প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ইমতিয়াজ মাহমুদ | ১৩ জুলাই, ২০১৮
লাকি আক্তার সম্পৃক্ত আছেন এমন কোন প্রসঙ্গে নির্মোহভাবে কিছু লেখা কঠিন। লাকি বয়সে ও আকৃতিতে ছোট মানুষ বটে, কিন্তু এই শতকে আমাদের এই হতভাগা দেশের রাজনীতিতে এইরকম প্রভাব সৃষ্টিকারী আরেকজন নেতা এখনো আসেনি। এটা আমি ভেবেচিন্তেই বলছি, এবং রাজনীতি বলতে আমি কেবল ছাত্র রাজনীতির কথাই বোঝাচ্ছি না। তিনি মানুষের মধ্যে সাহস ও আশা জাগিয়েছেন নানাভাবে- সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আমার সাথে আপনারা এই নিয়ে তর্ক করতে পারেন, বিভিন্ন গুণে লাকির চেয়ে উত্তম অনেককেই এনে হাজির করতে পারেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে- কিন্তু আপনিই বিচার করে দেখেন যে কথাটা বললাম সে কথাটা ভুল বলেছি কিনা। ফলে লাকি আক্তার প্রসঙ্গে কথা বললে একরকম আবেগ ও পক্ষপাতিত্ব চলেই আসে।
তার পরেও আমি চেষ্টা করছি সম্প্রতি লাকি আক্তারের বাসায় যে পুলিশি অভিযানটা হয়েছে সেটা আর এর পরে আমাদের মধ্যবিত্ত 'সভ্য সমাজ' লাকির বিরুদ্ধে যে গালি অভিযানটা পরিচালনা করছে সেটা নিয়ে যতটুকু সম্ভব নির্মোহ ও পক্ষপাতহীন পেশাদারি দৃষ্টি থেকে আলোচনা করতে।
প্রথমে লাকির বাসায় পুলিশের অভিযান আর সেখান থেকে কোটা আন্দোলনের এক নেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গটা ধরেন। এই কাজটা অন্যায় হয়েছে এবং আইনগতভাবে অবৈধ হয়েছে। কাজটা বেআইনি হয়েছে। লাকি আক্তারের বাসায় এইরকম বেআইনি পুলিশি হামলার নিন্দা তো আমরা করছিই, সেই সাথে সাধারণভাবে সকল অবস্থায়ই এই ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের নিন্দা করাটা জরুরী।
সেজন্যে আগে বুঝে নিই কাজটা কেন বেআইনি, আর কেন এটা বন্ধ করা জরুরী।
২
আমাদের দেশের সংবিধানে (এবং প্রায় সকল সভ্য দেশের সংবিধানেই) প্রতিটি নাগরিকের ফ্রিডম অব মুভমেন্ট বা দেশের ভিতরে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা আছে। এই অধিকারটি, অন্য অনেক অধিকারের মতোই, আইন দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে। সেই সাথে আরেকটা মৌলিক অধিকার আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত করা আছে, সেটা হচ্ছে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা। এটা আছে সংবিধানের ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে।
কী আছে ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে? ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলছে, যে যখনই কোন নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হবে তখনই তাকে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতেই হবে। আর গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে তার উকিলের সাথে শলাপরামর্শ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সেই সাথে এটাও আছে যে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে অবশ্যই অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। ২৪ ঘণ্টা গোনার ক্ষেত্রে কেবল যাতায়াতের সময়টুকু বাদ দিতে হবে- নইলে ২৪ ঘণ্টা মানে ২৪ ঘণ্টাই। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া এই চব্বিশ ঘণ্টার বাইরে কাউকে পুলিশ আটকে রাখতে পারবে না।
