প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯
রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের দাবিটি দীর্ঘদিনের ছিল। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী নিজেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাই প্রত্যাশা ও ছিল বেশি। এবারের বিজয় দিবসের আগের দিন মহাসমারোহে যখন ঘোষণা আসলো বিজয় দিবসের দিন রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন করবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। সংবাদটি দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম। এতো বৃহৎ একটা কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশে খুব নীরবে নিভৃতে ঘটে গেলো, কেউ টেরই পেলোনা। তার মানে কি খুব গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজটি করা হয়েছে? কিন্তু দিন শেষে যা দেখলো বাংলাদেশ, সেটা ভানুমতির খেল! তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না কেউ।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঠেলা-ধাক্কার পর ভুল তালিকাটি স্থগিত করেছে মন্ত্রণালয়। আমি মোটেও বিতর্কিত তালিকা বলতে চাই না। বিতর্কিত এবং ভুলের মধ্যে একটা পার্থক্য রাখতে চাই। আর রাজাকারের তালিকা প্রণয়নটি না বিতর্কিত না ভুল এর কোনটাই না, এই গর্হিত কাজটি অপরাধ হয়েছে। এবং অপরাধ হিসাবে এর প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত কর্মকর্তা কর্মচারী থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত জবাবদিহি ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী লক্ষ লক্ষ মানুষজন এখনো জীবিত, এই তালিকার জন্য পাকিস্তানি তালিকার ওপর কেন নির্ভর করতে হলো। প্রতিটা জেলা উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, সংসদ বিভিন্ন নামে সংগঠন আছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেছেন হাজারো সাংবাদিক আছেন, বিভিন্ন প্রকাশনায় স্থানীয় রাজাকারের নাম এসেছে বিভিন্ন সময় সেই সবের সমন্বয় না করে "কাজির গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নাই" ধরনের একটা তালিকা প্রণয়ন করলেন। এতে লাভ হলো কার? প্রকৃত রাজাকারদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এই তালিকা।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক, বাকশাল নিয়ে বিতর্ক, ৭ নভেম্বর নিয়ে বিতর্ক, খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে বিতর্ক, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচার নিয়ে বিতর্ক, শেখ কামাল নিয়ে বিতর্ক, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিতর্ক, সর্বশেষ যোগ হলো রাজাকারের তালিকা নিয়ে বিতর্ক। আমাদের মতো যারা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, তাদের মাথায় আরেকটা বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে এই তালিকা। এখন এই তালিকা রেফারেন্স হিসাবে থেকে যাবে। যখনই রাজাকার প্রসঙ্গে আলোচনা হবে, তখনই এই তালিকা নিয়ে কথা হবে, বাতিল বা স্থগিত হওয়া নিয়ে বিতর্ক হবে। যেমন বিতর্ক চলছে মানবতা বিরোধীদের বিচার নিয়ে।
এই তালিকাটি যারা প্রকাশ করেছে তারা খুব ভালভাবে, জেনে বুঝে খুব ঠাণ্ডা মাথায় এই তালিকাটি সম্পাদনা করেছেন। তারা জানতো এই তালিকাটি যাতে করে না টেকে সেই কারণেই কুকর্মটি সম্পাদন করেছে তারা। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ৫০ বছরেও শেষ হয়নি, বহু রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন করছে এখনো, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হওয়া রাজাকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে রাজাকার তালিকা প্রণয়ন করা খুব সহজ বিষয় হবে না। মন্ত্রণালয় থেকে যদিও বলা হয়েছে এই তালিকা স্থগিত করা হয়েছে, আগামী ২৬ মার্চ পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু আমার মনে হয় আরও ৫০টি ২৬ মার্চ লাগবে বাংলাদেশে রাজাকারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে।
সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা করা হয়েছে, মীমাংসিত একটি বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে যখন অন্য কোন সরকার আসবে তারা এই তালিকায় আবার হাত দেবে, এবং পুরোনো তালিকা ধরে মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার হিসাবে চিহ্নিত করবে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে যে নথিটি প্রস্তুত ছিল সেই নথিটিও যদি প্রকাশিত হতো তাও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল না।
