আজ বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

❛সেভেন ডেডলি সিনস❜

মাসকাওয়াথ আহসান  

যে কোন দেশের যে কোন সময়ের স্বৈরাচারী শাসক ও তার অন্ধ সমর্থকদের মাঝে সাতটি মহাপাপ বা সেভেন ডেডলি সিনস খুঁজে পাওয়া যায়। এটি মারণঘাতী সাতটি পাপের মিশেল। যে বিষাক্ত পান পাত্র নিয়ে স্বৈরাচারী শাসক বসে থাকে; সেই বিষ পাত্র থেকে সে একটু একটু করে বিষ ঢেলে দেয় তার প্রজাদের মুখে। স্বৈরাচার একটি মানসিক ভারসাম্যহীনতার রোগের সব শেষ পর্যায়।

তীব্র যৌন আকাঙ্ক্ষা স্বৈরাচারের প্রথম বৈশিষ্ট্য। এই যৌন আকাঙ্ক্ষা অবদমিত থাকায়, স্বৈরাচারের সমর্থকেরা ধর্ষণ-কিডন্যাপের মতো ঘটনা ঘটায়। আবার স্বৈর- আবহে গড়ে তোলে এলিট এসকোর্ট ফোর্সেস। সে কারণে হিটলার, ইয়াহিয়া,এরশাদ নেতানিয়াহু,মোদি, কিম জং উন এরকম স্বৈরশাসককে প্রগলভ নারী পরিবেষ্টিত ছবিতে আপনি খুঁজে পাবেনই। স্বৈরাচারের সমর্থকেরাও স্বৈরযৌনতা স্মারক হিসেবে এমন প্রগলভ নারী পরিবেষ্টিত ছবি তোলে। নারীকে ট্রফি হিসেবে ভাবার ও তার ওপর ক্ষমতা প্রদর্শনের পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতা থেকে এমন স্বৈরশাসনকালে ক্ষমতা-প্রাপ্ত পুরুষেরা এমন ছবি তোলে। নিজেকে নারীদের হার্ট থ্রব দেখানোর সুপ্ত বাসনাও থাকে এতে।

বিজ্ঞাপন

স্বৈরাচারের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ভোগ বিলাসের অতিরিক্ত চাহিদা। বেশি খাওয়া-বেশি পরা-বেশি বাড়ি-বেশি গাড়ি। স্বৈররাজতন্ত্রের সৌদি আরবের স্বৈরক্ষমতা প্রাপ্ত লোকেদের লাইফ স্টাইল দেখলে ছবিটা স্পষ্ট হয়। এরকম ভোগের অভ্যাস রয়েছে দেশে দেশে স্বৈরাচারি শাসকের দুষ্টচক্রে বসবাসকারী রাজনীতিক, ফড়িয়া সমর্থক, ব্যবসায়ী, প্রশাসক-পুলিশ, সেনাদের মাঝে । অধুনা ফেসবুকে এদের সুইমিংপুলে সাঁতার কাটার কাইত হয়ে থাকা ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এ ছবিতে তাদের মুখটি স্বৈরগর্বে কাতলা মাছের মতো হয়ে থাকে।

স্বৈরাচারের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য পুকুর চুরি ও ডাকাতির আকাঙ্ক্ষা। "হাওয়া ভবন মডেল", "দোয়েল পাখি বিক্রি", "রূপপুরের বালিশ বিক্রি", "স্বাস্থ্যখাতের কাছিম কমিশন মডেল", শেয়ার-বাজার ও ব্যাংক লুণ্ঠন, দেশের বাইরে হাজার-কোটি টাকা পাচার; যেগুলোকে দুর্নীতি বলে হালকা করে দেখানো হয়; এসব আসলে স্বৈরশাসনের ক্যানসার রোগ; যা রাষ্ট্রকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। তুর্কমেনিস্তানের স্বৈরাচারই হোক আর উগান্ডার স্বৈরাচারই হোক; এর আশীর্বাদ প্রাপ্ত ছোট খাট জিনিসের হিটলারদের ভোগ-বিলাসের স্মারক হিসেবে পাবলিকের দোলায় বা রথে বসা ছবি পাওয়া যাবেই। ইদি আমিন থেকে সহমত আমিন সবার এমন দোলনায় বসা ছবি ইতিহাসে রয়ে গেছে।

