আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আরও এক জেনোসাইডের জমিন তৈরি হচ্ছে না ত!

সহুল আহমদ  

বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে এবং ঐতিহাসিকভাবে এমন এক অবস্থানে আছে যে তাকে শান্তিতে বসবাস করতে হলে কিছুটা তার প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহের অবস্থার ওপর শর্তায়িত ও নির্ভর থাকতে হয়। ভারত মিয়ানমারে যদি অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে তাহলে এর ঢেউ আমাদের গায়ে লাগবে।

যেমন, চোখের সামনে আছে রোহিঙ্গা সংকট। এর সমাধান হলে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ ছাড়া আর কারোরই লাভ হবে না, কিন্তু এই সংকট জিইয়ে রাখলে লাভ অনেকের। এই লাভখোরদের মধ্যে দেশি-বিদেশি অনেকেই আছেন।

রোহিঙ্গাদেরকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম; খুব সম্ভব ২০১৫-১৬ সালে টাইমস ম্যাগাজিন রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা আর্টিকেল প্রকাশ করেছিল, সেখানে একজন রোহিঙ্গা নারী বলেছিলেন, হয় দুনিয়া আমাদের সাহায্য করুক, আর না হলে বোমা ফেলে একসাথে মেরে ফেলুক! জেনোসাইড ধাপে ধাপে সংঘটিত হয়; ১৯৬২ থেকে যেটি শুরু হয়েছিল, ২০১৭-তে এসে তার পূর্ণ হলো। শরণার্থীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিলো।

মিয়ানমার রাষ্ট্র এই রোহিঙ্গাদের 'সন্ত্রাসী' 'বর্বর' ইত্যাদি বলে যে ডিহিউম্যানাইজেশন শুরু করেছিলো তার ঢেউ ফাইনালি এসে বাংলাদেশেও পড়লো। শরণার্থী সংকটের সাথে বর্ণবাদ হাত ধরে ধরে আসে। বাংলাদেশেও তাই হলো। ভয়াবহ বিষয় হলো, হঠাত করে বাংলাদেশের মিডিয়াসমূহ রোহিঙ্গাদের ডিহিউম্যানাইজ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কালের কণ্ঠ দেখলাম নিউজ শেয়ার করে 'ফিলিং অ্যাংগ্রি' ইমো দেয়। ফেসবুকে কিছু গ্রুপ খোলা হয়েছে "রোহিঙ্গা খেদাও, বাঁচাও দেশ" ইত্যাদি নামে। এমনকি যারা ভয়ংকর রেসিস্ট আচরণ যারা করছে তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারা বছর গলা ফাটান এমন মানুষেরও অভাব নেই। যে হারে রোহিঙ্গাদেরকে ডিহিউম্যানাইজ করা হচ্ছে ভয় হচ্ছে আরেকটা জেনোসাইডের জমিন তৈরি হচ্ছে কিনা! দুঃখের কথা হচ্ছে, মিয়ানমার যে প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়ে তাদের ওপর জেনোসাইড সংঘটন, আমাদের এখানেও একই প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়ে ডিহিউম্যানাইজ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বর্বর, এরা খারাপ, এরা খালি বাচ্চা উৎপাদন করে, এরা মাথায় টুপি পরে, এরা সন্ত্রাসী।

রোহিঙ্গারা সমাবেশ করেছে এইটা অনেকেই সহ্য করতে পারছেন না। তাদের রাগের কারণও বুঝতে পারি। নিজেদের দেশে সভা-সমাবেশ করতে পারেন না বা করতে দেন না আজ অনেক বছর হয়ে গেলো। সভা-সমাবেশ এইসবের অর্থ তাদের কাছে 'ষড়যন্ত্রমূলক' বিষয়; তাই গোস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধান কী হতে পারে তা নিয়ে প্রয়োজন ছিল আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার, সব মহলে। সুশীল মহলে। নাগরিক মহলে। সামাজিক মিডিয়া হতে পারতো একটা মাধ্যম। কিন্তু, এমন কোনও আলাপে না গিয়ে চলছে ডিহিউম্যানাইজেশন! বাংলাদেশ যেন একটা বেহেশত ছিল, রোহিঙ্গারা এসেই দোজখ বানিয়ে দিলো। রোহিঙ্গাদের হাতে মোবাইল, হায় আল্লা, এরা এতো খারাপ।

