আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

রাজনীতির দর্শন

আরশাদ খান  

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে হতে হয় মানবিক। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও মানবিক আচরণের আদর্শসমূহ আত্মস্থ করে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে হয়। যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আস্ফালন, উন্মাদনা ও উন্নাসিকতা টেকসই গণতন্ত্রের জন্য বিস্ফোরক বৈকি।

রাজনীতির দর্শন তাদের মনে গ্রোথিত ও প্রোথিত করার মহান ভূমিকা রাজনীতিকদেরই নিতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে রাজনীতিকে শুধুমাত্র অনার্স কিংবা মাস্টার্সের বিষয় বানালে চলে না। স্কুল কলেজেও এর ব্যাপক প্রচার প্রচারণা প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করা জরুরী। তৃণমূলের রাজনীতিই মানবিক রাজনীতি। আদর্শিক রাজনীতির চর্চাকেন্দ্র হচ্ছে এই তৃণমূল। বাজারে কেনাবেচার নেতৃত্বকে নিরুৎসাহিত করা খুবই জরুরী।
 
অর্থ দিয়ে রাজনীতি কেনাবেচা  হয়। সেরের দরে। ৫০০ টাকায় মানুষের বিবেক ও আদর্শ ও মূল্যবোধকে কেনা যায় ভোটের বাজারে। ভোটাররা ভোট দেয় হুজুগে। নিজের বিবেচনার বিছানায় অন্যেরা ঘুমায়। ভোট হচ্ছে একটি রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন তল যে তলে দলগুলো জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রিক চেহারা দেখতে পায়। ভোটারদের মাঝে ভোট, নির্বাচন, গণতন্ত্র, নেতা, নেতৃত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে পারলে রাজনৈতিক বৈকল্য হতে বের হয়ে আসার একটি সুগম পথ রচিত হতে পারে।

ভোটের দিনে দলীয় কিংবা প্রভাবশালীদের নির্দেশে এমনকি স্বামীর কথামত স্ত্রীর ভোট প্রদানের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা দরকার। এক্ষেত্রে ‘গুরুভক্তির জায়গায় স্বভক্তির’ একটি শক্তবেদী প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। যদি ১০০% জনগণ ন্যূনতম শিক্ষিত হতো তবে গণতান্ত্রিক মননের একটি পূর্ণাঙ্গ অবয়ব সমাজ পেত।

স্বচ্ছ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সব রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত বিষয়। ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা তৈরি করার লোভে উন্মত্ত হতে পারলে যেকোনো সরকারই যুগে যুগে ক্ষমতায় থাকতে পারে জনগণের মতের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির উপর ভর করে। ভোট কারচুপির সূক্ষ্ম ও স্থূল থিওরির খোলনলচে থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। মেনে নেয়ার সংস্কৃতিই গণতান্ত্রিক রুচিশীলতার পরিচায়ক। হত্যা, গুম, রাহাজানি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, আগুনসন্ত্রাস কোন সুস্থ রাজনৈতিক ধারার উপাদান নয়। সম্মতি ও সমন্বয়ের রাজনীতি চর্চার একটি অবারিত ক্ষেত্র তৈরি করা কল্যাণকামী ও কল্যাণমুখী রাজনীতির দর্শন হওয়া উচিত।

শোষণহীন, সাম্যের ও অসাম্প্রদায়িক সমাজগঠনই মহান মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মূল দর্শন ছিল। কালক্রমে আমরা কি দেখতে পাই। রাজনীতির দর্শন উন্নয়নের চাকায় বেগ দেয়ার কথা থাকলেও তা সব দৃশ্যপটে ইতিবাচক পরিবর্তনে সক্রিয় বেগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী এমনকি কিছু কিছু সাংসদরা নাকি কাড়ি কাড়ি টাকা বিদেশে পাচার করছেন। দ্বিতীয় হোম বানাচ্ছে দেশে দেশে। অসহায়, দুস্থ, গরীব মানুষেরা যখন গৃহহীন হয়ে পথে পথে ঘুরছে। আমাদের মতন একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে এখনও মাথাপিছু আয় ১৬০২ মার্কিন ডলার, অতি দারিদ্রের হার ১২.১%, দারিদ্রের হার ২৩.৫%, এখনও ২০% এরও বেশী মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা বঞ্চিত তখন কী করে ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীয় ডিপোজিটধারীদের রিজার্ভ ২০.১৮% বেড়ে যায় ২০১৫ সালের তুলনায়, যা ২০১৪ সাল হতে ক্রমাগত বেড়ে চলছে।

অর্থমন্ত্রী তো একরকমের বলেই ফেললেন যে, মুদ্রাপাচার সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এতে করে যা হচ্ছে তা হলো জনগণ কিন্তু দলের উপর আস্থা হারাচ্ছে যা কি না রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর আস্থাহীনতার সামিল। মনে রাখতে হবে বর্তমানে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনধারীরা ক্ষমতায়। দেশবাসীর  প্রত্যাশা তাদের কাছে অনেক বেশী এবং জোরালো। তাহলে রাজনৈতিক বৈকল্য প্রদর্শনের মহড়া যেন না চলে।

যদি আইনের শাসন পুরোপুরি মেনে চলা হতো, প্রকৃতপক্ষেই যদি গরীব দুঃখী অসহায় মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করা হতো তবে বর্তমান বাংলাদেশের দৃশ্যপট দ্রুতগতিতেই পরিবর্তিত হতো। সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, ন্যায়বিচার ইত্যাদির ক্ষেত্রগুলো শক্তিশালী হলে, ধর্ষক তুফান সরকারদের যদি আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যেত, যদি তনু, রূপাদের মত নারীদের ধর্ষিত হয়ে ধর্ষকদের প্রকাশ্য উম্ফলন না দেখতে হতো তবে মানব উন্নয়ন সুচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯তম না হয়ে আরও এগিয়ে থাকত। কেন শিক্ষার হার এখনও ৬৩.৬% এ থমকে আছে, কোন দর্শনে চলছে রাজনীতি?

রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নেতা তৈরির  পদ্ধতিটি কতটা গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বোধহয় একটি দুর্বল দিক হলো ‘যে কেউ নেতা’ হওয়া যায়। প্রথম শর্ত টাকাওয়ালা হতে হবে। নমিনেশন নাকি কেনা যায়। ব্যবসায়ীরা তো এক্ষেত্রে এগিয়ে। সংসদে উনাদের অংশ ৫০% এরও উপরে। যদি তাই হয় তবে সংসদ ভবনকে চেম্বার অফ কমার্স এর হেড অফিস বানালেই হয়। ভালো কথা অতো যখন ব্যবসায়ী তখন জিডিপি ১০% এর উপরে হয় না কেন। তারা তো চমৎকার চমৎকার ব্যবসায়িক পলিসি বের করে অর্থনীতির অবয়ব পরিবর্তন করতে পারত। তারা কি সবাই উচ্চ শিক্ষিত? প্রশ্ন জাগে যারা ৫০% সাংসদ ব্যবসায়ী তারা কি বঙ্গবন্ধুকে পড়েছেন?

আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যক্ষ সাহেবরাও সংখ্যায় কম নন। ব্যবসায়ীরা যখন সরকারের অংশ হয় তখন সরকারের উপর প্রভাব বলয় সৃষ্টি তো তাদের জন্য কোন কঠিন বিষয় নয়। ব্যাংকিং ব্যবসা, ইউনিভারসিটির নামে সার্টিফিকেট ব্যবসা, আত্মীয় স্বজনদের নামে ডিলার ব্যবসা, বাস ট্রাক জাহাজ নিয়ে ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা ইত্যাদি সব সহজ হয়। এই অবস্থা হলে রাজনীতির ছাত্ররা কি করে খাবে। কোন দর্শনে রাজনীতি চলে বোধগম্য নয়। এসব অ-রাজনীতি থেকে বের হতে হবে টেকসই গণতন্ত্রের স্বার্থে।

সংসদ ভবনে যে সব বাক্য বিনিময় হয় তা তো সুস্থধারার পরিচায়ক নয়। যেখানে আইন প্রণয়ন ও তার ভালো মন্দ দিকসমূহ বিবেচনার গভীর পর্যালোচনা হওয়ার কথা তা কি সেখানে হয়। সংসদ ভবন তো সাংসদদের গলার জোর মাপার পরীক্ষার হল নয়, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা প্রদর্শনের ক্ষেত্র। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সংসদ পরিচালিত হয়। প্রতি সেশনে প্রতিদিনে যে খরচ হয় তা কোথা থেকে আসে তা মাননীয় সাংসদদের ভাবতে হবে। গালিগালাজ চর্চা করা কি সংসদীয় আচরণের আওতাভুক্ত?

প্রতিশ্রুতির সরকার ও প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন এবং উন্নয়ন সম্ভব নয়। নির্বাচনী ইশতেহারে যা যা থাকে তা তা সরকার গঠনের পরে স্ব-নির্ধারণী ইশতেহারে পরিণত হয়। নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার সবরকমের ভণ্ডকৌশলের ভ্রমজালে সাধারণ মানুষের আবেগকে আটকে নির্বাচনী বৈতরণী পার পাওয়া সরকারসমূহ পরবর্তীতে দুর্নীতির চক্রে নিজেদের আবদ্ধ করে পরাক্রমশালী ও পরাভব হয়ে ওঠে। দুর্নীতির চাষ শুরু করে তাদের মেধা ও মননের জগত জুড়ে। প্রতিহিংসার দ্বারে টোকা মেরে ঢুকে পড়ে উন্মাদের আহ্লাদখানায়। মাঠে ফলায় আগ্রাসনের রাজনীতি। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় চলে নিরন্তর পথ চলা। তবে ব্যক্তি উন্নয়নের পরিবর্তন-সমাজ পরিবর্তনে নয়। দলীয় লোকজনের উপর সুদৃষ্টি ও তাদেরকে সুবিধা নিয়ে দেয়া সব রকমের সভ্যতা ও ভব্যতার শৃঙ্খল ভেঙে আগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করে।

সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিনির্মাণ এবং কল্যাণমুখী কাজের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো তখনই সম্ভব যখন প্রজাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রক সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত অনুশাসন, নিয়ামাচার, আইনকানুনের সঠিক, সময়োপযোগী, বাস্তবমুখী প্রয়োগে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হয়। যখন নেতৃত্বের মধ্যে কল্যাণকামী মনোভাবের অবাধ বিচরণ থাকবে, মানবিক হবে, স্বার্থকেন্দ্রিক না হয়ে পরার্থে নিজেদের বিসর্জন দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে, কোটি টাকার গাড়ি না হাঁকিয়ে পায়ে হেঁটে জনগণের কাছে যাবে, তাদের সুখ দুঃখের অংশীদার হবে তখনই রাজনীতির দর্শন রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। আর এজন্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দর্শনের প্রতি নিবেদন তৈরি এখন একটি সময়ের দাবি।

আরশাদ খান, ব্যাংকার, সংস্কৃতিকর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