আজ শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

দেশ আজ বিশ্ব লাস্ট বেঞ্চারের খপ্পরে

মাসকাওয়াথ আহসান  

করোনার মাঝে "সরকারি কর্মচারীদের ফেসবুক ব্যবহারের" ক্ষেত্রে চাকুরিবিধি মেনে চলার নির্দেশটি ফলাও করে ছেপেছেন যারা; তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অনুশীলিত আচরণ বিধি আর চাকরিজীবনের শুরুতেই বাংলাদেশ লোক প্রশাসন কেন্দ্রে (বিপিএটিসি) পাওয়া বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও বিভাগীয় প্রশিক্ষণ সম্পর্কে কোন ধারণা রাখেন না বলে মনে হয়েছে।

এইভাবে ঘটা করে যে দপ্তর নির্দেশ প্রকাশ; তা দেখে বোঝা যায়; অত্যন্ত অপেশাদার নীতি নির্ধারকদের খপ্পরে পড়েছে বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

সরকারি কর্মচারীদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও বিভাগীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা তরুণ-তরুণীদের শেখানো হয়; কীভাবে নেপথ্যকর্মী হতে হয়; কীভাবে স্মিতবাক হতে হয়; কীভাবে প্রতিটি শব্দচয়নে সচেতন হতে হয়; আর সবার সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌজন্য বোধ নিয়ে কথা বলতে হয়।

বুনিয়াদি প্রশিক্ষণটি একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ। ব্রিটেনের কমনওয়েলথ সচিবালয়ের প্রশিক্ষণ আর বাংলাদেশের লোক প্রশাসন কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ একই মানের। ব্রিটেনে খুঁজে পেতে দেশের সেরা রিসোর্স পারসনদের যেমন প্রশিক্ষণ দিতে ডাকা হয়; বাংলাদেশেও ঠিক তাই করা হয়। সেই দিক থেকে বলা যায়, বিপিএটিসি প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনন্য। দুটি দেশের এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে এই অনুসিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করলাম।

ফেসবুকে নতুন বিসিএসে যোগদান করা কিছু তরুণ-তরুণীর একটু শো-অফ, একটু অতিকথন; মাঝে সাঁঝে চোখে পড়ে। এটা খুব স্বাভাবিক। সেনাবাহিনীতে যেমন মানুষ জেনারেল হয় দু'বার। প্রথমে সে যখন চাকরিতে ঢোকে তখন সে মনে মনে নিজেকে জেনারেল ভাবে; জেনারেলের মতো আচরণ করে; সৌভাগ্যকে উদযাপন করে। আর দ্বিতীয়বার চাকরিজীবনের শেষদিকে সে যখন সত্যিই জেনারেল হয়।

কিন্তু খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নিতে জানে সিভিল ও আর্মড ফোর্সেসের তরুণেরা। আর এ ক্ষেত্রে তার সহকর্মীরা ও একটু সিনিয়ারেরা খুব সাহায্য করে। আচরণের বাহুল্য ছেঁটে ফেলে স্বাভাবিক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে প্রত্যেকেই। তাই ঘটা করে করোনাকালে তাদের হিতোপদেশ বিতরণের কোন প্রয়োজন ছিলো বলে মনে হয় না।

চাকুরিবিধি অনুযায়ী সরকার বা অন্য যে কারো প্রকাশ্যে সমালোচনা করা যাবে না; এটা জেনেই সরকারি চাকুরিতে আসে তরুণ-তরুণীরা। কেউ কেউ আগবাড়িয়ে দলীয় ক্যাডারের ভঙ্গিতে সরকার সমর্থন করে। কাজটা বে-আইনি। বে-আইনি কাজে সাফল্য স্থায়ী হয় না।

সরকারি চাকরিতে ভালো প্রশিক্ষণের ও অসদাচরণের ক্ষেত্রে বিভাগীয় তদন্তের সুযোগ থাকায়; আচরণের ভ্রান্তি-সংশোধনের সুযোগ থাকে। ফেসবুকে কোন সরকারি কর্মচারীর অসদাচরণের খবর এলে; সেটা তদন্ত করে সে দায়ী হলে দ্রুত তার শাস্তি হয়। আর এ কারণে করোনাকালের শুরুর দিকে সরকারি কর্মচারীদের কিছু অসদাচরণ চোখে পড়লেও; ধীরে ধীরে তারাই করোনাকালে মানুষের খুব কাছের বন্ধু হিসেবে কাজ করতে শিখে ফেলে। দ্রুত যে কোন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো তাদের প্রশিক্ষণের অংশ।

