প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ২৬ জুন, ২০১৬
ব্রিটিশ এমপি জো কক্সের মৃত্যুতে অনেকেই ধরে নিয়েছিল জো কক্সের রক্তের বিনিময়ে, লাখো মানুষের অশ্রুধারায় হয়তো ইইউতে আবারও টিকে যাবে ব্রিটেন। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য। এর আগে ১৯৭৫-এর গণভোটে ব্রিটেনবাসী ইইউ-তে থাকার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে এবার তাঁরা বললেন, আর ব্রিমেইন নয়, চাই বিচ্ছেদ। চাই ব্রেক্সিট।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে আসা নিয়ে অনুষ্ঠিত গণভোটের পক্ষে বিপক্ষে চুলচেরা বিশ্লেষণ লাভ ক্ষতির হিসাব কষা হয়েছে তাবৎ বিশ্বমিডিয়া জুড়ে। ঐতিহাসিক এই গণভোট শুধুমাত্র গণতন্ত্রের ভোটাধিকার প্রয়োগ ছিল না। এর সাথে ইতিহাস ঐতিহ্য অথবা আর ও স্পষ্ট করে বললে ব্রিটিশ আভিজাত্য ও জড়িয়ে ছিল। এতো বড় একটা বিপ্লব হয়ে গেল, বাসে ট্রেনে কিংবা রাস্তায় কোন টু শব্দ নেই। সবকিছু স্বাভাবিক। এশিয়াতে এই ঘটনা ঘটলে কি অবস্থা হতো ভাবা যায়? ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার উত্তাপটা মিডিয়ার কল্যাণে কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে। ব্রিটেনের ইতিহাসে এমন ভোট আর হয়নি বলেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম দাবী করছে।
ঐতিহাসিক এই গণভোটে অংশ নেন সাড়ে চার কোটির বেশি ভোটারের মধ্যে ৭২ শতাংশ ভোটার। এর মধ্যে ৫২ শতাংশ ভোটার ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দেন। ৪৮ শতাংশ ভোটার জানান তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই থাকতে চান। গত দু'দশকে ব্রিটেনের কোনও নির্বাচনেই এত বেশি ভোট পড়েনি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই লন্ডন বাদে গোটা ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের বাসিন্দারা ইইউ ছাড়ার পক্ষে মত দেন। তবে, স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের ভোটাররা জানিয়েছেন, তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নেই থাকতে চান।
গণভোটের এই ফলের কারণে ৪৩ বছর পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসল ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশটি।
এদিকে ফলের পরেই, গণতন্ত্রের মতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। জল্পনা কল্পনা চলছে কে হচ্ছেন পরবর্তী টোরি দলের প্রধান ও আগামী দিনের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভূক্ত দেশ সমূহের অনেকেই ব্রিটেন ছাড়া শুরু করে দিয়েছেন। যদিও ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে দু'বছর।
ব্রিটেনের রাজনীতি মূল ধারার রাজনীতি আমার কাছে আদার বেপারীর জাহাজের খবর রাখার মতো বিষয়। যদি ও আমাদের মতো অভিবাসীরা উত্তরাধিকার সূত্রেই লেবার পার্টির প্রতি প্রেম নিয়েই ব্রিটেনে পা রাখি। বাঙালি বা এশিয়ান বেশীর ভাগ মানুষই লেবার দলের সমার্থক। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সাপে নেউলে সম্পর্ক থাকলেও ব্রিটেনে আওয়ামী লীগ বিএনপি জামায়াত সবাই লেবার দলের ছায়াতলে এসে সমবেত হয়েছেন। দূরে থাকার এও একটি বড় কারণ।
যদি ও ইদানীং কনজারভেটিভ পার্টি সহ অন্যান্য দলে ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা পদপদবী পাচ্ছেন মন্ত্রী এমপি ও হচ্ছেন। তবে ডেভিড ক্যামেরনের স্মার্টনেস আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। সত্য বলা ও ভুল স্বীকার করে নেয়ার ক্ষমতা আছে তাঁর,যা একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে কাম্য।
