আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

এনআরবি ডে বা অনাবাসী বাংলাদেশ দিবস হোক

আব্দুল করিম কিম  

বাঙালির বদনাম ছিল ঘরকুনো বাঙালি বলে। কিন্তু সিলেট অঞ্চলের বাঙালিরা দলে দলে যুক্তরাজ্য যাওয়া শুরু করলে সে বদনাম ঘুচতে থাকে। ১৭৪৪ সাল থেকেই কোলকাতা থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিকের কাজ নিয়ে সিলেটিদের বের হয়ে পড়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। ইংরেজ শাসনের প্রথম থেকেই সিলেটি নাবিকরা জাহাজে করে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে বন্দরে পৌঁছে যান। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ডে তার উল্লেখ রয়েছে। সেই সময়ে কোলকাতার খিদিরপুর জাহাজি নাবিকদের বিচরণভূমি বলে খ্যাতি লাভ করে। প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার নাবিকের ৭৫ ভাগই ছিলেন সিলেটি। ঐ সময় সিলেটের ঘরে ঘরে এই নাবিকদের পরিচয় ছিল “কোলকাত্তী” বলে। বিশ্বজয়ে বের হয়ে যাওয়া দিগ্বিজয়ী সিলেটি নাবিকদের পথ ধরেই আজ বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার বাঙালিরা পৌঁছে গিয়েছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে।

প্রবাসী সিলেটি বিষয়ক গবেষক নুরুল ইসলাম তার প্রবাসীর কথা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধে ২০/২৫ হাজার সিলেটি নাবিকের সলিল সমাধি হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের অত্যাচার, সাগরের বৈরী আবহাওয়া, বন্দরে বন্দরে “কালা আদমী” তিরস্কার, ভাষিক সঙ্কট দেশিয় খাবারের অপ্রতুলতা, পেছনে ফেলে আসা আত্মীয় পরিজনদের স্মৃতিসহ সমস্ত প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে সিলেটি নাবিকদের বিজয়ের ইতিহাসই বাঙালি জাতির প্রবাস যাত্রার ইতিহাস।

উন্নত জীবন ও দেশে থাকা পরিবার-পরিজনকে স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন নিয়ে শুরু হওয়া এই প্রবাস যাত্রা এখনো অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে জনশক্তি রপ্তানি আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সাল থেকে। বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটিতে পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর ১৯০টি দেশে ছড়িয়ে থাকা ফিলিপিনোদের পর ২য় এ্যাডভেঞ্চারাস জাতি হিসাবে বাংলাদেশিদের পরিচিত। বিশ্বের প্রায় দেড় শতাধিক দেশে ছড়িয়ে আছেন এই অনাবাসী বাংলাদেশিরা। কেউ কেউ বলেন, পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ নেই। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্রে, প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

এদিকে প্রায় ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি প্রতি বছর শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে এত মানুষের কর্মসংস্থান নেই। সে জন্য ভাগ্যান্বেষণে বিদেশগামী হতে বাধ্য হচ্ছে অন্তত পাঁচ-ছয় লাখ তরুণ-তরুণী। আর এই বিদেশগামী মানুষের কল্যাণে বাংলাদেশের অর্থনীতি সবচেয়ে স্বস্তিতে আছে। প্রবাসী আয়ের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা অর্জন কাল থেকে অর্থনীতির ভীত মজবুত হয়েছে। অনাবাসী বাংলাদেশিরা সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছেন।

২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বেশি রেমিটেন্স আসা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভিত্তি করেই দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে চলেছে। অনাবাসী বাংলাদেশিদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী করে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের মার্চে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবাসীরা যে পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন, দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে এত পরিমাণ প্রবাসী আয় আগে কখনও আসেনি।২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে রেমিটেন্স পাঠানোর ওপর প্রবাসী বাংলাদেশিদের ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। অর্থাৎ এক হাজার টাকা রেমিটেন্স পাঠালে প্রবাসীরা প্রণোদনা হিসেবে ২০ টাকা পাবেন। এই প্রণোদনার সুফল পেলে চলতি অর্থবছর থেকে প্রবাসী আয় বাড়তেই থাকবে।

