প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ফরিদ আহমেদ | ১৪ নভেম্বর, ২০১৬
মাত্র কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেলো। প্রবল উত্তেজনাময় এই নির্বাচনে রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে থাকা সফল ব্যবসায়ী এবং বিলিয়নিয়ার ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ছিলেন, তিনি ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাস্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ট্রাম্প এই নির্বাচনে জয় লাভ করবে, এই তথ্য বেশিরভাগ জনপ্রিয় জনমত জরিপ সংস্থা, রেডিও, টিভি বা সংবাদপত্রের মতো গণমাধ্যমগুলো, কেউ-ই এই ভবিষ্যতবাণী করেনি। বরং, এদের প্রায় সকলেই হিলারি ক্লিনটন যে জিতবে, সেই বিষয়ে অগ্রিম ধারণা দিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু, সব হিসাব নিকাশকে উল্টে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে ফেলেছেন।
নারী-বিদ্বেষী এবং অশ্লীল কথাবার্তায় পটু যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।অশ্লীল সব কাজেও দক্ষ এই ধনাঢ্য ব্যক্তিটি। বিলি বুশের সাথে তার ফাঁস হওয়া অডিও টেপে শোনা যায় ট্রাম্প বিলি বুশকে নারীদের বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছে এভাবে যে, ‘গ্রাবদেম বাই দ্য পুসি এন্ড ডু হোয়াটএভার ইউ ওয়ান্ট টু ডু’। কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এরকম কিছু করা সেক্সুয়াল এসল্টের পর্যায়ে পড়ে। শুধু এরকম একটা উদাহরণ না, নারীদের ডোনাল্ড কী রকম নিচু চোখে দেখে, কীরকম ঘৃণ্য চোখে দেখে, কী রকমভাবে যৌনবস্তু হিসাবে বিবেচনা করে, তার অসংখ্য প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা দিকে। নারীদের ফ্যাট পিগ, ডগ বা স্লব বলে ডাকাটা তার প্রিয় অভ্যাস ছিলো। এ সব কথার বাইরেও নানাভাবে নারীদের অবমাননা করেছেন। এর চেয়েও বড় কথা, নির্বাচনের আগে প্রায় ডজন খানেক মহিলা অভিযোগ এনেছে এই বলে যে, ট্রাম্প নানা সময়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের গায়ে হাত দিয়ে যৌন নিপীড়ন করেছে।
এরকম একজন নারী-বিদ্বেষী পুরুষ, প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক মানুষ, নারী-লোলুপ এবং যৌন নিপীড়ক ব্যক্তি আমেরিকার নারীদের ভোট পাবেনা, এটাই সবাই আশা করেছিলো। বিশেষ করে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ শিক্ষিত নারী গোষ্ঠী, যারা নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা এবং নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী, যেকোনো ধরনের যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, তারা যে ট্রাম্পের পিছনে দাঁড়াবেনা, এব্যাপারে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো।
শুধু তাই নয়। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের দুইশো চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো। ইতিহাস গড়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের হাতে। যিনি এই পদে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি অযোগ্য কেউ নন। তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য যোগ্য একজন মানুষ, দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এবং সবদিক দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে অধিকতর যোগ্য একজন ব্যক্তি। সে কারণেই নারীরা এই নারী প্রার্থীর পিছনে তাদের সমর্থন পূর্ণোদ্যম ব্যক্ত করবে এটাই ছিলো প্রচলিত ধারণা।