বিজ্ঞাপন

যে সমাজ মায়ার সমাজ বলে শতবছর ধরে একটা বড়াই ধরে রেখেছে; সেইখানে মায়ের করোনা হয়েছে শুনে সন্তান তাকে ফেলে গেছে; সেই অসহায় মায়ের পাশে সন্তানের মতো দাঁড়িয়েছে সরকারি কর্মচারীরা। করোনায় মৃতের লাশ আত্মীয়েরা ফেলে পালালে পুলিশ-প্রশাসনের ছেলেরাই মায়ের দাফন করেছে; চিতায় মুখাগ্নি করার সন্তানের দায়িত্ব তারাই পালন করেছে। এলাকার কাউন্সিলর করোনা আক্রান্তের খবর শুনে এপার্টমেন্টে তালা লাফিয়ে দিলে; পুলিশ-প্রশাসন গিয়ে অসহায় মানুষকে উদ্ধার করেছে। এই করোনাকালে এটুকু অনুধাবন করা গেলো; সিভিল সার্ভিসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ অত্যন্ত কার্যকর এক ভিত্তি গড়ে দিতে সক্ষম। যেখানে শৃঙ্খলা-মানবতা-ধৈর্য-পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানো এই গুণগুলো সরকারি কর্মচারীর অবচেতনে গেঁথে দেয়া হয়।

করোনাকাল ডাক্তার-প্রশাসক-পুলিশ ও জরুরি দায়িত্বে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সঙ্গে দেশের জনগণকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এই দুঃসময়ে এটা বাংলাদেশের একমাত্র শুভ চিহ্ন।

এসময় "ঝিকে মেরে বৌকে শেখানোর মতো"; প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে "গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমালোচনা করতে নিষেধ করা" অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে। সিভিল সার্ভিসের সদস্য তার চাকরিবিধি অনুযায়ী চলে। ফলে সে অন্য যে কারো চেয়ে ভালো জানে; প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি নাগরিক গুরুত্বপূর্ণ। কারো সমালোচনা করা তার দায়িত্ব নয়; তার দায়িত্ব জনগণকে সেবা দেয়া।

আমাদের দেশের বাস্তবতায় একবিংশ শতকে ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চাররা রাজনীতিতে আসে; আর ফার্স্ট বেঞ্চাররা সিভিল সার্ভিসে আসে। ফার্স্ট বেঞ্চারের সামনে প্রায় প্রতিদিন শিক্ষকের শাস্তিতে হাঁটুগেড়ে বসে থাকা বা কানমলা খাওয়া ছাত্রেরা যখন রাজনৈতিক নেতা হয়; তখন ফার্স্ট বেঞ্চারের প্রতি গুপ্তক্রোধ রয়ে যায় তার অবচেতনে। এ কারণেই আকস্মিকভাবে ক্ষমতা পেয়ে ফার্স্ট বেঞ্চারের 'শিক্ষক' সেজে তাকে 'শিক্ষা' দেবার সংকল্প থাকে লাস্ট বেঞ্চারের।

সরকারি কর্মচারীদের "ফেসবুক আচরণবিধির ফতোয়া জারির" বুদ্ধিটি কোনো লাস্ট বেঞ্চার নীতি-নির্ধারকের অকাজ; এটা খুব স্পষ্ট।

যেহেতু নীতি নির্ধারক অকাজের ঢেঁকি; করোনাকালে তাকে কোন দায়িত্ব দেয়া সম্ভব হয়নি; কারণ তাকে দিয়ে টেকাটুকার ধান্দা ছাড়া আর কোন কাজ সম্ভব না; এটা বোঝা গেছে ২০০২ থেকে ২০২০ অবধি। তাই প্রধানমন্ত্রী সিভিল সার্ভিসের ফার্স্ট বেঞ্চারদের জরুরী করোনা পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। ফলে নাই কাজ লাস্ট বেঞ্চারদের প্রত্যেকদিনের কাজ; কে উহার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করিয়াছে তা খুঁজিয়া বাহির করা।

চিন্তা করেন, মানুষ করোনায় মরছে; আর করোনাকালে ওএসডি হওয়া অকর্মণ্য পলিসি মেকার আছে তার ভাবমূর্তির ব্যামো নিয়ে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। ফলে এরা খয়ের খাঁ জাতীয় রিপোর্টার দিয়ে "ভাবমূর্তির ক্ষতিকারী" লেখক-সাংবাদিক-ফেসবুকারদের তালিকা তৈরি করছে। যে পুলিশটির জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকার সময়; তাকে পাঠাচ্ছে লেখকদের দড়ি দিয়ে বেঁধে আনতে। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র লেখা করোনাকালে একজন পুলিশের দায়িত্ব নয়। তার দায়িত্ব করোনাকালে মানুষকে সাহায্য করা।

তাই করোনাকালে প্রশাসন-পুলিশ-এলিটফোর্সের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়া অনুচিত। সে চায় "সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং সুরক্ষায়" জনগণকে সচেতন করতে, ত্রাণ চুরি ও ডাকাতি ঠেকাতে; কিন্তু রাজনীতির কিছু রূপের রাণী চোরের রাজা; তাদেরকে বাধ্য করছে জনগণকে জেল-জুলুমের ভীতির মাঝে রাখার দলীয়- লেঠেল হিসেবে কাজ করতে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন