আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ফের মিথ্যাচার, এইসব সাংবাদিকতা বন্ধ হবে কি?

এস এম নাদিম মাহমুদ  

দেশের বাহিরে যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে এসেছেন, যারা গবেষণা করছেন, তাদের যে কাউকে যদি যে জিজ্ঞেস করেন যে, সে কতবার ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ড, পোস্টার অ্যাওয়ার্ড কিংবা ওরাল প্রেজেন্টেশনের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন, তাহলে দেখবেন তাদের সেই সংখ্যা নেহাত কম হবে না।

ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডগুলো দেয়া হয় মূলত কোন সিম্পোজিয়াম/কনফারেন্সে যোগ দেয়ার নিবন্ধনের সময় জমা দেয়া গবেষণার সারাংশ (অ্যাবস্ট্রাক্ট) উপর ভিত্তি করে, আর পোস্টার/ওরাল দেয়া হয় মূলত প্রেজেন্টেশনের ধরন, গবেষণার থিম, প্রাপ্ত ডেটা এবং রেফ্রি কিংবা উপস্থিত বিশেষজ্ঞদের প্রশ্নের উত্তরের সন্তুষ্টির উপর ভিত্তি করে।

প্রায় প্রতিটি সায়েন্টিফিক মিটিং এই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। বলা বাহুল্য, ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডগুলো এয়ার টিকিট, থাকার ব্যবস্থা ও খাওয়া এবং নিবন্ধনের অর্থ সরবরাহ করে।

একাডেমিক জীবনে এই ধরনের পুরস্কার ভাল কিছু করার জন্য আমাদের অনুপ্রাণিত করে। যারা গবেষণায় আছেন তারা এই ধরনের পুরস্কারে অভ্যস্ত।  

যাই হোক, এতো কিছু বলার উদ্দেশ্যে এই প্রকাশিত খবরটির জন্য। যুগান্তরের অনলাইন ভার্সনে শিরোনাম করেছে, ‘‘এবার যুক্তরাষ্ট্র জয় করলেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ডা. আরিফ’।

এই শিরোনাম দেখে যেকোনো পাঠক মনে করবেন এই ভদ্রলোক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের উত্তরসূরি, যে কিনা আমেরিকা জয় করে ফেলছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে যারা একটি মিথ্যা সংবাদ তুলে, রাতারাতি খ্যাতির পাহাড়ে নিয়ে গেছেন, সেই পত্রিকা আবারও একটি মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে পুরো সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাস নিয়ে মেতেছেন কি?

২৬ অক্টোবরের সংবাদে যারা ৬১‘ বছরের ইতিহাসে জাপানে ‘সেরা বিজ্ঞানী বলে দাবি করলেন, প্রথম নন-জাপানিজ বলে চালিয়ে দিলেন, তারা ফের আর একটি নতুন বিতর্কের জন্ম দিলেন মনে হয়।

চলুন দেখি, তারা নতুন সংবাদটিতে কি ধরনের মিথ্যাচার করছে।
# খবরের শুরুতে তারা বলছেন, ওয়ার্ল্ড সিম্পোজিয়ামে সারা পৃথিবী থেকে ১১ জনকে বাছাই করা হয়েছে সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে।

-- সেই  একই ভুল। ‘সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে ‘১১’ জনকে বাছাই করার কথা বললেও ওয়ার্ল্ড সিম্পোজিয়াম বলছে, এটি সেরা বিজ্ঞানীর কোন পুরস্কার নয়। ফোরামটি জানাচ্ছে,  WORLD Symposium Young Investigator Award বাংলায় যার অর্থ হতে পারে তরুণ অন্বেষক পুরস্কার কিংবা তরুণ উদ্ভাবক পুরস্কার। যেটি সংবাদের কোন অংশে বলা হয়নি। সেরা তরুণ বিজ্ঞানী বলে চালিয়ে দেয়া এক ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নেয়া ছাড়া কিছু নয়।

# পত্রিকাটি বলছেন, দুইজন ব্রিটিশ, সাতজন আমেরিকান, একজন ডেনমার্ক এবং একজন জাপানিজ বিজ্ঞানী- কিন্তু ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, ছয়জন আমেরিকান, একজন কানাডার, দুইজন যুক্তরাজ্যের, একজন জাপানের আর একজন ডেনমার্কের। তাই এই তথ্য একটু ভুল রয়েছে।

# খবরের একটি অংশে বলা হয়েছে, আলোচিত এই পুরস্কার জিতেছেন ফেব্রী রোগ নামক এক ধরনের জেনেটিক লাইসোসোমাল রোগের pathophysiology-তে গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য।