এবার আসেন গ্রেপ্তার মানে কী, সেই প্রশ্নে। গ্রেপ্তার মানে হচ্ছে একজন নাগরিককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটক করা বা তাকে ইচ্ছামতো যেখানে খুশী সেখানে যেতে বাধা দেওয়া। আপনাকে যদি পুলিশ বলে যে, আমাদের সাথে চলেন, আপনাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করবো, সেটা পুলিশ আপনাকে বলতে পারে। আপনি যদি স্বেচ্ছায় গেলেন তো সেটা তাইলে আর গ্রেপ্তার বা এরেস্ট হলো না। কিন্তু পুলিশ যদি আপনাকে জোর করে বা ভয় দেখিয়ে ওদের সাথে যেতে বাধ্য করে, তাইলে সেইটাই গ্রেপ্তার। আর এই যে জিজ্ঞাসাবাদ, সেটা পুলিশ করতেই পারে, কিন্তু জোর করতে পারে না।
৩
তাহলে আমাদের এখানে যে পুলিশ মাঝে মাঝেই লোকজনকে ধরে নিয়ে যায় আর বলে যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ধরে এনেছি, উনাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, সেটা কী? পুলিশ এটা কেন বলে জানিনা, কিন্তু কাউকে যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে থানায় নিয়ে যায়, যে জন্যেই নিয়ে যাক, সেটা অবশ্যই গ্রেপ্তার। এক ঘণ্টার জন্যে নিলে সেটাও গ্রেপ্তার, দশ মিনিটের জন্যে নিলে সেটাও গ্রেপ্তার। পুলিশ যে মাঝে মাঝে 'গ্রেপ্তার করা হয়নি, এমনি এনেছি' বলে এটা মিথ্যা কথা। ওরা যেটা করে সেটা হচ্ছে আপনাকে গ্রেপ্তার করবে সকালে, খাতাকলমে লিখবে যে গ্রেপ্তার করেছে সন্ধ্যায়। এটা অন্যায়, এটা হচ্ছে বেআইনি গ্রেপ্তার, বা ইলিগ্যাল এরেস্ট বা ইলিগ্যাল ডিটেনশন।
এই যে গ্রেপ্তার সম্পর্কে এইরকম কড়াকড়ি সব কথা বলা আছে সংবিধানে, কেন? এমনি এমনিই? অপ্রয়োজনীয় দার্শনিক আলাপ? সুশীল সমাজের বাকোয়াস? জি না। পুলিশের এই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা এর প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ এসবের সাথে জড়িত একটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা। এটা হচ্ছে রাষ্ট্রের আইন ও বিচার ব্যবস্থার একদম কোর বা অন্যভাষায় বলতে পারেন রাষ্ট্রের হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা। যে রাষ্ট্রে নাগরিকদের এইসব অধিকার- ইচ্ছা মতো চলাচলের অধিকার ও ইচ্ছামতো কথা বলার অধিকার নিশ্চিত থাকে না, সেটি কার্যকর রাষ্ট্র নয়।
সেকথা বিস্তারিত বলার আগে দেখে নিন লাকি আক্তারের বাসায় কী হয়েছে সেদিন ভোর বেলা। লাকির ফেসবুক পোস্ট থেকে যেটা জেনেছি, ভোর রাতে সাদা পোশাকে একদল লোক এসে ওদের ঘরের দরজায় নক করে বলে ওরা পুলিশ, দরজা খুলতে হবে, নাইলে দরোজা ভেঙে ফেলবে। লোকগুলি কোন ইউনিফর্ম পরা ছিল না, ওদের পোশাকে কাঁধে বা বুকে কোন ব্যাজ ছিল না, হাতে অস্ত্র ছিল কিনা লাকি বলেননি, অনুমান করি অস্ত্রও ওদের সাথে ছিল। লাকিরা বুদ্ধির কাজ করেছে, বাড়িওয়ালাকে ডেকে এনেছে, সাক্ষি রেখেছে, এরপর ঘরের দরজা খুলেছে। লোকগুলি ঘর তল্লাশি করেছে আর ওদের ঘরে আশ্রয় নেওয়া কোটা আন্দোলনের একজন নেতাকে তুলে নিয়ে গেছে।
তুলে নিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু পুলিশ ওদেরকে বলেনি ছেলেটাকে কোন মামলায় কেন গ্রেপ্তার করছে, বলেছে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। পুলিশ ওদের ঘরও তল্লাশি করেছে, ওদের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলিও তল্লাশি করেছে।
৪
এই কাজটা বেআইনি হয়েছে। বেআইনি কেন? প্রথম কারণ পুলিশ কারো বাসায় একজনকে গ্রেপ্তার করতে গেলে তাদেরকে ইউনিফর্ম পরে যেতে হবে, পরিচয় দিতে হবে। ওদের ইউনিফর্মে ওদের নাম লেখা থাকতে হবে এবং কাঁধে পদ পদবিসূচক চিহ্ন লাগানো থাকতে হবে। যদি এসব না থাকে তাহলে? তাহলে এটা বেআইনি কাজ। এমনিই একজনকে অপহরণ করা আর বেআইনি গ্রেপ্তারের মধ্যে পার্থক্য খুবই ক্ষীণ।
