প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ১৩ মে, ২০১৭
স্বস্তির নিঃশ্বাস শুধু ফ্রান্সের নয়, পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় নিশ্চয়ই অনেক বড় ঘটনা। এই জয়ের ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বিশ্ববাসী। ফ্রান্সেও শোনা গিয়েছিল ভিন্ন সুর। বয়ে গিয়েছিল চরম দক্ষিণপন্থী ঝড়ের পূর্বাভাস! মেরিন লে পেন দ্বিধাহীন ভাষায় প্রচার করেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া তো মাত্রই প্রথম ধাপ, ফ্রান্সকে নিয়ে যেতে চান চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির দিকে। সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করার বার্তাও পরিষ্কার ছিল। ফরাসি বিপ্লবের দেশ উগ্র জাতীয়তাবাদী পথে যাবে ভেবে শঙ্কিত হচ্ছিলেন পৃথিবী জুড়ে সহিষ্ণু মানুষ।
কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে, মার্কিনিদের মতো ফরাসীরা মাথা-খারাপ জাতি নয়! ইমানুয়েল ম্যাক্রনের পক্ষেই ফরাসি জনতা রায় ঘোষণা করেছে, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন উগ্র ডানপন্থি প্রার্থী মেরিন লে পেন।
ইতিহাস গড়েছেন ইম্যানুয়েল ম্যাক্রন। নেপোলিয়নের পর তিনিই ফ্রান্সের কনিষ্ঠতম প্রশাসক। গত ৬০ বছর ধরে ফ্রান্সে ডান ও বামপন্থী শাসকদের রমরমা ছিল। ভুরি ভুরি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও, দেশকে ক্রমশ বেকারত্ব, দুর্বল অর্থনীতি এবং নিরাপত্তাহীনতার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন তাঁরা। প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে ‘আনকোরা’ ম্যাক্রনকেই দেশের প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছেন ফরাসিরা।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাগরিকরা দ্বিতীয় বার এমন একটা `ধর্মসংকটের’ মুখোমুখি হয়েছেন। নিজেদের রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিভেদ সরিয়ে রেখে তাঁদের চরম দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট দলের মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর আগে, ২০০২ সালে উপনিবেশবাদী ফ্যাসিস্ট দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের কর্ণধার জঁ মারি ল্য পেন সোশ্যালিস্ট প্রার্থী লিয়নেল জসপ্যাঁকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় তথা চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে গিয়েছিল। ফ্রান্সের মানুষ সেই ঘটনায় প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী জ্যাক শিরাককে বিপুল ভোট দিয়ে জয়ী করেন, ল্য পেন প্রত্যাখ্যাত হন।
কিন্তু গত পনেরো বছরে ফ্রান্সের সমাজ অনেক বদলে গিয়েছে। ন্যাশনাল ফ্রন্টের বিরুদ্ধে সংহতি এখন অনেক দুর্বল। দুই প্রধান দল, রিপাবলিকান এবং সোশ্যালিস্টরা কেউই দ্বিতীয় পর্বের দৌড়ে নেই। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বেড়ে চলা বৈষম্য, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস, সরকারি পরিষেবার অবক্ষয়, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়, ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগের সিদ্ধান্ত— সব মিলিয়ে মানুষের মনে এই ধারণা জোরদার হয়েছে যে, বিশ্বায়ন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যর্থ। অভিবাসী এবং ইসলামের প্রতি সমাজে বিরূপ মনোভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতি-রাষ্ট্র এবং তার সীমান্তের মহিমা উত্তরোত্তর বাড়ছে। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ায় হানাহানি এবং আফ্রিকায় ভূতপূর্ব ফরাসি উপনিবেশগুলিতে অস্থিরতার ফলে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থীর প্রবাহে পরিকাঠামো ও পরিষেবার ওপর আরও চাপ পড়েছে। ফ্রান্সের ভূখণ্ডে স্বদেশি ও বিদেশি সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি আক্রমণ বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রধানত ফ্রান্সের প্রাক্তন উপনিবেশগুলি থেকে আসা অভিবাসীদের সমাজের অঙ্গীভূত করে নেওয়ার কাজটা ভালো ভাবে হয়নি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেকারত্বের চাপ। ২০০২ সালে ফ্রান্সে বেকারত্বের অনুপাত ছিল প্রায় ৮ শতাংশ, ২০১৭ সালে সেটা ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ২৪ বছরের কম বয়সিদের ক্ষেত্রে অনুপাতটা ২৪ শতাংশ।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ইমানুয়েল ম্যাক্রন অনেক দিক থেকেই গতানুগতিক ধারার বাইরে। তাঁর বয়স মাত্র ৩৯। কোনও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই তাঁর। এক বছর আগে অঁ মার্শ (অভিযাত্রা) নামক একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তিনি। তিনি অতীতে ওলাঁদ-এর অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন, ওলাঁদ প্রেসিডেন্ট হয়ে তাঁকে অর্থমন্ত্রী বানান। গত অক্টোবরে তিনি সেই মন্ত্রিপদে ইস্তফা দেন। তিনি বাম বা দক্ষিণ, দুই পন্থা থেকেই নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন, এমনকি তাঁকে মধ্যপন্থীর তকমা দেওয়াও শক্ত। এটা দেশের সমাজে ও রাজনৈতিক মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্বে তিনি প্রায় ২৪ শতাংশ ভোট পেয়ে এক নম্বর স্থানে ছিলেন। তিনি বড় ব্যাঙ্ক এবং অর্থ লগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অতীতে রথসচাইল্ড ব্যাঙ্কের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত থেকেছেন।
