প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. শামীম আহমেদ | ০৭ অক্টোবর, ২০২০
এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে বলে মনে করি। বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর বিরলতম দেশগুলোর একটি যেখানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ধারার কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি এখনও। পৃথিবীর অনেক দেশে যেখানে ‘সেকেন্ড-ওয়েভ’ এসে শেষ হয়ে গেছে, কেউ কেউ যেখানে ‘থার্ড-ওয়েভের’ অপেক্ষায় আছে, সেখানে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক সংক্রমণই এখনও অব্যাহত আছে। এই অবস্থায় ১৩ লক্ষ শিক্ষার্থীর এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্য, তিন দিক দিয়েই হঠকারী হতো বলে মনে করি।
সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
১৩ লক্ষ শিক্ষার্থীর জন্য কমপক্ষে ২৬ লক্ষ অভিভাবক একমাস ধরে নানা সময়ে স্কুল কলেজে যাতায়াত করে। তাদের আনা-নেওয়ার জন্য প্রাইভেট কার, রিকশা, ভ্যান, সাইকেল ইত্যাদি যানবাহনে সংশ্লিষ্ট থাকে আরও কমপক্ষে ১৩ লক্ষ মানুষ। বাসে করে বা হেঁটে যাওয়া-আসা করলে, পরীক্ষা হলে নকল সাপ্লাই দেয়া, নকল ঠেকানোর জন্য পুলিশ, শিক্ষার্থীদের ছবি তোলার জন্য সাংবাদিক, বাদামওয়ালা, চানাচুরওয়ালা, নকল ও ফাঁস প্রশ্নের ফটোকপি, উত্তর তৈরি, প্রিন্ট, প্রশ্নপত্র সারাদেশে পরিবহন, কিছু অসুস্থ শিক্ষার্থীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, নার্সসহ নানা কাজে সংশ্লিষ্ট থাকে আরও কমপক্ষে ৭-৮ লক্ষ মানুষ। সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ মানুষ সরাসরি সংশ্লিষ্ট থাকে এইচএসসি পরীক্ষার সাথে। করোনা ভাইরাসের মতো একটা মহামারির ক্ষেত্রে ৫০ লক্ষ মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে এবং দুই কোটি মানুষকে পরোক্ষভাবে সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলার সিদ্ধান্ত হতো অবিবেচক।
বিজ্ঞাপন
মহামারি ব্যাপকতার নিরিখে বিশ্লেষণ
উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতা কারও নেই। ভ্যাক্সিন, বা ওষুধ আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত করোনাকে ঠেকিয়ে রেখে নানা স্তরে ও নানা সময়ে সংক্রমণ ঘটানোর চেষ্টা করছেন বিশ্ব নেতারা। অর্থাৎ তারাও জানেন বেশিরভাগ মানুষের একদিন না একদিন করোনা হবেই, কিন্তু একসাথে সারা বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষের তা হলে সেই বিপর্যয় সামলানোর মতো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শক্তি এই পৃথিবীর নেই। আমাদের বৈশ্বিক সামষ্টিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও একবারে খুব বেশি রোগী সামলাতে পারবে না, তাই এর বিস্তৃতি ঘটাতে হবে ধীরে ধীরে। করোনা প্রতিরোধে সারা বিশ্বে যে চলমান যজ্ঞ, সেটি তাই মূলত করোনা প্রতিরোধে নয়, করোনার বিস্তার ধাপে ধাপে ঘটানোর অংশ মাত্র। এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের মাধ্যমে আমরা সেই বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রযাত্রার অংশ হলাম। অভিনন্দন বাংলাদেশ সরকারকে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিবেচনাতেও এই পরীক্ষা বাতিল জরুরি ছিল। শিশু-কিশোরদের নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ অনেক স্পর্শকাতর। যদিও করোনা ভাইরাস সংক্রমণে শিশুদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম, তবুও অবশ্যই আমরা চাইব না আমাদের শিশুরা কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হোক। তাছাড়া, আমাদের সমাজে যেহেতু এখনও যৌথ পরিবারের সংখ্যা অনেক, সেহেতু শিশুদের মাধ্যমে প্রবীণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সেই বিবেচনায়ও এই পরীক্ষা বাতিল যৌক্তিক ছিল।
