প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এস এম নাদিম মাহমুদ | ১৫ জানুয়ারী, ২০২০
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে ৮ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই তার বাবার নামের বানানে লিখেছেন লুৎফর রহমান আর মায়ের নাম তিনি লিখেছেন সায়েরা খাতুন ।
অথচ জাতির পিতার বাবার নাম শেখ লুৎফুর রহমান ( (ফ এর ু—(উ)কার নেই) এবং মাতার নাম সায়রা বেগম ( য়- ইকার আর খাতুনের পরিবর্তে বেগম) লিখেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাদের ওয়েব সাইটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ১৭ই মার্চ, ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফুর রহমান এবং সায়রা বেগমের ঘরে জন্ম নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণে বলেছিলেন, মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সেই ভাষণের সংক্ষিপ্তরূপে মুক্তিযুদ্ধ বিষয় মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ভাষণ করে কার্টুন ছবিতে লেখা হয়েছে ‘রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেবো। অথচ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তিনি ‘রক্ত’ শব্দটি আরও শব্দের পূর্বে বলেছিলেন।
যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল দেশের ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরা, বঙ্গবন্ধুকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাছে তুলে ধরা, সেই মন্ত্রণালয় কী ইতিহাস নিয়ে একটুখানি পড়াশুনা করার সময় পাননি?
খোদ এই ইতিহাসের রক্ষাকারী মন্ত্রণালয়ই তথ্য বিভ্রাট করে ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপন করতে শিখছে। যারা এই ওয়েব সাইট দেখে বঙ্গবন্ধুর জন্ম পরিচিতি জানবে তারা নিশ্চিত ভুল তথ্য জানার সুযোগ পাবে। আর সেটা করে দিচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
শুধু জন্মপরিচিতিতে তথ্য বিভ্রাট করে ক্ষান্ত নন তারা, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পরিচয়কে তারা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে।
মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে লেখা হয়েছে, ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। কট্টরপন্থী এই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন উদারপন্থী ও প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। এখানেই সান্নিধ্যে আসেন হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর।
অথচ শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে ১৯৩৮ সালেই তার সান্নিধ্যে আসেন।
বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত জীবনী’ ১৩-১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ১৯৩৮ সালে কলকাতায় যায় বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করি। আবদুল ওয়াসেক সাহেব আমাদের ছাত্রদের নেতা ছিলেন। তাঁরও সাথে আলাপ করে তাকেও গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করি। শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করবো। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল।
আমি শুধু এই কয়েকটি বাক্যে এই গুরুত্বপূর্ণ ভুল পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আরও ঘাটাঘাটি করলে তথ্য বিভ্রাট যে পাওয়া যাবে না তা বলা মুশকিল।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বিষয়ক বই থাকার পরও ওয়েব সাইটে কেন তথ্য বিভ্রাট তা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে থাকা মন্ত্রণালয় আমাদের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে উজ্জীবিত করার পরিবর্তে হিতে বিপরীত কাজটিতে এগিয়ে আছে।
শুধু বঙ্গবন্ধুর তথ্য বিভ্রাটে নয়, গেল বছর শেষে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের চিরচেনা ধ্যানধারণার আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে প্রকাশিত রাজাকারদের তালিকার প্রথম পর্ব। যদিও তালিকাটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে তবে তালিকাটি প্রকাশ করার পর থেকে সারাদেশে কয়েক ডজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার খেতাব টানিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্মানহানি করেছে তা সমগ্র জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে।
দেশের সূর্য সন্তানদের সম্মানহানি করার যে স্পর্ধা দেখিয়েছে তা বড়ই লজ্জার, বড়ই বেদনার। বিশ্বের আর কোন দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেয়া বীরদের এইভাবে স্বাধীনতা বিরোধী ‘দাপ্তরিক’ স্বীকৃতি দেয় কি না তা আমার ছোট মস্তিষ্কে কাজে আসছে না।
ভেবেছিলাম, বিষয়টি নিয়ে একটি বাক্যও লিখবো না, কিন্তু মন আর মানছে না। চুপ থাকা মানে হলো, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে স্বাধীনতার পক্ষের সরকারকে ঘারে তুলে নাচানো হবে।
আমি ভাবতেই পারছি না, বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায় থাকাকালীন কিভাবে এই ফাঁদে পা দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। যে মন্ত্রণালয়টির একজন কেরানী থেকে মন্ত্রী সবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ জানা শোনা থাকার কথা, সেই মন্ত্রণালয়ের এমন বেখেয়ালি কার্যকলাপ শুধু ব্যথিত করে না, আমাদের মস্তিষ্ককে অবনমিত করে দেয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বেইজ্জতি করে ছাড়লাম।