একইভাবে পরিস্থিতি হচ্ছে আসামে। আসামও প্রস্তুত হচ্ছে সাংবিধানিক জেনোসাইডের। বলা যায় 'এথনিক ক্লিনজিং'। বাহাত্তর সালে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে একটা বিতর্ক পড়ছিলাম, গোলাম মুরশিদ বোধহয় বলছিলেন যে, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে সাম্প্রদায়িকতা থাকে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে সাম্প্রদায়িকতা থাকে না। এসব ডিসকোর্স খুব শক্তিশালী আমাদের এখানে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের উচিৎ এইসব পূর্বানুমান ভিত্তিক কথাবার্তা ছেড়ে বাস্তবতার জমিনে পা দেয়া।

আমাদের দেশে যারা জাতিবাদী রাষ্ট্র, মানে জাতি রাষ্ট্রের পক্ষে ওকালতি করেন, বা সাফাই গান তাদের আমি মনে করি এইবার চোখ খুলে আকাশে তাকানো উচিৎ। জাতি রাষ্ট্র ধারণা যে 'বর্জনমূলক' চরিত্রের যা বর্ণবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতা জন্মের উর্বর ভূমি তা যদি এখনো উপলব্ধি করতে না পারেন তাহলে সেটা দুঃখজনক।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার হলোকাস্ট নিয়ে একজন জার্মান শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন যে, হলোকাস্টের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ যে কতটা মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর ধারণা হতে পারে তা বুঝতে পারা। তখন আমাদের অনেক শিক্ষক রীতিমতো প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন। জাতীয়তাবাদ অবশ্যই ভালো জিনিস। এটা খারাপ হতেই পারে না। মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নাকি জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম সেটা এখনো তাদের পক্ষে ঠাওর করা সম্ভব হয় নাই। আসাম ও রোহিঙ্গা ইস্যু দেখে অন্তত এইবার বুঝতে পারা উচিৎ। মিয়ানমার ও ভারত একটা জাতিরাষ্ট্র হতে চায়। সুতরাং সে বিভিন্নভাবে কাউকে না কাউকে 'বর্জন' করতেই হবে; রাষ্ট্রহীন 'মানুষ' তৈরি করবেই সে।

মূল প্রশ্ন হতে হবে কীভাবে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে এই সংকটকে মোকাবেলা করবো। এই সংকট মোকাবেলায় কে কবে মিয়ানমার গেছে, আর কে কবে বাংলাদেশে আসছে, আর কে কবে আসাম গেছে এইসব প্রশ্ন অবান্তর। এমন জাতীয়তাবাদী চোখ উপড়ে ফেলা এখন বাধ্যতামূলক। আমাদের বড়ো গলায় জানান দিতে হবে আমাদের 'বন্ধু' রাষ্ট্র জেনোসাইড করতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের তরফ হতে এর প্রতিবাদ জানানো দরকার।

এখানে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিতে পারতেন বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু কেউ কেউ শাড়িতে অন্ধ, কেউ কেউ উন্নয়নে অন্ধ। বাংলাদেশে যে ফ্যাসিজম চলছে তার একটা লাভ হচ্ছে এই যে, 'ফ্যাসিজমে'র ফিল্টারে আমাদের চতুর্দিকে জন্ম নেয়া একদল 'পীর', একদল 'দেবতা'র মুখোশ খসে পড়ছে। এটা ভালো। মঙ্গলজনক।

তবে, এই বোধহয় দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে 'উত্তাপ'ময় এসেছে যখন যে কোনধরনের জাতীয়তাবাদী ও মতাদর্শিক টুলি খুলে রেখে একজন 'মানুষ' হিসেবে সমস্যাকে উপলব্ধি করার দরকার সবচেয়ে বেশি।

সহুল আহমদ, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