কিন্তু, নির্বাচনে সেই ধারণাটা পুরোপুরি মার খেয়েছে। ট্রাম্প সবচেয়ে বেশ ভোট পেয়েছে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে। এটা প্রত্যাশিত ছিলো। এতে আশ্চর্য হবার মতো তেমন কিছু নেই। তার স্থূলবর্ণবাদী প্রচারণা অশিক্ষিত এবং আধা-শিক্ষিত সাদাদের, অভিবাসীবিহীন সাদা আমেরিকার এক অলীক স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলেছিলো।কিন্তু, শ্বেতাঙ্গ নারীরা, নারীদের বিরুদ্ধে এরকম আচরণের পরে ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে এক বিপুল বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এই নির্বাচনে তিপ্পান্ন শতাংশ শ্বেতাঙ্গ নারী ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। যেখানে মাত্র ছাব্বিশ শতাংশ ল্যাটিনো নারীরা এবং মাত্র চার শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ভোট দিয়েছে ট্রাম্পকে। নারী-বিদ্বেষ, নারীর বিরুদ্ধে অশ্লীল এবং অবমাননাকর কথাবার্তা, নারীদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ কোনোকিছুই দমাতে পারেনি শ্বেতাঙ্গ নারীদের ট্রাম্পের প্রতি তাদের ভালবাসাকে ম্লান করতে। ট্রাম্পের এক নারী সমর্থক জেন বিডিক তো নারীদের অসম্মতিতে তাদের গায়ে হাত দেওয়াটাকেও ভালো কাজ হিসাবে সনদ দিয়ে ফেলেছে। নিইউ ইয়র্ক টাইমসকেসেই নারী বলেছে, " I’m a woman, and when a guy gropes me, I get groping on them! I grope them back. Groping is a healthy thing to do. When you’re heterosexual, you grope, okay? It’s a good thing." তো, এই ভালো কাজের প্রতিদানই দিয়েছে তারা দলে-বলে গিয়ে ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারটা ছিলো মূলত সাদা মানুষদেরকে কেন্দ্র করে। তিনি সাদা মানুষদের একটি পক্ষ বানিয়ে নারী, কৃষ্ণাঙ্গ,স মকামী গ্রুপ,অভিবাসী সবার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই দুইপক্ষের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ নারীরা আশ্চর্যজনকভাবে সবাইকে বাদ দিয়ে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদেরই পক্ষ নিয়েছে। নারীদের সন্তান জন্মদানের উপর নিজস্ব অধিকার, যৌন স্বাধীনতা এগুলোর চেয়ে সাদা মানুষ হিসাবে তাদের উচ্চতর ক্ষমতাকে সংরক্ষণ করাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচনা করেছে। সে কারণে তারা সবকিছু ভুলে তাদের বাপ, ভাই, স্বামীদের পক্ষ নিয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, শ্বেতাঙ্গ নারীরা কালো, ল্যাটিনা, কিংবা মুসলিম নারীদের চেয়েও অনেক বেশি একাত্মতা অনুভব করে তাদের একই গায়ের রঙের পুরুষদের সাথে। অথচ, তারা বিবেচনায় নেয়নি যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন নারী বিদ্বেষী ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হলে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার বন্ধ হবে, স্বাস্থ্য-বীমা রহিত হবে এবং সার্বিকভাবে সমাজ এবং রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান নিচুতে নেমে আসবে।
ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাট এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং হিস্ট্রি ফার্স্টস: হাউ সিম্বোলিক এমপাওয়ারমেন্ট চেঞ্জেস ইউএস পলিটিকস বইয়ের লেখক এভেলিন সিমিয়েন এর মতে নারী কোনো একক সত্ত্বা না। এটা একটা জনগোষ্ঠী। কাজেই, একে বুঝতে গেলে এর বিভিন্ন অংশকে বুঝতে হবে।
একজন নারী সিইও-র রাজনৈতিক উদ্বেগ,একজন কলেজ ডিগ্রিবিহীন আমেরিকার গ্রামে বাস করা নারীর রাজনৈতিক উদ্বেগ এক হবে না। এরা আবার কেউ-ই একজন দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে যে সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়, সেই সমস্যা মোকাবেলা করেনি।
