাছি  প্যারাসুটের সাহায্যে তারা অবতরণ করেন। ১৯৪২ এর ২৭ শে মে তারা রাইনহার্ডকে হত্যার দুঃসাহসী অ্যামবুশটি করেন, যখন রাইনহার্ড তার অফিসে যাচ্ছিল।

জান কুবিস (চেক) এবং জোসেফ গাবসিক (জাতিগত ভাবে স্লোভাক), অপারেশন অ্যানথ্রোপয়েড এর দুই মুক্তিযোদ্ধা।

রাইনহার্ড আহত হবার সাথেই সাথেই ন্যাৎসীরা তাদের পাল্টা আক্রমণ শুরু করে আততায়ীদের ধরার জন্য। গুরুতর আহত রাইনহার্ড এর ৮ দিন পর মারা যান। রাইনহার্ডের আহত হবার সাথেই সাথেই নাৎসিরা আততায়ীদের ধরার জন্য সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। জার্মান গোয়েন্দারা বুঝে ফেলে ব্রিটিশ সহায়তা ছিল এই আক্রমণের পিছনে। এই দুজনকে ধরতে মোট  বহু চেককে (প্রায় ১৩০০০) গ্রেফতার এবং নিপীড়ন আর হত্যা করা হয়। অবশেষে এক চেক মুক্তিযোদ্ধার বিশ্বাসঘাতকতায় ১৮ জুন জার্মান সেনারা কুবিস এবং গাবসিক ও অন্য প্যারাট্রুপারদের আশ্রয়স্থল প্রাহার Cyril and Methodius Cathedral ঘিরে ফেলে। অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর গুরুতর আহত কুবিস ছাড়া বাকীরা আত্মহত্যা করে, কুবিস শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়, পরে গুরুতর আহত অবস্থায় পরে হাসপাতালে তিনি মারা যান ((এই পুরো ঘটনাটির কাহিনী নিয়ে ১৯৭৫ সালে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র আছে, যার নাম অপারেশন ডে ব্রেক))

ক্ষুব্ধ হিটলার রাইনহার্ডের এর সেকেন্ড ইন কমান্ড কার্ল হেরমান ফ্রাঙ্ককে নির্দেশ দেন পুরো চেক জাতিকে (কোন সূত্রে কমপক্ষে ১০০০০ জন) নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রক্রিয়া শুরু করতে।কিন্তু কার্ল হিটলারকে বোঝাতে সক্ষম হন, আগে আততায়ীদের খুঁজে বের করার জন্য কিছু সময় দেবার জন্য, এছাড়া জার্মান যুদ্ধের কাঁচামাল যোগানোর জন্য চেকদের প্রয়োজনও আছে, বড় আকারের কোন গণহত্যা উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে । কয়েকদিনের মধ্যে জার্মানরা ৫০০০ গ্রাম এবং শহর তল্লাশি করে আরো প্রায় ৩১৮০ জনকে আটক করে, যাদের ১৩৪৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় দ্রুত, উদ্দেশ্য, চেকদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে ধ্বংস করে দেয়া। কিন্তু হিটলারে নির্দেশ মোতাবেক বড় সংখ্যার চেকদের হত্যা করার তুলনায় এই সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। যদিও সব বেসামরিক চেকদের উপর হিটলারের নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি তবে, কার্লকে বার্লিন থেকে জানানো হয়, হিটলার স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছেন যদি কোনো চেক গ্রামের রাইনহার্ডকে হত্যার সাথে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তবে সেই গ্রামের সব প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে হত্যা করতে হবে, সকল মহিলা ও শিশুদের (যে সমস্ত শিশুদের জার্মানিকরণ করা যাবে তাদের বিভিন্ন এসএস পরিবারে প্রেরণ করার পর) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাতে হবে এবং পুরো গ্রাম ধ্বংস করে, উপর থেকে বোমা মেরে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে, পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ।

