প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এখলাসুর রহমান | ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
ধর্মীয় ওয়াজ ও ধর্মীয় বক্তাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের নামে হচ্ছেটা কী? ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ মিজানুর রহমান আযহারীকে জামায়াতি প্রোডাক্ট বললেন৷ আবার ধর্মীয় বক্তাদের মাঝেও কেউ কেউ আযহারীর বিরুদ্ধে কথা বলছেন৷
ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক হলে এমন জামায়াতি প্রোডাক্ট কি কেবল মিজানুর রহমান আযহারী একাই? দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে এসব ওয়াজ মাহফিল৷ লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ ওখানে নিশ্চয়ই ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা শুনতে যাচ্ছে না৷ এই সহজ সরল মানুষদের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির বক্তা তাদের বক্তব্যবাজি পেশায় মেতে উঠেছে৷ তাদের বেশির ভাগই কন্টাক্টে বক্তৃতা দিতে যান৷
এলাকায় চাঁদা তুলে, শিশুদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে তাদের দিয়ে সাহায্য তোলা হচ্ছে৷ কোমলমতি শিশুদের করে তোলা হচ্ছে সাহায্য ও পরমুখাপেক্ষী হিসাবে৷ এসব ওয়াজে নিজ ধর্মকে বড় করতে অন্য ধর্মকে খাটো করে কথা বলা হচ্ছে৷ করছে ধর্মান্তরিতকরণ৷ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে তারা অন্যধর্মের অনুসারীদের ধর্মান্তকরণে উদ্বুদ্ধ করছে৷ তারা কথা বলছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও প্রগতিবাদের বিরুদ্ধে৷ অথচ এতে উপস্থিত থাকছে সরকার-দলীয় মন্ত্রী এমপিগণও৷
ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর কথা সত্য হলে তিনি কি পারেন না এসব ওয়াজ মাহফিলের জন্য একটি বিধিমালা করে দিতে? বিষয়টা যেহেতু ধর্মবিষয়ক আর তিনি ধর্মের মন্ত্রী এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা থাকার কথা নয়৷
দেলোয়ার হোসেন সাঈদীও তার বাক মধুতে আকৃষ্ট করে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ধর্মান্তকরণে উদ্বুদ্ধ করতো৷ আর এই খবর ফলাও করে প্রচার করতো তার অনুসারীরা৷ অনুরূপ কাজটিই করে চলছে মিজানুর রহমান আজহারী৷ আচ্ছা তিনি যে সনাতনদেরকে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করাচ্ছেন; কোনো সনাতন ধর্মীয় পুরোহিত কি কোন মুসলমানকে সনাতন বানিয়েছে কোথাও? এমনটি কেন হতে পারছে না? হিন্দু ছেলে মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করলেও এই মেয়েকে কিন্তু হিন্দু হতে দেখা যায় না৷ হিন্দু ছেলেটিকেই মুসলিম হতে হয়৷ আবার হিন্দু মেয়ে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করলে মেয়েটিকেই তখন মুসলিম হতে হয়৷ এই রীতিটাকে কি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সমর্থিত বলা যায়? এতে করে কি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ধর্মনিরপেক্ষতার সাদা চাদরে সাম্প্রদায়িকতার কালি মাখানো হলো না?
যে চার মূলনীতি ভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার একটি অন্যতম নীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা৷ ১৯৭৫ এর বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসকরা এটিকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করে ইসলামপন্থীদের তাদের পক্ষে নিতে চেষ্টা চালায়৷ তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জোট ১৪ দল ক্ষমতায় আসার পরেও সেটি বহাল রয়েছে৷ সাম্প্রদায়িক ইসলামপন্থীদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে ১৪ দল শরীকদের মতামতকেও উপেক্ষা করেছে প্রধান শরীক আওয়ামী লীগ৷
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার পক্ষে না থেকে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিল সেদিন শরীক দলের এমপিরা৷ এ সিদ্ধান্তকে শুধু তারা নয় আরও অনেকেই সাংঘর্ষিক বলেছিল৷ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয় কী করে? এটা খুবই সহজ প্রশ্ন৷ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম না রাখলে নিশ্চয়ই জামায়াত, হেফাজত, ইসলামপন্থী সাম্প্রদায়িক দল ও মিজানুর রহমান আযহারীরা বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে যেয়ে যেয়ে এই সরকারকে ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক বলা শুরু করে দিতো৷ সরকার নিশ্চয়ই সেই ভয়েই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখতে বাধ্য হয়েছে৷ কিন্তু এই বাধ্যতা কি শুভ না অশুভ?
রাষ্ট্র ও সরকার সাম্প্রদায়িক হলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু অসাম্প্রদায়িক৷ এর নজীর হিসাবে সরস্বতী পূজার দিনে ভোট বাতিলের দাবিতে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মানববন্ধন ও অনশনে অংশগ্রহণ৷ পশ্চিমবঙ্গে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বীকে সনাতন রীতিতেই সৎকার করলো মুসলিমরা৷ তাই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে সকল ধর্মের রীতির স্বীকৃতি অপরিহার্য৷ বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের সাধারণ মানুষরা চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল৷ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে কেবল সনাতন হতে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণের রীতি থাকলে চলবে না মুসলিম ধর্মাবলম্বীদেরকেও সনাতন ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার অধিকার থাকতে হবে৷
মিজানুর রহমান আযহারী ১১ জন মুসলমানকে হিন্দু সাজিয়ে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করল৷ তার প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মীয় বক্তা আমির হামজার চেয়ে তার জনপ্রিয়তা বেশি এমনটি প্রমাণ করতেই তিনি তা করলেন এমন কথাও বলছে অনেকেই৷ ধর্ম এক তবে ধর্মীয় বক্তাদের মাঝে এত বিভাজন কেন? জনপ্রিয়তা দিয়েই কি আসল নকল বিবেচ্য হয়? এক ইসলামের নেতাদের মধ্যে এত মতভেদ কেন? সুন্নি, শিয়া, কাদিয়ানী কেউই নিজেকে ছাড়া অন্যকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়?
