প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ২১ আগস্ট, ২০১৬
মাথার রক্ত গড়িয়ে পড়েছিল চিবুক পর্যন্ত। ব্যান্ডেজে ঢাকা মাথা। বুজে গিয়েছে বাঁ চোখ। তবু চোখ দিয়ে জল পড়েনি। অবশেষে আহত বাবা-মাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করল পাঁচ বছরের ওমরান দাখনিশ। গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার এই শিশুটি যেন বিশ্বসভ্যতাকে ব্যঙ্গ করছে! রক্তাক্ত, ধুলোয়-কাদায় মাখামাখি, তীব্র আতঙ্কে বাক্যহারা একটা মুখ। যন্ত্রণার তীব্রতায় যেন কাঁদতেও ভুলে গিয়েছে বছর পাঁচেকের ছেলেটা।
যে চিত্রসাংবাদিক শিশু ওমরানের ভিডিওটি শুট করেছিলেন, তিনিই সেই ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। ভিডিওয় দেখা গিয়েছে, বিধ্বস্ত ওমরান আনমনেই নিজের বাঁ হাতের দু’পিঠ দিয়ে মুছে নিচ্ছে কপাল আর গাল পেয়ে গড়িয়ে আসা রক্ত। হাতের দিকে চেয়ে দেখছে এক ঝলক। তার পর অ্যাম্বুলেন্সের সিটে মুছে নিচ্ছে হাতটা।
সিরিয়ায় নিরন্তর চলছে ধ্বংসলীলা। আর সেই ধ্বংসের মুখ হিসেবে বার বার উঠে আসছে শিশুদের বিধ্বস্ত শৈশবের ছবি। প্রথমে আইলান কুর্দি। তার পর ওমরান। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় সবচেয়ে বড় বিপদের মুখে শৈশব। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের একদম গোড়ায় তুরস্কের সমুদ্র সমুদ্র সৈকতে মুখ থুবড়ে নিষ্প্রাণ পড়ে থাকা আলানের দেহের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতেই ঝড় ওঠে গোটা বিশ্বে। ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সিরিয়ায় রোজ মানবাধিকার যে ভাবে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, শিশুরা যে ভাবে যুদ্ধের বলি হচ্ছে, তার প্রবল নিন্দা শুরু হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ থামেনি। ১১ মাস পরে আবার একই ছবি। রুশ বোমায় ভেঙে পড়ল বাড়ি। ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে গেল গোটা পরিবার। ওমরান বেঁচে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু তার ভাই দশ বছর বয়সী আলিকে চিকিৎসকরা আর বাঁচাতে পারেননি। ওমরান আর তার পরিবার মারাত্মক জখম নিয়ে চিকিৎসাধীন।
আইলান থেকে আলি-কত শিশু বলি হলো সিরিয়ায়। জাতিসংঘের হিসেব বলছে, সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২ লক্ষ ৯০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ হাজারই শিশু। গোটা সিরিয়া এখন প্রবল বোমাবর্ষণের ক্ষত বুকে নিয়ে কোনো মতে টিকে রয়েছে। দিকে দিকে শুধু ভগ্নস্তূপ। এক সময় যে শহরটা ছিল সমৃদ্ধ নগরী, বর্তমানে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া আলেপ্পো শহরেই হাজার হাজার শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছে।
আলেপ্পোর পশ্চিমাংশ বাশার আল-আসাদের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পূর্ব অংশ আইএসের দখলে। এই আইএসের হাত থেকে আলেপ্পোর পূর্বাঞ্চলকে উদ্ধার করতে রুশ যুদ্ধবিমান রোজ হানা দিচ্ছে। লাগাতার বোমাবর্ষণ চলছে। আর আইএস জঙ্গিরা নিজেদের এলাকা থেকে রকেট ছুড়ছে সরকার নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম আলেপ্পোর দিকে। এই লড়াইয়ের মাঝে সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। ইউনিসেফের হিসেব বলছে, বিদ্রোহীদের দখলে থাকা পূর্ব আলেপ্পোয় এখনও প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের বাস। তাদের মধ্যে অন্তত এক লক্ষই হল শিশু। আসাদ আর রুশ বাহিনীর যৌথ হামলা পূর্ব আলেপ্পোর উপর চলতে থাকলে আরও কত আইলান, ওমরান, আলির মুখ ভেসে উঠবে, তা ভাবলেই শরীর শিউরে উঠছে!
অনেক শিশু চিরতরে ঝরে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আরও অনেকের ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও বড়সড় শারীরিক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাক্রমে যারা প্রাণহানি বা অঙ্গহানির হাত থেকে বেঁচে যাবে, তাদের কী হবে? যে প্রবল রক্তপাত, ধ্বংসলীলা, একের পর এক প্রিয়জন বিয়োগ আর হিংসার মধ্যে বড় হচ্ছে সিরিয়ার এই প্রজন্ম, তাতে সাংঘাতিক মানসিক ক্ষতির সম্মুখীনও হচ্ছে তারা। সিরিয়ার এই শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘোর উদ্বেগে ইউনিসেফ। কিন্তু বিশ্বনেতাদের তাতে কোনো খেয়াল নেই। মানবতার বাণী তাদের কাছে ব্যর্থ পরিহাস মাত্র!