১৯৪২ সালের ৯ জুন খুব ভোরেই, ক্লান্ডো জেলার ছোট গ্রাম লিদিৎসে এ ১০ ট্রাক সিকিউরিটি পুলিশ সদস্য এসে নামে। এর কারণ ছিল, এস এস গোয়েন্দা সংস্থা গেষ্টাপোর গোয়েন্দারা লিদিৎসের স্থানীয়, হোরাক নামে একটি পরিবারের কাছে তাদের ছেলের পাঠানো একটি চিঠি আটক করে, যে লন্ডনে নির্বাসিত চেক আর্মির সদস্য ছিল। গেষ্টাপো সেই  চিঠিটাকে সন্দেহজনক আখ্যা দেয়, যার ফলশ্রুতিতে লিদিৎসে চিহ্নিত হয় হিটলার এর সেই ভয়াবহ আদেশ পালনের শিকার হিসাবে। গ্রামের সমস্ত ১৬ বছরের বেশী বয়সী সকল পুরুষদের একসাথে জড়ো করে গ্রামের এক প্রান্তে হোরাক পরিবারের খামারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাতটা থেকে প্রথমে একসাথে পাঁচ জন, পরে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য দশজন করে গুলি করে হত্যা করা হয়  এসএস অফিসার ম্যাক্স রোস্টক এর নির্দেশে ( যুদ্ধ শেষে বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়াবার পর ম্যাক্স রোস্টক ধরা পড়ে, বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট শাসন শেষ হলে, কিছু গোপন কাগজ পত্রে জানা যায় ম্যাক্স রোস্টককে কমিউনিস্ট সরকার গোপনে ক্ষমা করে দিয়েছিল। এবং তাদের পক্ষে গোয়েন্দা হিসাবে পশ্চিম জার্মানিতে ৮০ দশকের শেষে তার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত তিনি ভালোভাবেই জীবনযাপন করেছিলেন) রাত দশটায় সিকিউরিটি পুলিশের সাথে যোগ দেয় প্রাহা থেকে আসা গেষ্টাপো এজেন্টরা; একদল যখন ডেথ স্কোয়াড, হত্যা করে যাচ্ছিল, আরেকদল পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে প্রেট্রোল ঢেলে জ্বালাতে শুরু করে সব ঘর বাড়ী।দিন শেষে ১৭৩ জন পুরুষের গুলির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত লাশ পড়ে থাকে গ্রামের প্রান্তে ফলের বাগানে। এরপর আসে সেনাবাহিনীর  ইঞ্জিনিয়ারদের  দল, তখনও দাড়িয়ে থাকা বাড়ীর দেয়ালগুলো উড়িয়ে দেয়া হয় বোমা মেরে, এর পর আসে বুলডোজার শিকড় সহ গাছ উপড়ে ফেলে সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়, এমনকি পুরাতন কবরস্থানটিও।১১ জুন সকালে স্থানীয় গেটো থেকে ধরে নিয়ে আসা ট্রাক ভর্তি বন্দী ইহুদিদের দিয়ে গর্ত  খুঁড়ানো হয়  এবং মাটি চাপা দেয়া হয়  মৃতদেহগুলো। গ্রামে এই ধ্বংসলীলা চালানোর সময়, সমস্ত মূল্যবান সম্পত্তি, গবাদি পশু, চাষাবাদের সামগ্রী নিয়ে যায় সিকিউরিটি পুলিশ। প্রায় ৪০০ র মত কবরও ধ্বংস করা হয়। মাটির সাথে মিশিয়ে দেবার পর লিদিৎসের উপর দিয়ে তৈরি করা হয় রাস্তা, রূপান্তরিত করা হয় ভেড়ার চারণ ক্ষেত্রে ।

লিদিৎসের কোনো চিহ্ন খুঁজে যাতে না পাওয়া যায়, এমন ভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল গ্রামটিকে। চার দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জার্মানরা সাবধান বানী লিখে রেখেছিল, কেউ  এখানে ঢোকার চেষ্টা করলে, দেখা মাত্রই গুলি করা হবে। লিদিৎসের নারী ও শিশুদের ছাড়া দেয়া হয়নি। আরো ১১ জন যারা গ্রামে সেদিন ছিলনা তাদেরকেও ধরে আনা হয়, এবং এর আগে গ্রেফতার হওয়া ৮ জন পুরুষ আর ৭ জন নারী (যাদের আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল, কারণ তাদের একজন আত্মীয় ছিল যুক্তরাজ্যে চেক আর্মির সদস্য), এই ১৯ জনকে একই সাথে হত্যা করা হয় প্রাহাতে। গ্রামের মোট ১৯২ জন পুরুষ সবাইকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল নির্বিচারে। পুরুষদের হত্যা করার সময়, জার্মান সেনারা ২০৩ জন নারী এবং ১০৫ জন শিশুকে জড়ো করে প্রথমে লিদিৎসের স্কুলে।এবং এর তিন দিন পর তাদের নিকটবর্তী শহর ক্ল্যানদোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নারীদের থেকে শিশুদের আলাদা করার পর, ১৯৬ জন নারীকে নিয়ে যাওয়া হয় রাভেনসব্রুকের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, চারজন গর্ভবতী মাকে সন্তান জোর করে প্রসব করানো হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর আগে।ক্যাম্পের নির্যাতনে এবং গ্যাস চেম্বারে মারা যায় ৫৩ জন। লিদিৎসের মোট ২০৩ জন নারীর মধ্যে ৬০ জনকে হত্যা করা হয়। বাকী ১৪৩ জন ফিরে এসেছিল গ্রামে, যাদের মধ্যে অনেকেই দ্রুত মারা যান।  
 