গ্রেপ্তার মানে কী? গ্রেপ্তার মানে হচ্ছে একজন নাগরিককে পুলিশের কাস্টডিতে নেওয়া। বাংলায় আমরা কী বলি? পুলিশের হেফাজতে নেওয়া। শব্দটা লক্ষ্য করবেন।
বেআইনি হয়েছে তার আরেকটা কারণ হচ্ছে ছেলেটিকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সেটা না জানানো। সংবিধান বলছে, আপনাকে গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশকে জানাতে হবে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুলিশও কিন্তু জানে যে গ্রেপ্তার করলে কারণ জানাতে হবে ইত্যাদি। সেজন্যে পুলিশ ওদেরকে গ্রেপ্তারের কথা বলেনি, বলেছে যে এমনিই জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটাও তো আইনত ওরা পারে না। এইজন্যেই সম্ভবত পুলিশ ইউনিফর্ম পরে যায় না।
পুরো কাজটা বেআইনি হয়েছে তার আরেকটা কারণ হচ্ছে ওদের ঘর ও ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলি তল্লাশি করা। এটাও পুলিশ ইচ্ছা করলেই পারে না। পুলিশ যদি আপনার ঘর তল্লাশি করতে চায়, তার আইনানুগ পদ্ধতি আছে। পুলিশ চাইলেই আপনার কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন বা কোন ডিভাইস খুলে দেখতে পারে না। তার জন্যেও আইনানুগ পদ্ধতি আছে। এক্ষেত্রে সেসব কিছু মানা হয়েছে বলে দৃশ্যমান নয়।
৫
আইন মানতে হয়। বিশেষ করে সরকারকে। যে সরকার আইন মানে না, সে সরকারের নৈতিক বৈধতা থাকে না এবং, কোন কোন ক্ষেত্রে সেই সরকার আইনগত বৈধতাও হারায়। কেন?
কারণ সরকারের নির্বাহী বিভাগের ও বিচার বিভাগের সকল সদস্য, মানে কিনা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, স্পিকার সকলকে শপথ নিতে হয় যে ওরা দেশের সংবিধান ও আইন মেনে চলবেন এবং আইন অনুযায়ী সকল কাজ করবেন। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে নির্বাহী বিভাগ, সেই নির্বাহী বিভাগের সকল কাজের জন্যে, সাধারণভাবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দায়ী থাকেন আর তার ক্যাবিনেট দায়ী থাকেন আর স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের জন্যে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়রা দায়ী থাকেন।
এই দায় কার কাছে? প্রাথমিকভাবে সংসদের কাছে এবং সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মালিকের কাছে। তো আমাদের এই যে রাষ্ট্র, আমাদের প্রিয় প্রজাতন্ত্র এর মালিক কে? সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদ দেখুন। রাষ্ট্রের মালিক আমি, রাষ্ট্রের মালিক লাকি আক্তার, রাষ্ট্রের মালিক আপনি। আমরা সকলেই। আর সংবিধান কী? সংবিধান হচ্ছে আমাদের ইচ্ছার অভিপ্রায়। মানে হচ্ছে কিনা আমাদের সরকার কিভাবে নিযুক্ত হবে আর কিভাবে চলবে সেই সম্পর্কে আমাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।
মানে কিনা আমরাই লিখে দিয়েছি, যে, এই যে আপনাদেরকে সরকার বানাচ্ছি, আপনারা এইভাবে এইভাবে চলবেন। শপথ করে বলেন। যাদেরকে সরকার বানিয়েছি ওরা তখন বলেন যে, হ্যাঁ, আমি শপথ পূর্বক বলিতেছি যে আপনারা যেভাবে লিখে দিয়েছেন সেভাবে চলবো।
এখন যদি ওরা সেইভাবে না চলেন? আপনার বাজার সরকার বা অফিস ম্যানেজার বা এপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার হলে কী করতেন? না দেশের সরকারের সাথে তো সেভাবে আচরণ করতে পারবেন না, কিন্তু উনারা যদি ঠিকমতো বা শপথমতো না চলেন তার জন্যে প্রতিবিধানও তো করতে হবে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য