আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

কমনসেন্সের দৈন্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা

মাসকাওয়াথ আহসান  

রাজাকার তালিকা প্রণয়ন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি খণ্ড প্রলয় হয়ে গেলো। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম এই তালিকায় থেকে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা বিক্ষুব্ধ।

এই তালিকা প্রণয়নের জন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জেলায় জেলায় সংরক্ষিত তথ্য ভাণ্ডার থেকে তথ্য নিয়ে গ্রন্থিত করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মুক্তিযুদ্ধের পর 'দালাল আইনে' যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়; তাদের প্রত্যেকের নাম রয়েছে এই তালিকায়। এই তালিকায় তৃতীয় সারণিতে মামলাগুলোর স্ট্যাটাস উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন নাকি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে; তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে সেখানে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিলো, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তথ্য তৃতীয় সারণিতে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে যারা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন; তাদের নাম বাদ দিয়ে; কেবল যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাদের নাম 'রাজাকার তালিকায়' প্রকাশের। শুধু মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়াবলীর জন্য গঠিত এই মন্ত্রণালয় তাদের সামান্য দায়িত্বটুকু পালন করতে না পারায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রাথমিক তথ্য সম্বলিত তালিকা হুবহু প্রকাশিত হয়েছে।

এরকম ভুল-ভ্রান্তি অহরহ হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এরকম কিছু ঘটলেই অতি-দেশপ্রেমিকেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় নেমে এসে 'ঘাপটি মেরে বসে থাকা' লোকেদের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেন। আর অতি-ধর্মপ্রেমিকেরা আনন্দে কুলু কুলু হয়ে 'জাত গেলো জাত গেলো' রব তোলেন।

আসলে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা 'কমনসেন্সের' অভাব এইসব ধারাবাহিক ভ্রান্তির সূতিকাগার। সরকারি কাজে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা যারা রয়েছেন; তাদের একটি বড় অংশ কেবল বিসিএস গাইড মুখে পুরো ছাত্রজীবন কাটিয়ে দেয়ায় কমনসেন্সের অভাব বিষয়টি ঘাপটি মেরে বসে পড়ে তাদের মস্তিষ্কে। তাদের অধীনে যারা কাজ করে; এরা বেশিরভাগই খুব দুর্বল ছাত্র; আর অহোরহো বড় সাহেবের ধমক খেয়ে তারা থতমত লেগে মস্তিষ্কে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কমনসেন্সের অভাব রীতিমত স্বয়ংসম্পূর্ণ গাব বৃক্ষ হয়ে ওঠে। ফলে তারা যে কাজ করে সেখানেই ভুল হয়। আর টেকা-টুকার চিন্তা শরীরের সব ইন্দ্রিয়কে অকেজো করে শুধু টেকান্দ্রিয়টি চালু রাখে।

অতি দেশপ্রেমিকরা পোশাকে আর কিছু বাঁধাবুলিতে আধুনিকতার ভং ধরলেও যে কোন বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া 'আকাশ ভেঙে পড়েছে' টাইপের। শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের বিস্মিত হবার অপার ক্ষমতা। সামান্য পড়ালেখা জানা মানুষ প্রকাশিত 'রাজাকার তালিকা' দেখে তৃতীয় সারণি পড়ে বুঝতে পারার কথা এই তালিকার কে কে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

অতি-ধার্মিকদের বুদ্ধাংক যেহেতু আদিম যুগের; তারা বসে যায় যে কোন কিছু নিয়ে ফেইক নিউজ বানাতে। তারা ফেইক নিউজ বানিয়ে ছেড়েছে, "রাজাকার তালিকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর সংখ্যা বেশি; জামায়াতের সংখ্যা কম।"

মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায় আদালতে প্রমাণিত হওয়ায় যে জামায়াতের নেতাদের শাস্তি হয়েছে; যে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধে দখলদার খুনে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর সংগঠন হিসেবে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে আদালতে প্রমাণিত; তারা একটি ফেইক নিউজ বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে কলঙ্কিত করতে চেষ্টা করছে। এই যে গান্ধা কইরা দেয়ার 'ভিলেজ পলিটিক্স'; এটা মাথার মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কমনসেন্সের অভাবের রীতিমত লাস্ট স্টেজ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মাত্র ৪৮ বছর আগের ঘটনা। এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীরা সমাজে উপস্থিত। ছোট্ট একটা দেশের নিবিড় সমাজে; প্রত্যেক এলাকার মানুষ জানে; মুক্তিযুদ্ধের সময় কারা দখলদার মিলিটারিদের গাইড করে মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছে, কারা অসহায় নারীদের খুনে বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে; কারা বশ্যতা মানতে না চাওয়া সাধারণ নাগরিককে নির্বিচারে হত্যার পথ নির্দেশনা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ ইতিহাসের সবচেয়ে নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষক। সুতরাং রাজাকার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম দেখে হৈ হৈ করে উঠলেই মানুষের স্মৃতিতে চির জাগরূক স্মৃতি মুছে দেয়া যায় না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে 'রাজাকার তালিকায় কী করে মুক্তিযোদ্ধার নাম এলো'? এ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ; মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভ্রান্তিতে আমাদের জীনপ্রবাহের কাঁকড়া-স্বভাব বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার পর খুব নিশ্চিন্ত মনে কাঁকড়া স্বভাবটি উঁকি দেয় দেশের কিছু মানুষের মনে। দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের সফলতা কুড়াতে প্রাপ্তির দৌড়ে প্রতিযোগী কমাতে ও জীনসঞ্জাত হিংসার কুঁচকুঁচানিতে; মুক্তিযোদ্ধাই আরেক মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে 'বানোয়াট' অভিযোগ দায়ের করেছে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় উপকার করেছে এমন মানুষের প্রতি স্বভাবসুলভ কৃতঘ্নতা প্রকাশে থানায় গিয়ে উপকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দিয়ে এসেছে অনেকে।

এই ঘিন ঘিনে আত্মপরিচয় ও শেকড়ের শ্লাঘাটি সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