আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

লন্ডন হামলা: চাইলেই কি দায় এড়ানো যাবে

জুয়েল রাজ  

দীর্ঘ শীতের প্রকোপ কাটিয়ে ব্রিটেনে বসন্ত আসি আসি করছে, ২২ মার্চ সেরকম একটা দিনই ছিল, বেশ ঝলমলে একটা দিন। কিন্তু বিকেলটা সে রকম ছিল না। সন্ত্রাসী হামলায় সব উলটপালট করে দিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে আক্রমণকারী খালিদ মাসুদের সহযোগী একজন নারী সহ মোট ৮ জনকে আটক করেছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মারা গেছেন মোট ৪ জন, আহত হয়েছেন ২৯ জন। তাদের মধ্যে ব্রিটেনের ১২ জন, ফ্রান্সের ৩ শিশু, দুইজন রোমানিয়ান, ৪ জন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক, দুইজন গ্রীসের নাগরিক, পোলিশ, আইরিশ, চাইনিজ, ইতালিয়ান, আমেরিকান নাগরিক ছিলেন। মাল্টিকালচার নগরী ব্রিটেনেরই প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে আয়শার মৃত্যু অনেককেই খুব বেশী শোকাহত করেছে, আয়েশা তাঁর কলেজ শিক্ষকতা শেষ করে নিজের সন্তানকে স্কুল থেকে নিতে যাওয়ার পথে ব্রিজের উপর গাড়ি চাপায় মারা যান।

লন্ডনে পার্লামেন্ট হামলার পরের দিন ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় হাজার হাজার মানুষ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান জানাতে, নিহত ও আহতদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাতে মোমবাতি হাতে সমবেত হয়েছিলেন লন্ডনের ঐতিহাসিক ট্রাফলগার স্কয়ারে। মাল্টিকালচার নগরী হিসাবে, ঐক্যবদ্ধ এক লন্ডনের বার্তা দিয়েছেন সেখানে উপস্থিত লন্ডনের সাধারণ মানুষ।

ব্যক্তিগত লন্ডন জীবনের প্রায় ১ দশক হতে চলল, ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশ দেখার ও সুযোগ ঘটেছে উদারতা, ভদ্রতা, মানবতার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান হচ্ছে ব্রিটেন। একটা সময় ছিল আমাদের পূর্ব প্রজন্মকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে। যদিও এখনো অনেকে বলেন ব্রিটেনে অদৃশ্য বর্ণবাদ রয়ে গেছে। কিন্তু সাদা চোখে আমরা উদার ব্রিটেনকেই দেখি। তিনজন শুধু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সংসদ সদস্যই আছেন সংসদে, এর বাইরে ভারত,পাকিস্তান শ্রীলংকা সহ, ইউরোপ ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত অনেক সদস্য আছেন ব্রিটেনের সংসদে। এশিয়াতে যা চিন্তাও করা যায়না। এক নির্বাচনী এলাকা থেকে অন্য নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে নির্বাচন করলেই তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়ে যায়।

লন্ডনের এমন কোন শহর নেই যে শহরে কোন মসজিদ নেই, পূর্ব লন্ডনের কয়েক কিলোমিটার স্কয়ারে শতাধিক মসজিদ মাদ্রাসা আছে। মন্দির আছে, প্রতিবছর ঢাকঢোল পিঠিয়ে নেচে গেয়ে দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়ে থাকে, শিকদের গুরুদুয়ারার অনুষ্ঠানে ও দেখেছি প্রতিবছর রাস্তাঘাট দখল করেই তাঁরা ফলমূল সহ নানা ধরণের খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করে থাকেন।

আজ পর্যন্ত কোন মসজিদে আক্রান্ত হয়নি। কোন মন্দিরে ঢিল পড়েনি। ইস্ট লন্ডন মসজিদে মাঝে মাঝেই ব্রিটেন ফার্স্ট নামে একটি বর্ণবাদী রাজনৈতিক দল নানারকম প্রতিবন্ধকতা করার চেষ্টা করে, সেখানে পুলিশ, নানা ধর্মের বর্ণের কমিউনিটির সাধারণ মানুষ এদের প্রতিরোধ করার জন্য রাস্তায় নেমে আসে। যে শহরে গাড়িতে কেউ হর্ন বাজায় না সেখানে মাইক বাজিয়ে আজান দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নিজের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় পোশাককে গ্রহণ করে নিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে কোনভাবেই বিঘ্নিত করছে না। যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পর ও যখন এই দেশ ও দেশের সংস্কৃতিকে আপনি ঘৃণা করবেন, সেই দেশের মানুষকে ঘৃণা করবেন। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিকৃতি ঘটিয়ে মানুষ হত্যায় জড়িয়ে যাবেন। সেই দেশের মানুষ কি স্বাভাবিকভাবে নিবে?

