প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এনামুল হক এনাম | ০১ জানুয়ারী, ২০২০
জন্মগ্রহণের পর একটি শিশুর সাথে তার মায়ের প্রথম ঘনিষ্ঠ এবং নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয় দুধ পান করানোর মধ্য দিয়ে। শিশুটি পরিচিত হয় তার মায়ের ঘাম, গন্ধ মমতায়। ঘুমন্ত শিশু ঘুমের মাঝেও টের পায় তার মা পাশে আছে কি না, মা পাশ থেকে সরে গেলেই কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঘুম ভেঙে যায়। শিশুর মুখ শুধু দুধ তুল দেওয়াই নয়, ভালবাসা, আবেগ, অনুভূতি আদানপ্রদানের প্রাথমিক এবং গভীর মাধ্যম হলো দুধ পান করানো।
গর্ভধারিণী মা অসুস্থ বা মারা গেলে সদ্যজাত শিশুকে দুধ পান করানোর দায়িত্ব দেয়া হত একজন মাকে, যার প্রায় একই বয়সের একটি বাচ্চা আছে বা ছিল। এটি পৃথিবীর অতি পুরাতন রীতি। তাই সকল দেশ, জাতি, ধর্মে দুধ দানকারিণীকে মাকে অত্যন্ত সম্মান করা হয়। ধর্মেই এই ধরণের মহানুভবতাকে সম্মান দিয়ে মায়ের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। দুধ মায়ের সন্তানকে ভাইবোনের সম্মান দিয়ে সম্পর্কের গভীরতা বুঝানো হয়েছে। গভীর মমতায় সেই শিশুটির হাসিতে দুধ মা হাসে, কান্নাতে উদ্বিগ্ন হয়, ব্যথিত হয়। দুধ মা এবং তার কোলে থাকা অবুঝ শিশুটির বিষয়টি শুধু তরল দুধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আর পুরো ব্যাপারটি একটি শিশু এবং দুধ প্রদানকারিণী মা বা দুধমাতা ছাড়া আর কেউই অনুধাবন করতে পারবেন না, সম্ভবও নয়।
সদ্য ভূমিষ্ঠ যে শিশুটির মা অসুস্থ বা মৃত তার কথা চিন্তা করেই উন্নত দেশগুলোর মতই বাংলাদেশেও শুরু করার কথা ছিল “মিল্ক ব্যাংক”, যেখানে যেকোনো মা তার দুধ জমা দিতে পারবেন। সেই দুধ সংরক্ষণ করে কোন এতিম শিশুকে বা যে শিশুর মা অসুস্থ তাকে দেয়া হবে। যে মায়ের সন্তান মারা গেছে তিনি সেই দুধ দান করতে পারবেন। আগে বিভিন্ন উপায়ে তিনি যা ফেলে দিতেন এখন তা দান করতে পারবেন।
বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর মনে হলেও একদল ব্যাখ্যাকারী মনে করছেন বিষয়টি সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং ধর্মবিরোধী। এতে দুধদানকারিণী যদি মা হয় তবে তার সন্তান ভাই বোন হয়ে যাবে পরবর্তীতে। আর ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ পৃথিবীর যেকোনো ধর্মমতে গর্হিত কাজ। যারা বিষয়টি নিয়ে বিরোধিতা করেছেন তারা আদালতে মামলা ঠুকে দিলেন এবং “মিল্ক ব্যাংক” আপাতত স্থগিত হয়ে গেল।
পৃথিবীর কোন ধর্মেই মিল্ক ব্যাংক নামক বিষয়ের আলোচনা নেই। ব্লাড ব্যাংক, মিল্ক ব্যাংক বিষয়গুলো একেবারেই নতুন ধ্যানধারণা। স্বভাবতই ধর্মে এই বিষয়গুলো থাকবে না এবং ধর্মবিরোধী এবং অনৈতিক মনে হতেই পারে। কিন্তু গভীর ভাবে একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে গভীর মমতায় দুধ খাওয়ানো এবং মিল্ক ব্যাংকে দুধ দান দুটিই মহান কাজ হলেও কখনোই এক নয়। কেউ যদি মিল্ক ব্যাংককে কোলে নিয়ে আদর স্নেহে সন্তানের ভালবাসায় একটি শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সাথে তুলনা দেন তবে “দুধ মা” বিষয়টিকেই হেয় করলেন। দুধ মিল্ক ব্যাংকে দান করার সাথে কোলে নিয়ে পান করানোর কোন তুলনাই হয় না। মিল্ক ব্যাংকে একজন মা দুধ দান করেই দায়িত্ব শেষ করেন, কিন্তু কোলে নিয়ে কোন মা যখন দুধ মায়ের দায়িত্ব নেন তখন মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
অনলাইনে প্রতিবাদ করা যাদের আমি দেখেছি তারা অধিকাংশই পুরুষ, তারা বিষয় না বুঝেন…না উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখেন!