বাংলাদেশে দেওয়ান বাগী হুজুরেরও লক্ষ লক্ষ মুরিদ রয়েছে৷ চরমোনাই হুজুরেরও রয়েছে৷ কিন্তু কেউ কাউকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়৷ এসব মতভেদের জন্যই কি আরব বিশ্বে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় নেতাদের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে সাধারণ মানুষ? বাংলাদেশও কি সে অবস্থার দিকেই?
যে ধর্মীয় নেতা অথবা রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধেও সাধারণ মানুষের অবস্থান। এমনকি অনেকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগও করছে বলে খবর বেরুচ্ছে। সম্প্রতি ইরাকে বিক্ষোভকারীদের মুখে স্লোগান ছিলো ‘ধর্ম অথবা সম্প্রদায়ে না।’ একই ধরনের স্লোগান ছিল লেবাননের বিক্ষোভকারীদের৷ তারাও বলছেন, ‘ইসলামে না, খ্রিস্টান ধর্মেও না; দেশের জন্য আন্দোলন করুন।’
আরব দেশগুলোতে সাধারণ জনগণের ওপর জরিপসংস্থা আরব ব্যারোমিটারের চালানো এক জরিপে ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের বিশ্বাস ব্যাপক মাত্রায় কমে আসার তত্ত্ব উঠে এসেছে৷ এই জরিপে তারা বলেছে, ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে ইরাকে চালানো জরিপে ৫১ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তাদের আস্থা নেই। এই সংখ্যা বর্তমানে আরও বেড়ে ৭৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ইসলামি দলগুলোর প্রতি এভাবে মানুষের কেন আস্থা ও সমর্থন কমে যাচ্ছে?
২০১৩ সালে যেখানে ধর্মীয় দলগুলোর প্রতি ৩৫ শতাংশ মানুষের আস্থা ছিল না। ২০১৮ সালে এসে কেন একই প্রশ্নে আরও ২০ শতাংশ মানুষ ধর্মীয় দলগুলোর প্রতি তাদের আস্থা নেই বলে জানালো? ধর্মীয় নেতাদের প্রতি মানুষের সন্দেহপ্রবণতা কেন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে? ২০১৩ সালে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫১ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, ধর্মীয় নেতাদের প্রতি তাদের ব্যাপক কিংবা মাঝারি মাত্রার বিশ্বাস আছে।
সংবাদপত্রে লিখল, গত বছর যখন একই প্রশ্ন করা হয়, তখন এই বিশ্বাসকারীদের সংখ্যা আরও কম পাওয়া যায়; ৫১ শতাংশ থেকে এই সংখ্যা ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতারা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন; এমন বিশ্বাসকারীদের সংখ্যাও কমে গেছে।
আরব ব্যারোমিটারের কর্মকর্তা মাইকেল রবিনস বলেন, ধর্মীয় নেতারা প্রায়ই শাসকগোষ্ঠীর হয়ে কাজ করেন। এমন ধারণা থাকায় নাগরিকরা তাদেরকে বিশ্বাস করেন না।
২০১৩ সালের জরিপে ৮ শতাংশ মানুষ নিজেদের ধার্মিক নন বলে পরিচয় দিলেও ২০১৮ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। যা সামগ্রিকভাবে তিউনিসিয়ার অর্ধেক তরুণ, লিবিয়ার এক তৃতীয়াংশ তরুণ, আলজেরিয়ার এক চতুর্থাংশ তরুণ এবং মিসরের এক পঞ্চমাংশ তরুণের সমান। ২০১৩ সালে মাত্র ৩৯ শতাংশ ইরাকি ধার্মিক নন বলে বর্ণনা করলেও ২০১৮ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশে। জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত ধর্মের প্রভাব ক্রিয়াশীল৷ মুসলমান পরিবারে নবজাতকের জন্ম হলে আজান দিয়ে আজানের ধ্বনি তার কানে পৌঁছানো হয়৷ মৃত্যুর পরেও ধর্মীয় রীতিতে তার জানাজা পড়ানো হয়৷ মুসলিমদের কাফন ও কবরের মাটি, সনাতনদের শ্মশান ও চিতার আগুন, খ্রিস্টানদের কফিন ও কবর সবই ধর্মীয় রীতি৷ ধর্ম না থাকলে মরার পরে মানুষ লাশ নিয়ে কী করতো? তারা এ নিয়ে সমস্যায় পড়ে যেতো না?
পৃথিবীর সভ্যতা ও শৃঙ্খলার ক্রমবিকাশে ধর্মের রয়েছে বিরাট ভূমিকা৷ কিন্তু আজকের দিনে মানুষের এই ধর্মবিমুখ হয়ে ওঠার দায় কার? এই প্রশ্নের উত্তর জানা খুবই জরুরি নয় কি?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য