লিদিৎসে শিশুদের একাংশ, ছবিটি স্কুলের। এদের কেউ আর ফিরে আসেনি

৮৮ জন শিশুকে বাসে করে জুনের ১৩ তারিখ লোভোসিস এ নিয়ে আসা হয়। প্রাহার জার্মান প্রধানের অফিস থেকে পাঠানো টেলিগ্রামে লেখা ছিল, এই শিশুদের যা পরনে আছে তারা তাই নিয়ে এসেছে, কোন বিশেষ ব্যবস্থা যেন নেয়া না হয়। শিশুদের উপর নির্যাতন ছিল ভয়াবহ: তাদের অনাহারে রাখা, তীব্র শীতে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুতে বাধ্য করা, কোন কম্বল বা শীত বস্ত্র ছাড়া, ক্যাম্পের ম্যানেজমেন্টের প্রতি বিশেষ নির্দেশ ছিল তাদের যেন কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হয়। এখানে আসার পর জার্মানিকরণের উদ্দেশে সাত জনকে বাছাই করা হয়, এবং জুলাই ১ তারিখে, আইখম্যান নির্দেশ পাঠান বাকীদের যেন দ্রুত হত্যা করা হয়। জুলাই ২, ১৯৪২, বাকী ৮১ জন শিশুকে গেষ্টাপো অফিসে হস্তান্তর করা হয়, তাদের পোল্যান্ডে চেলনো (Chelmno) নামে এটি স্থানে এক্সটারমিনেশন বা ডেথ ক্যাম্পে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। ধারনা করা হয়, তাদের সবাইকে একই দিনে হত্যা করা হয়েছিল। লিদিৎসের ১০৫ জন শিশুর (অনূর্ধ্ব ১৬ বছর) ৮২ জন মারা যায় চেলমোয়, ৬ জন এতিমখানায়। মাত্র ১৭ জন জীবিত ফিরে এসেছিল সেই শিশুদের ।এর কিছু দিন পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে লেজাকি (Ležáky) বলে আরেকটি গ্রামে।

১৯৪৫ সালে মে মাসে চেকোস্লোভাকিয়া মুক্ত হলে নতুন করে গ্রামটির স্থাপনা শুরু হয়। জুন ৩, ১৯৪৫ সালে রেড আর্মির সেনারা প্রথম একটি স্মৃতি সৌধ তৈরি করে গণ কবরের স্থানে। পরে বর্ধিতাকারে একটি মেমোরিয়াল ও মিউজিয়াম এবং ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। লিদিৎসের শিশুর নামের ৮২ টি ব্রোঞ্জের মূর্তি ছাড়াও গ্রামের স্কুলের ভিত্তির উপর এবং কবরের কাছে  দাঁড়ানো আছে দুটি শোকার্ত নারীর মূর্তি। ৫০ এর দশকে বিশ্বব্যাপী মানুষের সাহায্যে গড়ে তোলা হয় ১০০ টি বাড়ী, মুল এলাকার কাছেই, তৈরি করা হয় ৩২ টি দেশ থেকে পাঠানো একটি ২৯০০০ গোলাপ গাছের একটি বাগান জীবনের নিরন্তর প্রবাহর চিহ্ন হিসাবে।

চেক ভাস্কর মারি উচাইতিলোভা কুসোভা (Marie-Uchytilova Kucova: 17 January 1924 – 16 November 1989 Prague )