একটি শিশুকে কোলে নিয়ে মমতা, ভালবাসায় দুধ খাওয়ানো, সদ্য মৃত শিশুর জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ আর ফোটা ফোটা হয়ে চুইয়ে পড়া দুধে স্তনে ব্যথা… এইসব বুঝার ক্ষমতা কোন পুরুষের নেই।
যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের অনুভূতিকে আমি সম্মান করি, কিন্তু পুরো বিষয়টি নিয়ে ধর্মের আলোকে জ্ঞানীরা আরও আলোচনা করতে পারতেন। সময় নিয়ে পারতেন। এভাবে বিষয়টি সরাসরি নাকচ করে না দিয়ে উনারা এই সমস্যার একটি উপায় বাতলে দিতে পারতেন। দুধ দানকারিণী মায়ের নাম ঠিকানা রেজিস্টারে লিখে একটি কার্ড দিলেই সমস্যাটির সহজ সমাধান হয় যেতে পারতো। এতে দুধ দানকারিণী ঐ মাকে কার্ডের আওতায় কিছু রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধাও নিশ্চিত করা যেত, যাতে আরও অনেকে আগ্রহী হয়। দুধ পান করা বাচ্চাটিও বড় হয়ে জানতো তার দুধ মা কে… কে হতে পারে তার দুধ ভাই বা বোন।
ব্লাড ব্যাংকের বিষয়টি কোন ধর্মেই নেই… এক্ষেত্রে রক্ত বিনিময়ের রক্তের ভাই বোন হওয়ার কথা যৌক্তিক ছিল। পৃথিবী এগুচ্ছে দ্রুত, ধর্মের প্রয়োজনে ছবি তোলা, মাইক ব্যবহার, টিভি রেডিও, ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুক এসবকিছুই অতীতে ধর্ম প্রবর্তনের সময় ছিল না। শুরুতে অনেককেই প্রতিবাদ করতে দেখেছি… আজ আর কেউ করেনা।
লেখাটা শেষ করার আগে আমার বাবার বলা একটি স্মৃতি শেয়ার করি। বাবা জীবিকার অন্বেষণে ষাটের দশকে যুক্তরাজ্য গিয়েছিলেন। সেই সময়ে দেশে যখন বেড়াতে আসতেন তখন মসজিদ মাদ্রাসায় অর্থ সাহায্য দিতে গেলে তাকে একাধিকবার কটু আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কারণ বাবা একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন… আর রেস্টুরেন্টে সকল কাজই “মদ” এর সাথে সংশ্লিষ্ট। তারা বাবাকে জিজ্ঞাস করে রেস্টুরেন্টে আজ করেন জানলেই “হারাম” টাকা ঘোষণা পূর্বক তাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল একাধিক জায়গা থেকে। আজকাল মসজিদ, মাদ্রাসায় অনেক আলেম উলামা কাজ করেন… দান করা অর্থের উৎস কি তারা কখনো জানতে চান?
যেকোনো বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যায় আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান, উপায় খুঁজে নিতে অনুরোধ করে বলি, “সকল ধর্মের, সকল মতের মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক… মানুষ বাঁচুক পৃথিবীতে প্রকৃতির অংশ হয়ে, মানুষের জন্য… প্রকৃতির জন্য”।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য