অন্য দিকে, ন্যাশনাল ফ্রন্ট নেত্রী মারিন ল্য পেন উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সঙ্গে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে নিজের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন। তিনি জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন।
রাজনীতির বাইরেও ৩৯ বছরের ম্যাক্রন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এক ব্যতিক্রমী মানুষ। উত্তর ফ্রান্সের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ার সময় অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল। নিয়মিত নাটকে অভিনয় করতেন। সেখানে শিক্ষকতা করতেন ব্রিজিত ত্রগনিউ। পাশাপাশি একটি থিয়েটার কোম্পানিও চালাতেন। সেখানেই দু’জনের আলাপ। ৪০ বছর বয়সী ব্রিজিতের তখন সবে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। কাঁধে তিন সন্তানের দায়িত্ব। ম্যাক্রনের বয়স তখন সবে ১৫। বয়সের পার্থক্য প্রায় ২৫ বছর। তা সত্ত্বেও প্রথম দেখাতেই ব্রিজিতকে ভালবেসে ফেলেন তিনি। তাঁর আকর্ষণ এড়াতে পারেননি ব্রিজিতও। দু’জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। বয়স নিয়ে ফরাসিদের মধ্যে অত মাথাব্যথা না থাকলেও, বয়স্ক নারীর সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি ম্যাক্রনের মা–বাবা। আবার ছেলের ব্যক্তি স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করতে চাননি। অতঃপর ম্যাক্রন যতদিন না প্রাপ্ত বয়স্ক হন, ব্রিজিতকে দূরে সরে যেতে নির্দেশ দেন তাঁরা। ১৭ বছর বয়সে ম্যাক্রনকে প্যারিসে পাঠিয়ে দেন। বাক্স–প্যাঁটরা নিয়ে ব্রিজিতও পৌঁছে যান ভালোবাসার শহরে। ২০০৭ সালে রীতিমতো ঘটা করে ব্রিজিতকে বিয়ে করেন তিনি। ব্রিজিতের তিন সন্তান এখন বড় হয়ে গিয়েছে। একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন ডাক্তার এবং আর একজন আইনজীবী। তাঁদের সঙ্গে ভাব রয়েছে ম্যাক্রনের। এমনকি ছয় নাতিপুতির সঙ্গেও।
নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে নিজের পরিবারকে কখনও লুকিয়ে রাখেননি ম্যাক্রন। যখনই প্রচারসভায় গিয়েছেন, সঙ্গে থেকেছেন ৬৪ বছরের ব্রিজিত। লেখালেখির কাজে তাঁকে সাহায্যও করেছেন। বিজয় সম্বর্ধনার অনুষ্ঠানে নাতি–নাতনিদের পাশে নিয়ে, স্বামীর হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে তখন ভেজা চোখে দেশবাসীকে নীরবে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন ব্রিজিত।
ফ্রান্সের এ বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুটি ধারণা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে: ‘সিস্টেম-বিরোধী’ এবং ‘বিকল্প’। চূড়ান্ত পর্বের দুই প্রার্থীই মূলধারার বাইরে থেকে এসেছেন, তাঁরা কেউই দেশের আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার দায়ভাগ স্বীকার করেননি। দুজনেই বলেছেন, বর্তমান সিস্টেমই সংকটের মূলে। দুজনেই প্রচলিত কাঠামোটা পালটানোর কথা বলেছেন। কী ভাবে? যদিও সেই উত্তর মেলেনি।
ম্যাক্রনকে আগামী দিনগুলোতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ইতিমধ্যে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পেন নবোদ্যমে দল ও তাঁর রাজনীতি মেরামতের কাজে নেমে পড়েছেন। এই বিমুখ বিরোধীদের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে ম্যাক্রনকে প্রমাণ করতে হবে, তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলি অসার ছিল না। প্রমাণ করতে হবে, ইউরোপের সঙ্গে ফ্রান্সের বন্ধনের মধ্য দিয়েও ফরাসি অর্থনীতি এবং সমাজের যথেষ্ট কল্যাণসাধন সম্ভব। এবং এই কল্যাণ কেবল বায়বীয় আদর্শভিত্তিক নয়, বাস্তব সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। ফ্রান্সের পরিবেশ অনেক কাল থেকেই বিনিয়োগ-বান্ধব নয়। অথচ সেই পরিবেশের পরিবর্তন ছাড়া ম্যাক্রনের লক্ষ্যসাধন বেশ দুরূহ।
গণতন্ত্র ও উদারতন্ত্রের বিপন্নতার দিনে গভীরবিভক্ত সমাজ ও স্থবির অর্থনীতিকে কী ভাবে তিনি সামলান, কিংবা আদৌ সামলাকতে পারেন কি না, সেই দিকে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে বিশ্ব।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য