গণভোটে লেবারের বড় বড় সব নেতাগণ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে ছিলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিন নারী এমপি রুশনারা, টিউলিপ ও রুপা হক এমনকি সদ্য বিজয়ী লন্ডন মেয়র পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান ও পক্ষেই ছিলেন। তবু ভোটাররা বিচ্ছেদ বেছে নিয়েছেন।
ব্রিটেনের বাঙালিদের বৃহৎ অংশ কেন এই বিচ্ছেদের পক্ষে দাঁড়ালেন এই হিসাব কষছেন অনেকে। যে সব বিষয়গুলোকে বেক্সিটের মূল নিয়ামক হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
স্বাস্থ্যসেবা খাতে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রতিশ্রুতি
'লিভ ক্যাম্পেইন'-এর স্লোগান ছিল ইইউ ছাড়লে সপ্তাহে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ বাঁচবে -যে অর্থ তারা বলেছে এখন ইইউকে দিতে হচ্ছে - এই অর্থ স্বাস্থ্য-সেবা খাতে বরাদ্দ করা যাবে।
অভিবাসন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারণী বিষয়
ইইউ বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত ইউকিপ নেতা নাইজেল ফারাজ-এর অভিবাসন বিরোধী মন্তব্য এই প্রচারণায় 'লিভ ক্যাম্প'-এর জন্য হয়ে উঠেছিল তুরুপের তাস। জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি ও ঐতিহ্যের বিষয়টি বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
জনগণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয় নি
ডেভিড ক্যামেরন দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে জিতেছেন, একটা গণভোটেও জয়ের সাফল্য তিনি পেয়েছেন।
লেবার পার্টি ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে
'রিমেইন ক্যাম্প'-এ যারা প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তাদের জেতার জন্য অপরিহার্য ছিল লেবার সমর্থকদের পাশে পাওয়া। লেবার সমর্থকদের শতকরা ৯০ভাগই ছিল ইইউতে থাকার পক্ষে। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রচারণা চালানোর তেমন উদ্যোগ দেখা যায় নি।
বয়স্ক মানুষরা বেশি ভোট দিয়েছেন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বয়স্ক মানুষদের ভোট 'লিভ ক্যাম্পেইন'কে জয়যুক্ত করতে সাহায্য করেছে - বিশেষ করে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম, মিডল্যান্ডস এবং উত্তর পূর্ব ইংল্যান্ডে।
বাঙালি অভিবাসীরা যে সব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সরকারী সাহায্য যা বেনিফিট নামে পরিচিত। অনেকের ধারণা ইউরোপীয়রা তাঁদের বেনিফিট সুবিধায় ভাগ বসিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসলে তাঁদের বেনিফিট সুবিধা আগের মতো বহাল থাকবে। আদম ব্যবসায় যারা টাকা বানানোর স্বপ্ন দেখেন তাঁদের ধারণা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা সহ অন্যান্য ভিসায় বাংলাদেশ থেকে মানুষ আনা সহজ হবে। বরিস জনসনের সাধারণ ক্ষমতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে অবৈধদের বৈধ হবার ঘোষণাকে নিজেদের অবৈধভাবে বসবাসকারী আত্মীয় স্বজনের একটা গতি হয়ে যাবে। কাউন্সিলের বাসা পাওয়ার সহজ লভ্যতা। নাইজেল ফারাজের স্বাস্থ্যখাতে অর্থ বরাদ্দের ঘোষণায় বিশ্বাস করা।