-- অথচ এই সিম্পোজিয়ামের ওয়েবসাইটে কোথাও বলা নেই যে কোন গবেষণার জন্য পুরস্কারটি দেয়া হয়েছে। তারা বলছে, Those who submit an abstract as the first-author will be considered eligible for the award. অর্থাৎ যারা এই সিম্পোজিয়ামে অংশ গ্রহণ করতে আগ্রহী, তাদের গবেষণার সারাংশ জমা দেবেন তার উপর ভিত্তি করে সিলেকশন কমিটি তা বাছাই করবেন।

মূলত যারা গবেষণা উপস্থাপন করবেন, তাদের সবাইকে অ্যাবস্ট্রাক্ট জমা দিতে হয়। এই জমা দেয়ার সময় একটি অপশন রয়েছে, যে কেউ যদি এই পুরস্কার পেতে আগ্রহী হয়, তাহলে "হ্যাঁ" লিখতে হবে। পরবর্তীতে সিলেকশন কমিটি তা বাছাই করতে পারবেন।

কারা এই পুরস্কার পান?
ওয়েবসাইটটির তথ্যানুযায়ী, Graduate students and those who are within the first 3 years after completing a graduate degree are eligible. যারা পিএইচডি করতেছেন কিংবা তিন বছর আগে শেষ করেছেন, তারা এই পুরস্কারের আবেদনের যোগ্যতা অর্জন করেন। সেই হিসেবে আরিফ হোসেন এই পুরস্কারের যোগ্য কিনা আমি জানি না। তথ্য বলছে, তিনি ২০১৪ সালে পিএইচডি শেষ করেছেন। তাই চার/পাঁচ বছর পর তিনি কিভাবে আবেদন করার সক্ষমতা অর্জন করেছেন তা আমার অজানা। অবশ্য যিনি ৫৪ বছরকে ৬১ বছর কিংবা উৎসাহমূলক পুরস্কারকে ‘সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে চালিয়ে যেতে পারেন তার পক্ষে সবই সম্ভব।

কী এই পুরস্কার?
যুগান্তর এই খবরটিকে সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও এটি মূলত এই ধরনের কোন পুরস্কার নয়। এটি এক ধরনের আংশিক বৃত্তি, যার আওতায় সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন ফি (সম্ভবত $১৭৫), পাঁচ রাত হোটেলে থাকার খরচ ($২৭০) আয়োজকরা বহন করবেন যা ওয়েবসাইটে স্পষ্ট বলা আছে। অন্যান্য খরচ অংশগ্রহণকারীকে বহন করতে হবে।

এখন এই আংশিক বৃত্তিকে যারা ‘সেরা বিজ্ঞানী’ বলে দাবি করলেন যারা  আমেরিকা জয় করে ফেললেন, তারা কি জানেন দেশের বাহিরে আমাদের প্রবাসী বাঙালিদের একাডেমিক ফিল্ডে অর্জন কতটুকু? ওই অর্জন নিয়ে লিখলে পত্রিকার স্থান সংকুলান হবে বলে মনে হয় না।

একটি ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ড পেলে যেখানে যাওয়া, থাকা ও খাওয়ার সব খরচ করা সম্ভব হয়, সেখানে এই আংশিক বৃত্তিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বৃহত্তর বনে নিয়ে যাওয়াকে আমি সাংবাদিকতা বলতে নারাজ। এটি কখনোই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বলা চলে না। সেফ কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের রূপ হতে পারে।

আমি আরিফ হোসেনের পুরস্কারকে ছোট করে দেখছি না। নিঃসন্দেহে তার গবেষণাক্ষেত্রে এটি এক ধরনের অর্জন। তবে এই অর্জনকে ‘মিথ্যাচারের আশ্রয়’ নিয়ে প্রচারণা করা এক ধরনের নোংরামি ছাড়া কিছু নয়। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি। আপনার যদি যোগ্যতা থাকে তাহলে আপনি প্রস্ফুটিত হবেন, আর যদি তা না থাকে তাহলে এইভাবে মিডিয়ার বাতাসে ফুলে বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
   
একজন নোবেল পুরস্কারজয়ীর এই ধরনের কোন কাভারেজ হয়েছে কি না আমার জানা নেই, তবে মিথ্যা খবর প্রকাশ করে পত্রিকাগুলো নিজেদের দুর্বলতায় তুলে ধরছে। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে যারা পাঠকদের কাছে তথ্য গোপন করার চেষ্টা করে, সেটা বড়ই বোকামি। আপনার পাঠক যখন আসল সত্যটা জানবে, তখন আপনার পত্রিকার প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে কি?

ভুল তথ্যে সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে, তা এড়িয়ে যাওয়া বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার অন্যতম ভাল দিক। আর যদি ভুলের সংশোধন করে নেন, সেটিও ভাল সাংবাদিকতার অংশ। আশা করি, পত্রিকাগুলো এইসব বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকবে। পাঠকদের সত্যটা জানাবেন।

এস এম নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