স্বৈরাচারের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য এক ধরণের আধ্যাত্মিকতার ভেক ধরে, ধর্ম প্রদর্শন করে বা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে; সমাজের প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের নাগরিক অধিকারটি অগ্রাহ্য করা। কিছু মোল্লা-পুরুত-যাজককে নিয়ে স্পিরিচুয়াল গ্যাং বানিয়ে; সেই গ্যাংকেই জঙ্গিবাদের কাকতাড়ুয়া হিসেবে দেখিয়ে; অবশেষে তাদেরকেই খাসজমি ও অর্থ দিয়ে; আল্লার ওয়াস্তে দান করিলাম বলে স্পিরিচুয়াল গ্যাং-এর শোকরানা মেহেফিল আয়োজনের মহত-চক্রটি তৈরি করেন স্বৈরাচারি। ধর্মের লোক বলে এরা ক্ষমতার স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যাজক-পুরোহিত-মওলানার সঙ্গে স্বৈরাচারি শাসকের ফটোসেশান সেই সাদাকালো যুগ থেকেই চলে আসছে। ওদিকে নিরন্ন মানুষ বঞ্চিত থেকে যায় দেশের আনাচে-কানাচে। পাকিস্তানের জিয়াউল হক ও বাংলাদেশে এরশাদের এমন আধ্যাত্মিকতার নাটক ইতিহাসে রয়ে গেছে।

স্বৈরাচারের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ক্রোধ। স্বৈরাচারী শাসকের একই সঙ্গে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস অর্ডার আর বাইপোলার ডিস অর্ডার থাকায়; সে রেগে গেলে তার মাথা পারমানবিক চুল্লীর মতো গরম হয়ে যায়। এই চুল্লী ঠাণ্ডা করা কঠিন; কারণ স্বৈরাচারের ভক্তরা "অগ্নিতে ঘৃতাহুতি" দেয়া লোক। এরকম মানসিক রোগীদের মাথার চুল্লী শীতল হলে সে হিটলারের মতো ছবি আঁকতে পারে; নীরোর মতো বেহালা বাজাতে পারে। নিজের মহত্ব ফুটিয়ে তুলতে দুঃস্থ শিল্পীকে ডেকে চিকিৎসার টাকা হাতে তুলে দিতে পারে। এরকম দানের ফটোসেশান স্বৈরাচারের ইতিহাসে খুবই প্রচলিত।

বিজ্ঞাপন

স্বৈরাচারের ঈর্ষা ও প্রতিহিংসা এর ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। রাগ থাকলে প্রতিহিংসা থাকবেই। স্বৈরাচার যেহেতু তার সমালোচনা সহ্য করতে পারেনা ও নৃশংস হয়; সমালোচনায় বিক্ষুব্ধ সৌদি যুবরাজ এম বি এস তাই তার সমালোচক সাংবাদিক খাশোগজিকে হত্যা করলেন বর্বরভাবে। স্বৈরাচারের যেহেতু এলিট ফোর্স থাকে; আর তারা স্বৈর-পৃষ্ঠপোষকতায় পেশাদার খুনি হয়ে ওঠে; তাই স্বৈরশাসনকালে দেশ প্লাবিত হয়, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের রক্তবন্যায়। ইন্দিরা গান্ধীর অনুতাপহীন নকশাল হত্যা-স্বর্ণ মন্দিরে রক্ত বন্যা বইয়ে দেয়া এসবের মাঝে স্বৈরাচারী চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।

স্বৈরাচারের সপ্তম বৈশিষ্ট্য অহংকার; দম্ভ। স্বৈরাচারী নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবার ম্যাগালোম্যানিয়া রোগে ভুগেন। "আমি যা বুঝি তাই ঠিক", "যা করছি জনগণের ভালোর জন্য করছি" এই দম্ভের আস্ফালন পৃথিবীর সব স্বৈরাচারী শাসকের মুখে শোনা যায়। স্বৈরাচারের সমর্থকেরা "ফইন্নি থেকে স্বৈর আশীর্বাদ পেয়ে ধনী হওয়া লোক"; ফলে তারা প্রচণ্ড অহংকারে "সূর্যের চেয়ে বালি গরম হয়ে নিজেদের দেশের মালিক ভাবতে শুরু করে। তারা "অভিমতের মালিক" হয়ে যান। সে কারণেই কেউ ভিন্ন মত প্রকাশ করলে স্বৈরাচারিরা এই সরকার বিরোধী অভিমতকে "রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের তকমা" দেয়। স্বৈরাচারের আজ্ঞাবহ এলিট ফোর্স ভিন্নমতপোষণকারীদের গুম ও গ্রেপ্তার শুরু করে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