পার্লামেন্টে হামলার পর কোথাও এখন পর্যন্ত মুসলিম বিরোধী কোন প্রচারণা বা ঘৃণা প্রকাশের কোন ঘটনার সংবাদ আসে নাই। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দায়িত্ববান প্রতিটা বিভাগ থেকে একে স্রেফ সন্ত্রাসী ঘটনা হিসাবেই বক্তব্য রাখছেন সবাই। ইউনাইটেড ব্রিটেনের কথা বলছেন। ঘটনার পরদিন সংসদ অধিবেশনে লাইভ দেখছিলাম দীর্ঘ সময়। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে যেখানে ব্রিটিশ বাংলাদেশী দুই এমপি রুশনারা আলী ও টিউলিপ সিদ্দিকও বক্তব্য রেখেছেন। টিউলিপ সিদ্দিক বলেন, ইসলামের নামে যারা এদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায় তারা এই শহরে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে না। দুনিয়ার কোথাও তারা মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করে না।

আরেক এমপি রুশনারা আলীও এ হামলার ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। এ ধরনের হামলা প্রতিরোধে তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দেন। লন্ডন মেয়র সাদিক খানও একই বার্তা দিয়েছেন লন্ডনবাসীকে। ‘লন্ডন বিশ্বের বৃহত্তম শহর। সন্ত্রাসবাদের কারণে আমরা ভীত হব না। যারা আমাদের ক্ষতি করতে চায়, আমাদের জীবন-যাপনকে বিধ্বস্ত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে আমরা একসঙ্গে রুখে দাঁড়াব। আমরা এভাবে সবসময় আছি, সবসময় থাকব।

হামলায় নিহত পুলিশ অফিসারের পরিবারের জন্য সাহায্যের আবেদন জানানোর পর একদিনেই তিনশত হাজার পাউন্ড জমা পড়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যম। আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে মুসলিম সম্প্রদায় থেকে ১৭ হাজার পাউন্ড সেই ফান্ডে জমা হয়েছে। ব্রিটেনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ করে ফেইসবুক ও হোয়াটসআপের বিভিন্ন গ্রুপে লন্ডন পুলিশের বিবৃতির একটি অংশ ভাইরাল হয়ে গেছে, যেখানে লন্ডন পুলিশের পক্ষ থেকে মুসলিম নারী ও তরুণদের সাবধানে চলাফেরা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, একা একা না চলে কয়েকজন একসাথে চলারও পরামর্শ বলা হয়েছে

সবচেয়ে শক্ত অবস্থান দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। তিনি সংসদে বলেন সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের গণতন্ত্রকে নীরব করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু একটি বার্তা দিতে আজ আমরা স্বাভাবিকভাবে একত্রিত হয়েছি। যেভাবে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম একত্রিত হয়েছিলেন এবং যা পরবর্তী প্রজন্ম বজায় রাখবে। বার্তাটি হলো: আমরা ভীত নই এবং সন্ত্রাসবাদ দিয়ে আমাদেরকে সংকল্প থেকে সরিয়ে আনা যাবে না।

সরকার বা প্রশাসন তাঁদের জায়গা থেকে বক্তব্য রাখছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাবনা আর সরকারের ভাবনা এক নয়। স্কাই লাইভে যারা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন তারা কেউ সরাসরি কেউ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মুসলমানদেরই দায়ী করছেন। কারণ বিশ্বজুড়ে যতো হামলা হচ্ছে বা নিকট অতীতে হয়েছে সবগুলো ঘটনাতেই মুসলমানদের জড়িত থাকার ঘটনা ঘটছে। ঘটনাটা এমন যে। সব মুসলমান জঙ্গি নয়, কিন্তু সব জঙ্গিই মুসলমান। গত সপ্তাহে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর ব্রিটেনে বর্ণবাদ বিরোধী এক বিশাল র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, কিন্তু সপ্তাহ না পেরুতেই ঘটে গেল সংসদে হামলার মতো ঘটনা। জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করেনা বক্তব্য দিয়ে কি সন্ত্রাসবাদের দায় এড়ানো সম্ভব?

এর দায় নিয়েই একে মোকাবেলা করার পথ বের করতে হবে। ব্রিটেনে জন্ম নেয়া প্রজন্মই সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ছে সবচেয়ে বেশী। যারা আপনার আমার পরিবারেরই কেউ না কেউ। সমস্যার গভীরে না গিয়ে, সমস্যা চিহ্নিত না করে, ঘটনা ঘটার পর দায় এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিভাবে, কোথায়, কখন আপনার সন্তান বা পরিবারের সদস্যটি জঙ্গিবাদের দীক্ষা নিচ্ছে সেই জায়গাটি সন্ধান করে সেখানে 'মলম' দিন। অন্যথায় কোনভাবেই এর উপশম ঘটবে না।

প্রতিটা ঘটনার পরেই আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র আমাদের জাতিগত কারণে। কোন এশিয়ানের উপর যখন আক্রমণ হয় তখন ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে তাঁর গায়ের চামড়া ও চেহারাই প্রাধান্য পায়।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