একটি রাষ্ট্র যখন সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার ভোটারদের আবেগকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমরা সারা বিশ্বেই দেখেছি স্কুল খোলা নিয়ে সরকারগুলোকে বেশ ঝক্কির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমাদের সরকার এই ক্ষেত্রে অগ্রসর থেকেছে, তারা স্কুল খোলেনি এবং এখন এইচএসসি পরীক্ষাও বাতিল করেছে। এই সিদ্ধান্ত তাদের ভোটারদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবারও ইঙ্গিত বহন করে। রাজনৈতিক বিবেচনায়ও এটি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত।
সামাজিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিত
সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই কারণে যে শিশুদের শিক্ষাকে এখানে বেশি গুরুত্ব দিয়ে, প্রথাগত মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে কম জরুরি মনে করা হয়েছে। যেখানে এইচএসসির আগে আরও দুটি পাবলিক পরীক্ষার যৌক্তিকতা কী, এই বিষয়ে নানা বিতর্ক হচ্ছিল গত প্রায় অর্ধ-দশক ধরে, সেখানে শিক্ষাবিদরা ওই দুটি পরীক্ষার যৌক্তিকতা প্রমাণেরও একটি সুযোগ পেলেন এই এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল হবার কারণে। কেননা, এখন জেএসসি এবং এসএসসির ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই শিক্ষার্থীদের এইচএসসির ফলাফল নির্ধারণ করা হবে। এই পরীক্ষা দুটি যদি ভবিষ্যতে থাকে, তবে কেন এগুলো জরুরি তার একটি শক্ত কারণ পাওয়া।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরীক্ষা বাতিলের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায়
আরেকটি কারণে আমি মনে করি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি গুরুত্বপূর্ণ আর সেটি হচ্ছে সকল শিক্ষার্থীকে পাস করানোর ঘোষণা। বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের মূল্যায়নের জন্য প্রচলিত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষার গুরুত্ব ক্রমাগত কমে আসছে, এবং অনেক দেশের এখন পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেয়া হয়েছে। কিছু উন্নত দেশে এসব বন্ধ করা হয়েছে এমনকি কয়েক যুগ আগে। বলা হচ্ছে, একজন শিক্ষার্থীর জানার সুযোগ ও জ্ঞান আহরণের পরিধি বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থী প্রতি বছর আগের বছরের চাইতে জ্ঞান আহরণে কতটা এগুলো সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে অন্যদের চাইতে এগুলো কিনা সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই পরীক্ষায় পাস-ফেলকে আস্তে আস্তে কম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার মূল যে উদ্দেশ্য, জ্ঞানার্জন এবং তার প্রয়োগ– তার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষার সংখ্যা কমে আসলে কোচিং সেন্টার, স্কুলের পর সন্ধ্যাবেলায় প্রাইভেট টিউশনি এই বিষয়গুলি ধীরে ধীরে কমে এসে আমাদের শিক্ষার মানকে বাড়াতে সাহায্য করবে, শিক্ষার্থীরাও প্রশ্নফাঁসের অপেক্ষায় না থেকে জ্ঞানার্জনে আগ্রহী হবে।
তবে এই ধরণের পরিবর্তনে যারা ‘অতি-মেধাবী’ শিক্ষার্থী, তারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত ও অনুৎসাহিত হয়। এই ধরণের ‘অতি-মেধাবী’দের খুঁজে বের করে, তাদের উপযোগী বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ করে দিতে হবে। পরীক্ষা বাতিলের ফলে তাদের মেধা যাতে বিফলে না যায়, সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়াও জরুরি।
সার্বিকভাবে একজন জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক হিসেবে করোনা মহামারি সময়কালে এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের মতো সময়োচিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ জানাই।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য