২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের পর থেকে প্রায় দুই দশকে এই মন্ত্রণালয় থেকে কতটুকু প্রাপ্তি হল, তার হিসেব কষতে বড়জোর কয়েক সেকেন্ড লাগবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ সমুন্নত রেখে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিয়ে গঠিত এই মন্ত্রণালয় স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা ও নাম প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে, ঠিক তেমনি চলতি বছরের বিজয় দিবসের আগে তড়িঘড়ি করে রাজাকার-আলবদর-আল-শামসদের নাম প্রকাশ করতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলেছেন।
মন্ত্রণালয় যে ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ ওই তালিকা প্রকাশ করেছেন সেখানে দেখা যাচ্ছে রাজাকারের তালিকায় বরিশাল, বরগুনা, রাজশাহী, বগুড়া ও ঝালকাঠি জেলার মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও একাত্তরের আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকজনের নাম ঢুকে দেয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়. রাজাকারদের এই তালিকাকে বিতর্কিত করতে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাজাকারের তালিকায় আনা হয়েছিল। যাতে করে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করতে বেকায়দায় পড়তে হয় সরকারকে।
অত্যন্ত নিখুঁত পর্যবেক্ষণে এবং স-জ্ঞানে এইসব নাম ঢুকে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কারা এই নাম ঢুকিয়েছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের পাল্টা-পাল্টি বক্তব্য গণমাধ্যমে এলেও আমি এইসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ, যে মন্ত্রণালয় হোক না কেন, রাজাকারের তালিকা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষের সরকারের আমলে।
এখন আপনি বলতে পারবেন না, এটি বিরোধীদলের সুপারিশে করা হয়েছে, আপনি বলতে পারবে না মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষের লোকেরা এই তালিকা তৈরি করেছে। এটি করা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের সময়। আপনি বুঝন বা না বুঝুন সর্ষে ভুতের খবর বলে প্রচার করতে চাইলেও আমি সেটি বলতে চাই না। প্রায় ১১ বছর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকার পর কিভাবে এমন ভুল হল, তা খতিয়ে দেখেই পার পাওয়া যাবে না। বরং তাদের খুঁজে বের করতে হবে। জনগণের সামনে তাদের আনতে হবে। বিচারের মুখামুখি করতে হবে।
আমার ক্ষুদ্র মাথায় এখনো বুঝ হল না, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাজটি কি? তিনি কি নিজের মন্ত্রণালয় ছেড়ে রোড অ্যান্ড হাইওয়ে মন্ত্রণালয়ের কাজ করেন? নাকি তথ্য মন্ত্রণালয়ের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিয়ে বেড়ান?
১০ হাজার রাজাকারের তালিকা যদি দিনে ২০০ জনের বিষয় খতিয়ে দেখা হতো তাহলে দুই মাসের বেশি লাগতো না। অথচ বাংলা আর ইংরেজির মিশেলে তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে অত্যন্ত অদক্ষতা আর অবহেলার আঁচড় দিয়ে। ওমুক গ্রামে তমুক রাজাকার বলে তালিকায় নাম দিয়ে সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে কার্যত তথ্য ভিত্তিক, নিজের নাম, বাবার নাম, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার ভূমিকা, বর্তমান অবস্থানসহ তুলে ধরলে অন্তত নতুন প্রজন্ম এইসব স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে পরিচিত হতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে অন্য একটি মন্ত্রণালয়ের দেয়া নাম নিজেরা যাচাই বাছাই না করে প্রকাশ করে, শুধু সময়ই নষ্ট করলো না বরং এই মন্ত্রণালয় থেকে বস্তুনিষ্ঠ রাজাকারদের তালিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন জন্ম দিলো।
যে মন্ত্রণালয় সামান্য এই কাজটি দেখভাল করতে ব্যর্থ হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করছে, সেই মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে নিজেরে সাত খুন মাপ করতে চাইলেও আমি তাতে সায় দিচ্ছি না। কারণ, এই মন্ত্রণালয় শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করেই বিতর্ক তৈরি করেনি, খোদ এই মন্ত্রণালয়ের ‘গুরুতর ভুল’ নিয়ে আমার যথেষ্ট কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
এই মন্ত্রণালয়ের কাজটি কি হবে, তা সরকারকে ঠিক করে দিতে হবে। দেড় দশকের বেশি সময় আগে জন্ম নেয়ার পর কোটি কোটি টাকা বার্ষিক বাজেট নিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধানের অগ্রগতি শূন্যের ঘরে গিয়ে ঠেকেছে। রাজাকারদের তালিকায় বলুন কিংবা বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস বিকৃতভাবে তুলে ধরা কতটা হীনকর কাজ তা মন্ত্রী মহাশয় বুঝছেন কি না আমি জানি না। পদত্যাগ দিয়ে সমাধান নয়, যারা এই কর্ম সম্পাদনে লেপ্টে আছেন, তাদেরকে চিহ্নিত করা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ বলেই মনে করি। আমাদের প্রজন্ম বেশ চাক্ষুষ। আপনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে কখনোই ইতিহাসের আলোকে ঢাকতে পারবেন না।
রাজাকারদের তালিকা নিঃসন্দেহে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অকাট্য দালিলিক প্রমাণ হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের জন্য কঠিন হয়ে পড়লে তা সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দিতে পারেন। যাদের নাম ১৯৭২ সালের দালাল আইনে এসেছে, সেটি সূক্ষ্ম ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে তুলে আনা যেত প্রকৃত রাজাকারদের নাম।
আমরা চাই না, আমাদের প্রজন্ম কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসকে ভুলভাল ভাবে জানুক। আমরা চাইবো, অকাট্য প্রমাণ। যে প্রমাণপত্র আমাদের ইতিহাসের স্তম্ভ হয়ে থাকবে। আর মুক্তিযুদ্ধকে লালন করে দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য