প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
বেদেনিদের সাপের খেলা যারা দেখেছেন তাদের মনে থাকার কথা। সাপের খেলা দেখানো শুরু করার সময় ঝাঁপি থেকে যখন সাপ বের করতো তখন সুর করে গাইতো- খা রে খা বক্কিল রে খা; সাপের খেলা দেইখা যে টাকা দেয়না তার চৌদ্দগোষ্ঠীরে খা…
বিষাক্ত সাপের লকলকে জিহ্বা এখন চারপাশে।
বাংলাদেশ তাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর সম্পদ মনে করে লুটেপুটে খেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে পুলিশ, বিদ্যুৎ, সড়ক জনপথ, প্রাথমিক শিক্ষা, এই ধরণের কিছু বিভাগে কমবেশি ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগ সব সময়ই ছিল। সেই সব অভিযোগের আর সুযোগ নেই। এখন কালসাপেরা বিষাক্ত ছোবলে তছনছ করে দিচ্ছে সব। শেয়ার বাজার, ব্যাংক, বেড়িবাঁধ, হাসপাতাল, পরমাণু কেন্দ্র, কিছুই বাদ রাখছে না।
গতকালের সংবাদেই দেখলাম ১০ লাখ টাকা ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারী পুলিশ সদস্যকে আটক করেছে জনতা। একটি মেডিকেল কলেজে পর্দার দাম ৩৭ লক্ষ টাকা!! কোথাও কম্পিউটার মেরামতের খরচ কোটি টাকা। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার একটি বইয়ের দাম সাড়ে পঁচাশি হাজার টাকা!
খুলনার সাবেক পিয়ন আব্দুল মান্নান, গণপূর্ত বিভাগের পিয়ন আতাউর- এদের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা যখন দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তার সাথে ঘুষ লেনদেন করেন। দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক একটি রূপ পরিলক্ষিত হয়। দুর্নীতি, ঘুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। এটা নতুন কিছু নয়, বাংলাদেশে ও নতুন নয়। ইংল্যান্ড-আমেরিকার মতো দেশেও বড় বড় কেলেঙ্কারি ঘটে দুর্নীতি হয়। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্নীতির চরিত্র ভিন্ন, এইসব ঘুষ দুর্নীতির ভুক্তভোগী হয় সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ।
বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার একর জমির ফসল তলিয়ে যায়। অসহায় কৃষক চেয়ে চেয়ে দেখে। দায় কার? দায় কিন্তু সরকারের উপরই বর্তায়। প্রধানমন্ত্রী বারবার দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বললেও দুর্নীতি কমছে না, বরং বেড়েই চলছে। এক-এগারোর সময়ে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক যখন আসে শুরুতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের অভিযান বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। যদিও পরে নিজেরাই সেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান এখন তাই সময়ের দাবি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিছানা-বালিশ আর কেটলির দামের নামে হরিলুটের সংবাদ প্রকাশিত হবার পরে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবেদন কী আর শাস্তির ব্যবস্থা কী কেউ জানে না। এবার ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি স্টেথোস্কোপের দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এরকম ৪টি স্টেথোস্কোপ আনতে ব্যয় দেখানো হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা। পর্দার দাম সাঁইত্রিশ লক্ষ টাকা, আরেক জায়গায় দেখলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাড়ে ৫ হাজার টাকার বই সাড়ে ৮৫ হাজার টাকা দামে ক্রয় করা হয়েছে।
ফরিদপুরে এরকম ১১৬টি যন্ত্র ক্রয়ে ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতেও নেয়া হয়েছে অনিয়মের আশ্রয়।
পুকুর খনন শিখতে সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে যাচ্ছেন, লিফট কিনতে বিদেশ যাচ্ছেন, মশা মারা শিখতে সদলবলে বিদেশ যাচ্ছেন। রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা দিচ্ছেন। কিন্তু দায় নিতে হচ্ছে সরকারের। এক সময় ছিল রাজনৈতিক নেতা- মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতো। আওয়ামী লীগ সরকার এই জায়গায় সফল হয়েছে বলা যায়। খুব মোটা দাগে এমপি-মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এখন দুর্নীতির অভিযোগ খুব একটা নেই।