হিলারি ক্লিনটনের শ্বেতাঙ্গ নারীদের ভোট অর্জনের ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে,রাজনীতিতে সাদা-কালোর বিভাজন যেভাবে ভূমিকা পালন করে, নারী-পুরুষের বিভাজন সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারে না। সিমিয়েনের বক্তব্য হচ্ছে রিপাবলিকান নারীরা, হিলারি ক্লিনটন শুধুমাত্র নারী হবার কারণে তাদের রিপাবলিকান অনুগত্য পরিত্যাগ করে হিলারির পিছনে এসে দাঁড়ায়নি। কিন্তু,২০০৮ সালের নির্বাচনে রক্ষণশীল কালোরাও বারাক ওবামার সমর্থনে রাজপথে র্যালি করেছিলো।
ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের সাইকোলজি প্রফেসর ক্রিস্টিন এন্ডারসন বিষয়টাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন পিতৃতন্ত্র দিয়ে। তাঁর ভাষায়, ঐতিহাসিকভাবে শ্বেতাঙ্গ নারীরা কিছুটা হলেও নিরাপত্তা পেয়েছে। কিন্তু, কালো নারীরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সে কারণে,ট্রাম্পের বিষয়ে সাদা নারীর যেভাবে গলে গিয়েছে, কালো নারীরা সেভাবে গলে নি। তাঁর ভাষায়, পিতৃতন্ত্র, যেটা নারী-পুরুষের অসাম্যে বিশ্বাসী, সেখানেও নারীরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে কিছু কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। সেজন্য অনেক সময় তারা যে পিতৃতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছে সেটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। বরং শক্তিশালী দল হিসাবে বিদ্যমান পুরুষের কাছ থেকে স্বীকৃতি এবং সুফল পাবার জন্য তারা তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা চালায়। এদের কারণে তারা দৃশ্যমান হবে, এটাই তারা ভেবে থাকে। অনেকটা সূর্যের কাছ থেকে আলো ধার করে নিজের চন্দ্রালোকিত চেহারা অন্যকে দেখানোর মতো।
ট্রাম্পের অশ্লীল কথাবার্তায় বিশ্বাস করেনি শ্বেতাঙ্গ নারীরা, তার লাম্পট্য দেখে কেউ পালিয়ে যায়নি। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা অসংখ্য যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছে তারা। লৈঙ্গিক গবেষণা বিশেষজ্ঞদের মতে পিতৃতন্ত্রকে নারীরা নিজেদের মতো করে বুঝে নিয়েছে। অনেক শ্বেতাঙ্গ নারীদের কাছে পিতৃতন্ত্র খারাপ কিছু না। কারণ এই সিস্টেমের মধ্যে থেকে যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করে তারা, এখান থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পায় তারা।
পিতৃতন্ত্রের বাধা-ধরা নিয়মে চললে সবাই পছন্দ করে, সমাজের জন্য তাকে সমস্যা হিসাবে ভাবা হয় না। এই ভিত্তিতে নারীদের দুইভাগে ভাগ করে ফেলা হয়। একদল হচ্ছে ভদ্র-নম্র অনুগত নারী। আর অন্যদল হচ্ছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, খুব বেশি সচল। এরা হচ্ছে হিলারি ক্লিনটন। নারীর বৈষম্য শুধু বেতনের বৈষম্য নয়, নয় শুধু নারীর প্রতি সহিংসতাতে। এই বৈষম্য খুব নীরবে কাজ করে যায় ব্যক্তির অন্তরের গভীরে।
বর্ণবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক শ্বেতাঙ্গ পুরুষরা ট্রাম্পের দেখানো উচ্চ আয়ের, অভিবাসীবিহীন যে আমেরিকার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, সেটা শ্বেতাঙ্গ নারীদেরকেও স্পর্শ করেছে। এই পিতৃতন্ত্রে অন্য নারীদের মতো তারা পিষ্ট নয়, বরং কিছুটা সুবিধাভোগীই। ফলে, ট্রাম্পের প্রবল নারী বিদ্বেষী ওইসব কর্মকাণ্ডকে উপেক্ষা করেছে তারা এই স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে থেকে। বর্ণবাদ, জাতি-বিদ্বেষ, জাতি-ঘৃণা, এমন এক জিনিস, হাজার ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ঘষে ঘষে মন পরিষ্কার করলেও, কোথাও না কোথাও ঠিকই কালো একটা দাগ লুকোনো অবস্থায় থেকে যায়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য