আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ফ্যাসিজম ও ক্ষমতার ঐ বেলুনগুলো

মাসকাওয়াথ আহসান  

আমরা খুব ঘন ঘন আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলে অভিহিত করি। অথচ আমরাই রাজনীতিকদের প্রশ্রয় দিয়ে ফ্যাসিস্ট বা ফ্র্যাংকেস্টাইন হিসেবে তৈরি করি; তারপর কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলি, যে-ই যায় লংকায়; সেই হয় রাবণ।

ভারতের ক্ষমতাসীন নেতা মোদির ফ্যাসিস্ট হবার যথেষ্ট যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু তিনি ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারেননি। কারণ ভারতের নাগরিক সমাজ তাকে সে প্রশ্রয় দেয়নি; ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ভারতের মানুষ তাকে দেয়নি।

আমরা যাদেরকে নিয়ে উপহাস করি, "সিঙ্গারাটা পুরোটাই খেয়ে যাবেন দাদা;" তারা আসলে সৎ মানুষ; নিজের যতটুকু সামর্থ্য ঠিক ততটুকুই আপ্যায়ন অতিথিকে করে। সে জানে সে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত; সৎ ভাবে নিরাপোষ থেকে বাঁচতে গেলে তাকে হিসাব করে খরচ করতে হবে। দৌড়ে গিয়ে মোদির নবরত্নসভা আলো করে সে বলবে না, ভারতে শান্তির সুবাতাস বইছে; মোদিই পারে মোদিই পারবে।

মোদি ক্ষমতায় আসার পরপরই মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে কয়েকশ' গুণী নাগরিক যখন তাদের রাষ্ট্রীয় পদক ফেরত দিলেন; মোদি বুঝলেন, ভারতে ফ্যাসিস্ট হবার স্বপ্ন পূরণের নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার অনুন্নত সংস্কৃতির দেশগুলোর মাঝে ভারতেই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন আছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে, বাক-স্বাধীনতা আছে; সুতরাং শ্রেয়তর গণতন্ত্র আছে। এই গণতন্ত্র টুপ করে আকাশ থেকে পড়েনি। এ গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে নাগরিক সমাজের কংক্রিট শক্তিমত্তায়।

মোদি তোষণ বা মমতাদিদি বন্দনা নিয়ে কোন লোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজির হলেই সবাই বুঝে যায়; এইতো চিন্তার জগতে পিছিয়ে থাকা এই লোকটি মোদি-মমতাকে দেব-দেবীর আসনে বসিয়েছে। এই লোকটি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সমসাময়িক নয়; সে তার জীনগত ধর্ম-ভক্তি চর্চাকে জাতীয়তাবাদ-ভক্তিতে রূপান্তর করেছে। ফলে সে মোদি বা মমতা "অনুভূতি"-র ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ ভারতে সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে থাকা নাগরিক সমাজটি মোদি-মমতার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বলয়টিকে নিম্ন সংস্কৃতি বলে মনে করে। ভারতের নাগরিক সমাজের এই আত্মপ্রত্যয় মোদির ফ্যাসিস্ট হবার বেলুনের হাওয়া নিয়মিত বের করে দেয়।

ফ্যাসিজমের প্রবণতাটি প্রকৃতপক্ষে একটি বেলুনের মতো। অনুন্নত দেশের ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকারই এক একটি ইগোর বেলুন। এই বেলুনে নাগরিকেরা যত হাওয়া দেবে; ফ্যাসিজমের বেলুনটি ততই ফুলতে থাকবে। নিজেরাই একটি বেলুন ফুলিয়ে বিরাট করে ফেলার পর সে ফ্রাংকেস্টাইনের চেহারা নিলে তা নিয়ে বিলাপ অর্থহীন।

এখন ফ্যাসিজমের বেলুনটি ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে পড়ার পর সবচেয়ে বড় বিপদে থাকে বেলুনটি নিজেই। কারণ বেলুনের ফোলারও একটা সীমা আছে। চারিদিকে তেলের বিনিময়ে খাদ্য (তেবিখা) প্রকল্পের লোকেরা নিজের জমে যাওয়া চর্বির সুরক্ষায় যখন ভক্তি-বাতাসে ফু দিতে থাকে, উনিই পারেন, উনিই পারবেন, উনাকেই বার বার দরকার; তখন তারা ফ্যাসিজমের বেলুনটির বাতাসের ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এই বেলুন ফেটে গেলে তখন রাতারাতি তেবিখার লোকদের পথে বসে যেতে হবে। নিজেদের ভবিষ্যতের প্রয়োজনেই এবং বেলুনের সুরক্ষায় তাদের হাওয়ায় পরিমিতি আনতে হয়। অর্থাৎ ক্ষমতা-কাঠামোর ডাল-ভাত খেয়ে তাদের যে কাজের ছেলেদের জেল্লা হয়েছে; সেই কাজের ছেলেদের নিজের দুটি ডাল-ভাত নিশ্চিত করতে ক্ষমতার লোকদের "তেল" দেবার ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে হয়।

যে নাগরিক সমাজ ক্ষমতা-কাঠামোর ইগোর বেলুনের বাতাস নিয়মিত বের করে দিতে জানে; তারাই গণতন্ত্র ও সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। পশ্চিমা গণতন্ত্রের সাফল্যের মূল শক্তি জনগণ। এই জনগণ সুশৃঙ্খল, নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন, বিনয়ী অথচ কাউকে তেল দেয় না; আবার কাউকে অপমানও করে না। আর্থিক বৃত্তে যে যেখানেই থাকুক; সমাজে সবার চোখে সবাই সমান। কোন অফিসের দারোয়ানকে যতটুকু সম্মান দেখায়; ঠিক ততটুকু সম্মান দেখায় অফিস প্রধানকে। আবার সেই দারোয়ান ও অফিস প্রধানও সম্মান জানায় জনগণকে। সভ্য সমাজে কোন মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশ-সেনা কর্মকর্তাকে দেখলেই নাগরিক গিয়ে হামলে পড়ে সেলফি তোলেনা। অর্থাৎ সেলফির যুগেও সভ্য সমাজে ক্ষমতার প্রদর্শনবাদিতার আউটডেটেড বা তামাদি বদ-অভ্যাসটি নেই। ফলে ক্ষমতা-কাঠামোর বেলুনগুলো সুরক্ষিত থাকে; নাগরিক অধিকারও সুরক্ষিত থাকে।

অধিক বাতাসে ফুলে ফ্র্যাংকেস্টাইন হয় না বা সবশেষে ফেটেও যায় না ক্ষমতার ঐ বেলুনগুলো।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