দেশের জন্য প্রবাসীদের আত্মত্যাগ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই শুরু। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিমের নানান দেশে থাকা প্রবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিটিং-মিছিল করেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সে সব আন্দোলন বিদেশিদের নজর কাড়ে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে প্রবাসীদের এমন ভূমিকা ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন লন্ডন থেকে কলকাতায় ছুটে এসেছিলেন সদ্য প্রয়াত সিলেটের কৃতিসন্তান স্যার ফজলে হাসান আবেদ। খোঁজ নিয়েছিলেন রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’নামক সংগঠন গড়ে তোলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাঁদা সংগ্রহ শুরু করেন। এদিকে জেনেভায় অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে লন্ডন এলে তাঁর নেতৃত্বে বিলেত প্রবাসী সিলেটি'রা নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার রসদ ও অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু লন্ডনে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লন্ডনে অবস্থানরত সিলেটিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হবে প্রবাসীদের নাম।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রবাসীদের নাম সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছরপূর্তিকালেও প্রবাসীদের হয়রানী লাঘব হয়নি। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে অনন্য অবদান রেখে যাওয়া প্রবাসীদের রাষ্ট্রীয় ভাবে দেয়া হয়নি কোন স্বীকৃতি। তাই প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনকে বেছে নেয়া প্রয়োজন। সেই দিবসকে 'এনআরবি ডে' বা 'অনাবাসী বাংলাদেশ দিবস' বলা হবে। এই দিবস ঘোষণার জন্য ৪ মে'কে বেঁছে নেয়া যেতে পারে। ১৯৭৮ সালের ৪ মে, ইংল্যান্ডে বর্ণবিদ্বেষীদের হামলায় নিহত হয়েছিলেন অনাবাসী বাংলাদেশি আলতাব আলী।

'এনআরবি ডে' বা 'অনাবাসী বাংলাদেশ দিবস' চাওয়া কোন অযৌক্তিক চাওয়া নয়। এই দিবস ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে থাকা অগণিত অনাবাসী বাংলাদেশিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। দিবস পালনের মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি দেয়া হবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অবদান ও মূল্যায়ন হবে চলমান সময়ে রেমিটেন্স প্রবাহের অবদান। দিবস ঘোষণা হলে, দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি দূতাবাসে স্থানীয় অনাবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আয়োজন করা যেতে পারে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার। স্থানীয় দূতাবাস দিবস উপলক্ষে অনাবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সাফল্যকে দেশ ও জাতীর সামনে তুলে ধরবে। জানাবে স্বদেশের পক্ষ থেকে সম্মাননা। এছাড়াও প্রতিবছর একেকটি দেশকে বেছে নেয়া যেতে পারে 'প্রতিপাদ্য দেশ' হিসাবে। ঐ বছর প্রতিপাদ্য দেশে থাকা অনাবাসী বাংলাদেশিদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির চেষ্টা ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

'এনআরবি ডে' বা 'অনাবাসী বাংলাদেশ দিবস' উপলক্ষে দেশে থাকা প্রবাসীদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। সর্বোচ্চ রেমিটেন্স প্রদানকারী ও বিনিয়োগ উৎসাহী প্রবাসীদের এই দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবর্ধনা দেয়া যেতে পারে। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে অনবদ্য অবদান রেখে যাওয়া প্রবাসীদের জন্য এই উদ্যোগ নেয়ার এখনই সঠিক সময়। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলের সন্তান বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এই দিবস ঘোষণার জন্য উদ্যোগী হতে পারেন।

প্রবাসীদের বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহমর্মিতা রয়েছে। তাই 'এনআরবি ডে' বা 'অনাবাসী বাংলাদেশ দিবস' ঘোষণার দাবি নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে।

আব্দুল করিম কিম, সমন্বয়ক, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষা পরিষদ।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