লিদিৎসের ভয়াবহ এই ঘটনার সবচেয়ে নির্মম শিকার ছিল শিশুরা। আর এই ভয়াবহতাকে  বিস্মৃতির অভিশাপ থেকে বাঁচানোর দায় থেকে চেক ভাস্কর মারি উচাইতিলোভা কুসোভা (Marie-Uchytilova Kucova: 17 January 1924 – 16 November 1989 Prague ) তার নিজের দায়বদ্ধতা থেকে কোনো কমিশন ছাড়াই নিজের তাগিদে ৬০ দশকের প্রথম ভাগ থেকেই  লিদিৎসে শিশু এবং সেই সাথে সকল যুদ্ধে নিহত শিশুদের স্মরণে, চেলনো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিহত প্রতিটি শিশুকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন মোট ৮২ টি ভাস্কর্য তৈরি করার কাজ শুরু করেন। প্রথমে তৈরি হয় তার প্লাষ্টার মডেল, মডেল তৈরি করে তিনি চেয়েছিলেন লিদিৎসে গ্রামেই এই স্বতন্ত্রটি ৮২টি শিশুর ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ দিয়ে কাস্ট করবেন।

কিন্তু তার সেই আর্থিক ক্ষমতা ছিল না একার পক্ষে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, বেঁচে থাকতে মাত্র ৩ টি ব্রোঞ্জ কাস্ট করেছিলেন, তার কাজে সাহায্য করেছিলেন তার স্বামী জর্জ ভি হাম্পল।তৎকালীন চেক কমিউনিস্ট সরকারও কোন উৎসাহ দেখায়নি মারিকে সাহায্য করার জন্য। যেটুকু সহায়তা তিনি পেয়েছিলেন তা এসেছিল দেশের বাইরে থেকে। তারপরও তা যথেষ্ট ছিল না। হঠাৎ করেই মেরী উচাইটিলোভা মারা যান ১৯৮৯ সালে তার সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই।  স্বামী জর্জ  মারীর মৃত্যুর পর তার স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেন আরো জোরে সোরে। তার প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ ধীরে ধীরে সম্ভব হতে থাকে। তবে প্রথমে তা যথেষ্ট ছিলনা। কিন্তু হঠাৎ করেই মধ্য নব্বই এর দশকে বড় অংকের একটি সাহায্য আসে ডেনমার্কের Albertslund শহরের অধিবাসীদের কাছ থেকে। সম্ভব হয় প্রয়োজনীয় ৮২ টি ব্রোঞ্জ ঢালাই এর কাজটি শেষ এবং লিদিৎসে এ এই হৃদয়স্পর্শী ভাস্কর্য টি স্থাপনা করার জন্য।

মারীর সৃষ্টির সামনে দাঁড়ানো তার স্বামী জর্জ হাম্পল

১৯৯৫ সালে প্রথমে ৩০টি শিশুর মূর্তি নিয়ে স্থাপন করা হয়। ২০০০ সালে ১০ই জুন লিদিৎসে গণহত্যার ৫৮ তম বার্ষিকীতে উন্মোচন করা হয় পুরো ভাস্কর্যটিকে; শিল্পীর কাজ শুরু করার ৩০ বছর আর তার মৃত্যুর ১১ বছর পর মারীর অপূর্ব সৃষ্টি লিদিৎসের শিশুরা তাকিয়ে আছে তাদের পূর্বপুরুষের সমাধির দিকে এবং সমস্ত মানবতার দিকে।  

লিদিৎসের মা ( Mother of Lidice)

মারী উচাইতিলোভার আরো একটি অসাধারণ ভাস্কর্য হলো, লিদিৎসের মা ( Mother of Lidice), এটি স্থাপনা করা হয়েছে, ক্লান্দো গ্রামার স্কুলের প্রাঙ্গণে। যেখান থেকেই জুন ১১, ১৯৪২ সালে জার্মানরা লিদিৎসের মায়দের কোল খালি করে শিশুদের নিয়ে গিয়েছিল। অনুপস্থিত অথচ চিরস্থায়ী স্মৃতির গভীরে প্রোথিত শিশুর চিহ্ন মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়াবহ বেদনার দিনটিকে।   

লিদিৎসে মেমোরিয়ালে উন্মুক্ত খোলা প্রান্তরে দাঁড়ানো শিশুরা আজ সারা পৃথিবীর শিশু কন্ঠ, তারা জানতে চায়, তাদের অপরাধটা কি ছিল। আর সেই প্রশ্নর উত্তর দেবার মত আমরাই বা কবে সভ্য হতে পারবো?

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