আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

ফ্লোরিডা-গণহত্যা ট্রাম্পের জন্য ‘পৌষমাস’!

চিররঞ্জন সরকার  

একই বলে কারো পৌষ মাস আর কারও সর্বনাশ! আমেরিকার ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোয় এক বন্দুকধারীর গুলিতে রক্তগঙ্গা বইয়ে যাবার ঘটনা আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য যেন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে! তিনি আবারও তার উগ্ররূপ প্রকাশের মওকা পেয়েছেন। অরল্যান্ডোর নাইটক্লাবে ‘আইএস জঙ্গি’র গণহত্যার পর ‘আমেরিকায় মুসলিমদের ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়’ বলে যে মন্তব্য তিনি আগে করেছিলেন, আবার সেই অবস্থানে ফিরে গেছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায়, ‘চরমপন্থি ইসলাম’ এই মুহূর্তে আমেরিকার সামনে খুব বড় বিপদ। তা রুখতে মুসলিমদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার দাওয়াই দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে, তাই করে দেখাবেন বলে একাধিক বার ঘোষণাও করেছেন। তা নিয়ে বিতর্কের ঝড়ও উঠেছে। মাঝে সেই অবস্থান কিছুটা নরম করেছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী। কিন্তু ফ্লোরিডার নাইট ক্লাবে বীভৎস হামলার পর ফের সেই কট্টরবাদী অবস্থানে ট্রাম্প। আবার সুর চড়িয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘প্রমাণিত হল আমিই ঠিক বলেছিলাম। চরমপন্থি ইসলামই আমেরিকার সবচেয়ে বড় শত্রু।’’

ওবামাকে এ দিন সরাসরি আক্রমণ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘‘মর্যাদাহানিকর ভাবে প্রেসিডেন্ট ওবামা আজ তাঁর মন্তব্যে ‘চরমপন্থি ইসলাম’ কথাটি উচ্চারণ পর্যন্ত করলেন না। শুধুমাত্র এই কারণেই তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।’’

এর পরের টুইটে ট্রাম্পের লক্ষ্য ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তথা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী সম্পর্কে ট্রাম্পের মন্তব্য, ‘‘এই হামলার পরেও যদি হিলারি ক্লিনটন ‘চরমপন্থি ইসলাম’ শব্দ দু’টি উচ্চারণ করতে না পারেন, তা হলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই থেকে তাঁর বেরিয়ে যাওয়া উচিত।’’

মুসলিমদের আমেরিকায় ঢুকতে দেওয়া উচিত নয় বলে যে কথা এত দিন ধরে একাধিকবার ট্রাম্প বলেছেন, তা আর নতুন করে বলেননি তিনি। কিন্তু বলেছেন, ‘‘খুব তাড়াতাড়ি যদি আমরা কঠোর এবং সতর্ক না হই তা হলে আমাদের দেশ বলতে আর কিছু থাকবে না।’’

একের পর এক টুইটে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। কখনও লিখেছেন, ‘‘আমাদের দেশের নেতারা দুর্বল, আমি বলেছিলাম এ রকম হতে চলেছে— এর পর আরও খারাপ কিছু হবে।’’ তার পর লিখেছেন, ‘‘অরল্যান্ডোয় যা হয়েছে, তা সবে শুরু। আমাদের নেতৃত্ব দুর্বল এবং অকর্মণ্য। আগেই আগেই নিষেধাজ্ঞা জানানোর দাবি তুলেছিলাম। কঠোর হতেই হবে।’’ কোন নিষেধাজ্ঞার কথা বলছেন ট্রাম্প? ওয়াকিবহাল মহল বলছে, মুসলিমদের মার্কিন ভিসা না দেওয়ার যে দাবি আগে তুলেছিলেন তিনি, সেই কথাই ফের বলতে চাইছেন রিপাবলিকান প্রার্থী।

আর সোশাল সাইটে এসব কথা বলে সাধারণ মানুষের সমর্থনও আদায় করে নিচ্ছেন এই শিল্পপতি। আগামী নির্বাচনে অরল্যান্ডোয় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডটি বড় প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে বলে রাজনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা।

এখানে বলা ভালো যে, আমাদের দেশের মত সমস্যার মূলটা কোথায়, তা ছড়িয়ে রয়েছে কত দূরে- তার তল্লাশিতে তেমন মন না দিয়ে আপাতত একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর ভোটের সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় মেতেছেন মার্কিন রাজনীতিকরা। কেউ দুষছেন ‘ঘর’কে, ঘরোয়া আইনকে। কেউ বা আগেই ‘ঘর’ না সামলিয়ে ‘বাইরে’র দোষ ধরছেন। ধর্মীয় মেরুকরণের অস্ত্রে সস্তায় ভোটের বাজার মাত করতে কোনও বিশেষ ধর্মীয় মৌলবাদকে নিশানা করতে চাইছেন। এতে করে মার্কিন মুলুকে বন্দুকবাজির ঘটনায় চড়চড়িয়ে ওঠা ‘ডেথ টোলে’র পারদ যে তড়িঘড়ি নামবে, এমন আশার আলো মিলছে না।

আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্র্যাম্প সরাসরি বলেছেন ‘এটা র‍্যাডিক্যাল ইসলামি টেরোরিজমের ঘটনা। এই কথাটা বলার জন্য আমাকে কেউ অভিনন্দন জানান, সেটা চাই না। চাই আরও সপ্রতিভ হয়ে এবং আরও কড়া হাতে এই সমস্যার মোকাবিলা করা হোক। যাতে আমেরিকায় বাইরে থেকে মুসলিমরা ঢুকতে না পারে। আপাতত তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক। ’

তুলনায় হিলারি ক্লিনটন এবং বারাক ওবামা অনেক বেশি যুক্তিশীল আচরণ করছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ওবামা যে কথা বলেছিলেন, হিলারিও অরল্যান্ডোর ঘটনার পর একই কথা বলেছেন, ‘ট্রাম শুধু একটু বিশেষ সম্প্রদায়ের নাম করতেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এটা ঠিক নয়। আসলে সন্ত্রাসবাদীরা ইসলামকে ব্যবহার করছেন। বা আরও সঠিক ভাবে বলতে হলে অপব্যবহার করছেন।’ কিন্তু ট্রাম্প বল্গাহীন। সে পুরোপুরি ধর্মকে ব্যবহার ফায়দা লুটতে চাইছেন। কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই সে আগ বাড়িয়ে ‘র‍্যাডিক্যাল ইসলামি টেরোরিজমের’ তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন। যেন ৫০টা মৃত মানুষকে ব্যবহার করে তিনি আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিততে চাইছেন। কিন্তু একবারও ভেবে দেখছেন না, এতে অরল্যান্ডোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোখা যাবে না। বন্দুকবাজ আমেরিকায় জন্মেছে। বড় হয়েছে। আমাদের সঙ্গেই থেকেছে। চাকরি করেছে। আমেরিকার গণতন্ত্র ও অবাধ স্বাধীনতার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে। আর তার পর অরল্যান্ডোর এই ঘটনা ঘটিয়েছে। যে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, সে কোন ধর্মীয় নেতা নন। সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে অভিযানে নামা মানে তো আর ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা নয়। যুক্তির নিরিখে তাই ট্র্যাম্পের বক্তব্য আদৌ সমর্থন যোগ্য নয়।

বিশেষজ্ঞরা এফবিআই-এর রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলছেন, শুধু বন্দুক হামলাতেই ২০১৪ সালে আমেরিকায় ৮,১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ইউরোপের অন্যান্য উন্নত দেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল। আমেরিকায় গড়ে প্রতি দিন ২৭ জনের মৃত্যু হয় বন্দুক হামলায়। এটা কেন হচ্ছে সেটাই এখন খতিয়ে দেখা উচিত মার্কিন রাজনীতিকদের।

কিন্তু কে শোনে কার কথা! আন্তর্জাতিক তেল রাজনীতির স্বার্থে বর্তমানে আইএস, আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন নামের জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে ‘ইসলাম’কে ট্যাগ করে ফেলা হয়েছে। এর পেছনে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিরাট রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে সেটা যেমন সত্য, একইসঙ্গে অপরিণামদর্শী উগ্র ধর্মবাদীরাও এজন্য কম দায়ী নয়। তাদের ভূমিকার কারণেই আজ পৃথিবীর অনেক দেশে মুসলিমরা নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছে।

যদিও জঙ্গিদের কোনো জাত নেই, ধর্মও নেই। জাতিগত বৈষম্য আর দারিদ্র্য উপেক্ষা করে জঙ্গিবাদকে শুধু ধর্মীয় লেবাসে দেখাও এক ধরনের নষ্ট রাজনীতি। এ থেকে বের হয়ে আসার জন্যে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলকে দেখা গিয়েছে মুসলিমবিদ্বেষ উস্কে দেওয়ার বিরুদ্ধে মিছিল করতে, তাতে নেতৃত্ব দিতে। কারও ধর্মীয় অনুভূতি আহত করে কিংবা মুসলিম-বিদ্বেষ উস্কে দেয় এমন প্রচারণা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে মার্কিন ও ব্রিটিশ মিডিয়ার দায়িত্বশীলতাও প্রশংসার দাবি রাখে।

কিন্তু ওমর মতিন নামে আফগান বংশোদ্ভূত ওই বন্দুকধারীর নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনা চরম মুসলিম-বিদ্বেষী ট্রাম্পের জন্য শাপে বর হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। আর এ ধরনের ঘটনা আমেরিকানদের যে একটুও মুসলিম বিদ্বেষী করবে না-এ কথাই বা গ্যারান্টি দিয়ে কে বলবে? কারণ বর্তমান জমানার মানুষ খুব বেশি যুক্তিবুদ্ধি মেনে চলেন বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক নেতারা যে ভাবাবেগ সৃষ্টি করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ সেই হাওয়াতেই নাচেন! আমেরিকানরা কার কথায় বেশি নাচবেন, হিলারি না ট্রাম্প-এখন সেটাই দেখার বিষয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