এক জটিল রাজনৈতিক সম্পাদ্য আজ সিরিয়াকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে শেষ পর্যন্ত এই অবস্থায় পৌঁছবে তা কে জানত? ‘আরব বসন্ত’-এ অনুপ্রাণিত হয়ে যাঁরা আসাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছিলেন তাঁরা কি ভেবেছিলেন এই পরিণতির কথা? শেষ পর্যন্ত আমেরিকার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হলো শিয়া-সুন্নি রক্তাক্ত সংঘাতে। শিয়া সংখ্যালঘু (আলওয়াতি) বাশার সরকারের শাসন, স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল সেই জনগোষ্ঠী প্রধানত সুন্নি। অতএব শিয়া-সুন্নির ঐতিহাসিক বিভাজন থেকে রক্তপাত শুরু হতে সময় লাগেনি। আর তা তৈরি করেছে সংঘর্ষের এক বিপুল প্রেক্ষাপট। সেই বিভাজনের দু’দিকে পশ্চিম এশিয়ার দুই শক্তিধর ইরান আর সৌদি আরব।
শিয়া বা সুন্নি-সিরিয়ায় কোনও এক গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলে এই দুই শক্তির বহমান ক্ষমতা বিস্তারের প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আসাদ-বিরোধী শক্তিকে মদত দিতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নি গোষ্ঠী আরব লিগ সক্রিয় হতেই কালবিলম্ব না করে নেমে পড়ে ইরানও।
আর এই পরিস্থিতি আমেরিকার চুপ করে থাকবে-তা কী করে হয়? সিরিয়ার সঙ্গে মার্কিন ‘সুসম্পর্কে’র কারণে স্বাভাবিক ভাবেই আসাদ-বিরোধী শক্তির দিকেই মার্কিন সমর্থন ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির আমূল বদল করে আসাদ-বিরোধী যুদ্ধে মগ্ন সিরিয়ার মঞ্চে আবির্ভূত হয় ইসলামিক স্টেট (আইএস)। শুধু আসাদকে সরানো নয় সিরিয়া, ইরাক, ইরান জুড়ে এক কঠোর ইসলামিক অনুশাসনে আবদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে আসেন আবু বকর আল-বাগদাদি। ২০১৪-এর মাঝামাঝি থেকে সিরিয়ার ও ইরাকের বিপুল অংশ জুড়ে সেই স্বপ্ন সফলও হতে থাকে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আর শুধু পশ্চিম এশিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে আটকে থাকে না। আসাদ বিরোধী আমেরিকাকে এ বার আইএস-এর ত্রাসের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে হয়।
এক দিকে, আসাদ বিরোধী শক্তিকে সমর্থন (অর্থ ও অস্ত্র জুগিয়ে)। অন্য দিকে, আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জোট তৈরি, টলমল ইরাককে রক্ষা করা। আমেরিকা যখন এই দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত তখন মঞ্চে আবির্ভাব ভ্লাদিমির পুতিনের। ইরান ও আসাদের পায়ের মাটিকে শক্ত করার পাশাপাশি ন্যাটোর প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসেবে রাশিয়ার পেশি আস্ফালনের সুযোগ ছাড়তে রাজি নন পুতিন। তাই আফগানিস্তানের পরে প্রথম কোনও মুসলিম দেশের সরকারকে রক্ষা করতে হাজির হয় রাশিয়ার সেনা।
এই বহুমুখী লড়াই-এ লেভান্ত (সিরিয়া ও ইরাক) জুড়ে অবিশ্রান্ত রক্ত ঝড়ে চলেছে। নানা সংস্থার হিসেবে পার্থক্য থাকলেও মৃতের সংখ্যা চার লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। গৃহহারা প্রায় ৭৬ লক্ষ। আর দেশ ছেড়েছেন ৪৮ লক্ষ নাগরিক। জর্ডান, লেবানন, তুরস্ক ছাড়িয়ে শরণার্থীর অভিঘাতে ইউরোপের নাভিশ্বাস। আইএস পশ্চিম এশিয়া ছেড়ে ইউরোপের অন্দরে ডালপালা বিস্তার করেছে। প্যারিস, ব্রাসেলস, মিউনিখে হামলা চালানো আইএসের কাছে এখন ডালভাত। পূর্ব এশিয়াও সন্ত্রস্ত। একটি দেশের সমস্যার এই বিপুল বিশ্বজনীন অভিঘাত এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি।
কূটনীতির অন্তহীন কূটকচালিরও পরেও সিরিয়ার কোনও সমাধান সূত্রের দেখা মিলছে না। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন-সহ বেশ কিছু দেশ আইএস-এর উপরে লাগাতার হামলা চালাচ্ছে। একই ধরনের হামলা চালাচ্ছে রাশিয়াও। কিন্তু তার লক্ষ্য আইএস-এর পাশাপাশি আসাদ বিরোধী শক্তিও। ফলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে সিরিয়া। কয়েক দিন আগে ইরান তার বিমানঘাঁটি রাশিয়ার ব্যবহারের জন্য খুলে দিয়েছে। এতে আরও কম সময়ে আলেপ্পোর মতো আসাদ-বিরোধী কিন্তু মার্কিন সমর্থিত অঞ্চলগুলিতে পৌঁছে যাবে রাশিয়ার বোমারু বিমান। ফলাফল? ভবিষ্যৎ নিকষ অন্ধকার!
সিরিয়ায় আজ যে যার স্বার্থ ও সুবিধা অনুযায়ী লড়ছে, খেলছে। জাতিসংঘ-সহ নানা আন্তর্জাতিক সংগঠন, হাজারো মানবাধিকার সংগঠনের আর্তি বাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে। আকাশ থেকে অবিরাম বোমাবর্ষণ, কুর্দদের সাহসী লড়াই, ইরাকি সেনাদের মনোবল ফিরে পাওয়ায় আজ আইএস কোণঠাসা। কিন্তু বোমায় তো শুধু জঙ্গি মরে না! এই বিপুল ‘কোলল্যাটরাই ড্যামেজ’-এর দায়িত্ব কার? রাশিয়া-আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি-ইরান-সৌদি আরব প্রভৃতি দেশ হাজার হাজার শিশুর মরা হাড় দিয়ে কোন ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ বানাতে চাইছে? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে না!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য