যারা অন্যান্য ভিসায় আছেন তাঁদের ধারণা একক ব্রিটেন তাঁদের জামাই আদরে এইদেশে থাকতে দিবে। আর তাই তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল দুইএকজন আর কয়েক কাঠি এগিয়ে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, এমনকি ফেইসবুকে স্ট্যাটাস ও দিয়েছেন ব্রিটেনের এই বিচ্ছিন্নতা ইসলামের শাসনের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেল ব্রিটেন। ব্রিটেনে এশিয়ান ও আফ্রিকার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একটা বড় অংশের বসবাস। ব্রিটিশদের জন্মহার ও অভিবাসীদের জন্মহারের ব্যবধান কয়েকগুণ। আগামী কয়েক দশকে খোদ ব্রিটিশরা এখানে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন মুসলমানরা শাসন করবে ব্রিটেন। সাদিক খানের বিজয় ও সেই আশার আলো দেখিয়েছে হয়তো।
ইতিহাস কোনদিকে মোড় নিবে আগাম বলা যাচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার মধ্য দিয়ে স্কটল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের যুক্তরাজ্য থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথকে অনেকটাই প্রশস্ত করে দিয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। সেই ক্ষেত্রে ওয়েলস ও নীরব থাকবে বলে মনে হয় না। তাঁরা ও নিজেদের স্বাধীনতা দাবী করবে। ইতোমধ্যে স্কটল্যান্ড দ্বিতীয় বারের মতো তাঁদের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের কথা ভাবছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকতে তাঁদের আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং পথ খুঁজছে। ইংল্যান্ড তখন রেসের মাঠে খোঁড়া ঘোড়া হয়ে যাবে।
চ্যানেল ফোর এর ছোট একটি ভিডিও ফুটেজ অনলাইনে অনেকেই দেখেছেন হয়তো। কয়েকজনকে ভোটারকে জিজ্ঞাসা করেছেন ব্রিটেন ইউরোপ থেকে বের হয়ে আসায় তাঁরা খুশি কিনা? উত্তরগুলো অভিবাসী হিসাবে আমাকে আতঙ্কিত করেছে। উত্তরগুলো ছিল তাঁদের ব্রিটিশ মূল্যবোধ, মুসলমান অভিবাসী রোধ এইসব নিয়ে। অর্থনৈতিক বিষয় বা বেনিফিট নিয়ে কেউ কিছুই বলে নাই। ডেভিড ক্যামেরনের জন্য করুণা হয়। নিজের পাতানো হরিকাঠে নিজেই বলিদান হলেন। বিগত নির্বাচনে ব্রিটিশ আভিজাত্যের উনুনে ঘি ঢেলে দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন নির্বাচনী বৈতরণী। যদিও শেষপর্যন্ত ব্রিটেনকে ইউরোপে ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ও শেষ রক্ষা করতে পারেননি।
নাইজেল ফারাজ ফলাফল ঘোষণার পরেই স্বাস্থ্যখাতে নিয়ে দেয়া বক্তব্য অস্বীকার করেছেন। আর এর মধ্য দিয়েই বুঝা যাচ্ছে আগামীর ব্রিটেন কেমন হতে পারে। সারা বিশ্বকে শাসন করা ব্রিটিশরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে ইউরোপ থেকে বের হয়ে এসেছে ভাবলে ভুল হবে।এর পিছনে রয়েছে তাঁদের নীল রক্তের আভিজাত্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা নিয়ম নীতির বেড়াজালে সেই ক্ষমতা তাঁদের অনেকটাই খর্ব করা ছিল। অভিবাসী বিতরণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা নিয়ম নীতির কারণে ব্রিটেনের পক্ষে চাইলেই সম্ভব হতো না। সেই বাধা আর এখন রইল না।
সাময়িকভাবে আমরা অনেকেই হয়তো লাভবান হয়েছি বলেই ধরা যায় । ব্রিটেনের অর্থনীতি ও আগামী দুই বছরের ভিতরে ভাল অবস্থানে চলে যাবে ধারনা করা হচ্ছে।
কিন্তু এই বিচ্ছেদের কাফফারা সবচেয়ে বেশী অভিবাসীদেরকেই দিতে হবে সেটা আগাম ধারণা করা যায়। নিজের নাক খেটে পরের যাত্রা ভঙ্গে শামিল হলাম কিনা সময়ই বলে দিবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য