জাতির অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন তিনি, যার আঙুলের ইশারায় এক হয়ে যায় পুরো জাতি সেই শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। সদ্য স্বাধীন দেশে তিনিই রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিলেন। বর্তমানে ইউটিউবের বদৌলতে বজ্রকন্ঠের সেই বক্তব্য আমরা নতুন প্রজন্মের যারা তাদের শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি এই ঘুণে ধরা সমাজকে চরম আঘাত আনতে চাই। দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে আজ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম; হয় তারা থাকবে না হয় আমি থাকব। এই যে এতো সাব, ডাক্তার সাব, ইঞ্জিনিয়ার সাব এতো সাব কে বানায়, আমার দেশের কৃষক, শ্রমিক আপনাদের সাব বানিয়েছে। তাদের সম্মান দিন। অন্য এক বক্তব্যে বলেছিলেন সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি, পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে, এই চোরদের আমার জন্য রেখে গেছে।
এই চোরের দল তখনও ছিল, শুধু বারবার রঙ বদল করেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন জাতির জনক। কিন্তু সেই আঘাতটা উল্টোভাবে ফিরে আসে জাতির জনকের উপর; ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। এই দেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক শ্রমিক, খেটেখাওয়া মজুর দুর্নীতিবাজ নয়। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত শিক্ষিত সমাজ, সরকারি আমলারা।
একটা বহুল প্রচলিত গল্প, অনেকেরই জানা সেটা। এক মহিলা একটা অজগর সাপ পুষতেন। সাপটাও ওই মহিলাকে অসম্ভব ভালবাসতো। অজগরটা লম্বায় ৪ মিটার এবং বেশ স্বাস্থ্যবান ছিল। হঠাৎ করেই একদিন আদরের অজগরটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলো। এভাবে কয়েক সপ্তাহ চলে গেল। সাপ কিছুই খায় না। আদরের সাপের এমন অবস্থায় মহিলা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। উপায়-বুদ্ধি না পেয়ে শেষমেশ সাপটাকে তিনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।
ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে সব শুনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাপটা কি রাতে আপনার সাথে ঘুমায়?’
মহিলা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।
ডাক্তার, ‘ঘুমানোর সময় এটা কি আস্তে আস্তে আপনার কাছে ঘেঁষে?’
‘হ্যাঁ’–মহিলার উত্তর।
ডাক্তার, ‘তারপর আস্তে আস্তে আপনাকে চারপাশে পেঁচিয়ে ধরে?’
মহিলা বিস্মিত হলেন এবং জবাব দিলেন।
তখন চিকিৎসক বললেন, ‘ম্যাডাম, সাপটি আপনাকে জড়িয়ে এবং চারপাশ থেকে পেঁচিয়ে ধরে। কারণ এটা আপনার মাপ নিচ্ছে। নিজেকে প্রস্তুত করছে আপনাকে আক্রমণ করার জন্য। আর হ্যাঁ, সে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেছে যথেষ্ট জায়গা খালি করতে যাতে সহজেই আপনাকে হজম করতে পারে।
সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের লোকজন আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগার হয়ে গেছে। দলীয় নেতাকর্মীরা সেখানে কোণঠাসা। এইভাবে চলতে থাকলে এরা গল্পের অজগরের মতো হয়ে উঠবে।
শেখ হাসিনার সরকার যখন বিশ্বব্যাংক জাতিসংঘের মতো সংস্থা প্রতিষ্ঠানকে তোয়াক্কা নিজের মতামত স্পষ্ট করে বলে দেয়ার মতো ক্ষমতা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সারা বিশ্বের কাছে হয়ে উঠেছে অনুকরণীয়। বাংলাদেশ যখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তখন দুর্নীতির ডালপালা মহীরুহ হয়ে উঠেছে। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের বিশাল অর্থনীতিতে এই দুর্নীতির পরিমাণ হয়তো কিছুই না। কিংবা কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু সমাজ এবং মানুষের মধ্যে যে স্থায়ী সমস্যা তৈরি করে সেটা ভয়ানক। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরণের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা দুই ধরণের কাজ করে এক পক্ষকে দুর্নীতিতে আগ্রহী করে তুলে। মানুষের দুর্নীতির প্রবণতা বেড়ে যায়। সবাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের মাঝে বিদ্রোহ তৈরি করে। যারা দুর্নীতিবাজদের শোষণের শিকার হয়। আর সেই দায়ভার নিতে হবে আওয়ামী লীগকে, শেখ হাসিনাকে।
যে চরম আঘাত জাতির জনক করতে চেয়েছিলেন সেই আঘাত কি প্রধানমন্ত্রী করতে পারবেন। বিষাক্ত সাপের একজন ওঝা দরকার, দুর্নীতির বিষদাঁত না ভাঙলে সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে। প্রতিটা দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশিত হবার পর রাজনৈতিক মতাদর্শ না খুঁজে ব্রিটিশ আমলের সেই নামকাওয়াস্তে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের নামে সময়ক্ষেপণ করা, ওএসডি করা এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
জ্ঞানপাপীরা বুঝে শুনেই পাপ করে। ভুল করে নয়। তাই এদের ক্ষেত্রে কঠিন শাস্তির বিধান করতে হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য