দালাল আইনে মোট অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৩৭,৪৪১ জন। এবং বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় ক্ষমা পাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ২৬,৪৪১ জন। (এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি)। যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় এমন অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১১,০০০ জন যারা জেলে আটক ছিল। চূড়ান্ত অভিযুক্ত ১১,০০০ জনের মধ্যে ২,৮৪৮ জনের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছিল। এদের মধ্যে ২০৯৬ জন রায়ের অপেক্ষায় ছিল ও বাকি ৭৫২ জন অভিযুক্তের বিচারের রায় প্রদান কার্য সম্পন্ন হয়েছিল। রায় প্রাপ্তদের মাঝে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৩০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ও ৪৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয় এবং বাকিরা নানান মেয়াদে কারাদণ্ডের সাজা পায়। সেই নাগরিকত্ব বাতিলের তালিকায় রাজাকারকুল শিরোমণি গোলাম আযমও ছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক হত্যার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এদের মুক্তি দেয়, এবং রাজনৈতিক ভাবে পুনর্বাসিত করেছিল।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম যখন শুরু হয় তখন এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ব্যাপারটি রাজাকারদের বংশধরেরা রেফারেন্স হিসাবে খুব বেশি ব্যবহার করতো। এখনো করে। শুধু সাধারণ ক্ষমার কথাই বলে কিন্তু সাজার বিষয়গুলো চেপে যায়। সাধারণ মানুষকে সেটা বিশ্বাস করায় যে বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও শেখ হাসিনা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে, ইসলাম বিদ্বেষের কারণে, ভারতকে খুশি করতে ইসলামী নেতাদের ফাঁসি কার্যকর করছে। সংগ্রাম পত্রিকায় কাদের মোল্লাকে শহীদ ঘোষণা সেই প্রচারণারই ধারাবাহিকতা ছিল। কোন বিচ্ছিন্ন ভুল ছিলনা।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা, আমলা কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতার দায় পুরো জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এই তালিকা এখন স্থগিত করলেই কি আর না করলেই কি? ইতোমধ্যে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে পাকিস্তানিদের করা রাজাকারের তালিকাই সঠিক তালিকা। আওয়ামী লীগের নিজেদের লোকেদের নাম আসার কারণে স্থগিত করা হয়েছে এই তালিকা, এবং নতুন তালিকায় আওয়ামী বিরোধদের নাম তালিকাভুক্ত করবে।
সরকার যে তালিকা প্রণয়ন করেছিল কিসের ভিত্তিতে এবং এই তালিকার নাম আসলে কী ছিল? রাজাকারের তালিকা নাকি দালাল তালিকা, নাকি মানবতা বিরোধী তালিকা? এই বিষয়টাও তো পরিস্কার না। রাজাকার হিসাবে শান্তিবাহিনী যেমন পাকিস্তানিদের নিয়মিত বাহিনী ছিল তেমনি আল বদর, আল শামস ও ছিল। সহযোগী এই সব বাহিনীর নাম কি এই তালিকায় সংযুক্ত ছিল?
রাজাকারের তালিকা খুব কঠিন কাজ ছিল না, শুধু যাচাই বাছাই সঠিক ভাবে করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এমন একটা লেজেগোবরে অবস্থা করেছে এখন ভিক্ষা চাইনা কুত্তা সামলা অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেছে। যারা এতদিন রাজাকারের তালিকা চেয়েছিল তাদের অবস্থা হয়েছে এমন। কখন কার বাপ দাদার নাম সেই তালিকায় ঢুকে পড়ে কে জানে। তারেক রহমান কয় বছর আগে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন রাজাকার। আগামী তালিকায় বঙ্গবন্ধুর নামও যদি রাজাকার তালিকায় চলে আসে আমি অবাক হবোনা! এবং তারেক রহমান কখনো ক্ষমতায় গেলে ঠিক এই কাজটিই করবে।
আমলা-কামলাদের ৬০ কোটি টাকার হিসাব চাইছি না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির দায়ে অন্তত এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হউক। এই সমস্ত মহামান্যদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসিয়ে কাজির গরুর হিসাব রাখুন। যুদ্ধটা, যোদ্ধাদের করতে দিন।
দীর্ঘদিন ধরে যারা যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারের বিচারের দাবিতে কাজ করছেন তাদের এই প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত করুন। সরকারের এক টাকাও খরচ হবে না। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের অনেকেই আছেন যারা নিজের গরজে, নিজের খরচে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ সমন্বয় কমিটি করে মাঠ পর্যায় থেকে তালিকাটি তুলে নিয়ে আসুন। যাচাইবাছাইয়ের কাজ সরকার এবং মন্ত্রণালয় করুক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর বিতর্ক চাইনা। আর যদি সম্ভব না হয়, মানবতা বিরোধীদের বিচার সম্পন্ন করুন, বাকি সব তামাদি করে দেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য