আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বৈশ্বিক অনলাইন প্লাটফর্মে দেশের ভাবমূর্তি বজায় রাখছেন কি?

ড. শামীম আহমেদ  

গত বেশ ক’বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারকাদের পেইজে সর্বসাধারণের মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তারকারা তাদের ছবি প্রকাশ করার সাথে সাথে তার নিচে মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়, যেটা অনেকাংশেই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মন্তব্যের মধ্যে ব্যক্তি আক্রমণ এবং কুৎসার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে এবং এটি স্বাভাবিকভাবেই অনেককে উদ্বিগ্ন করছে। অনেক ক্ষেত্রে তারকাদের সন্তান, স্ত্রী বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যও এইসব অনলাইন আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশী চলচ্চিত্র তারকা জয়া আহসানের পেইজে তার ছবির নিচে এমন সব ব্যক্তিত্বের আপত্তিকর মন্তব্য আমি দেখেছি যা আমাকে বিচলিত করেছে। এটি বলার অবকাশ রাখে না জয়া আহসান বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা পাড়ার দোকানে সৌন্দর্যের চর্চা হতে পারে, সেখানে হয়ত ভাষার বেড়াজালও শিথিল থাকতে পারে, কিন্তু একটি অনলাইন প্লাটফর্ম, যেখানে সবাই সবার মন্তব্য পড়ছেন, জানছেন, সেখানে অভব্য আলাপচারিতা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। এই ধারাটি যে শুধুমাত্র বিনোদন তারকাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে তাই নয়, রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, সমাজসেবী, এমনকি ব্লগার সবার ক্ষেত্রেই ঘটছে।

ইদানীং লক্ষ্য করছি প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের আক্রমণের ধারাটি দেশীয় প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মার্ক জুকারবার্গ, বিল গেটসসহ ধনকুবের, আন্তর্জাতিক তারকা, বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেইজে বাংলাদেশীদের কটু মন্তব্য আমাকে অনেককে বিচলিত করছে। অনেক ক্ষেত্রেই এইসব কমেন্ট তারা করছেন বাংলায়, সাথে বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি এমন সব বড় প্লাটফর্মে এর প্রতিবাদ করতে ভয় পাই। জোটবদ্ধ আক্রমণের শিকার আগে হয়েছি, তাই এখন একা একা লড়াই করার প্রবণতা খানিকটা কমেছে।

কিন্তু নিজের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হোক এটা কখনই মেনে নিতে পারি না। বিদেশের মাটিতে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ নাগরিক হিসেবে থাকি বিধায়, এই ব্যাপারটা আরও বেশি পোড়ায়। বিশ্বের একটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধারে পড়ি এবং তরুণ শিক্ষার্থীদের পড়াই বলে, সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের গল্প করি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মাত্র ৫০ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হওয়ার যাত্রাটুকু, কীভাবে সামাজিকখাতে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ আমাদের এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে– এই বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই নিরলস চেষ্টার নানা পর্যায়ে যখন দেখি বিশ্ববিখ্যাত তারকাদের ফেইসবুকে পোস্টে বা লাইভে বাংলায়, বাংলাদেশী পতাকাজুড়ে দিয়ে দেশটাকে ছোট করা হচ্ছে– তখন মনটা খারাপ হয়।

একা আমার পক্ষে এই গোষ্ঠীটির বিপক্ষে লড়াই করা সম্ভব না হলেও, আমি আমার লড়াই করার অস্ত্রটি খুঁজে নিয়েছি। আগে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ব্যক্তিদের পেইজে আমি কখনই মন্তব্য করতাম না। কিন্তু এখন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার জন্য আমি সুযোগ পেলেই সেখানে গঠনমূলক মন্তব্য করার চেষ্টা করি। এইসব হাজারো মন্তব্য তারকারা হয়ত পড়েন না, কিন্তু সারা বিশ্বের নানা দেশ থেকে তাদের ভক্তকূলরা নিঃসন্দেহে এইসব মন্তব্য পড়ে নানা দেশ ও তাদের সংস্কৃতি ও শিক্ষা নিয়ে ধারণা করার চেষ্টা করেন। আমি চেষ্টা করি আমার মন্তব্য দিয়ে যদি একজন মানুষেরও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা হয়, তাহলে সেটি আমাদের প্রাপ্তি। আমি শুধু একাই তা করি এমনটা নয়; আরও অনেকেই করেন, কিন্তু আমাদের সংখ্যাটা তির্যক মন্তব্যকারীদের তুলনায় নস্যিতুল্য বটে।

৫ জুন ২০২১, Startup Pakistan নামের একটি ফেইসবুক পেইজে একটি রিপোর্ট ছাপা ছাপা হয়েছে - “Bangladesh is now richer than India and Pakistan” এই শিরোনামে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, গত একবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে ৯%, বাংলাদেশীদের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৪৩ ডলার এবং ভারতের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯৪৭ ডলার। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের চাইতে ৭০ শতাংশ ধনী ছিল, আর আজ ২০২১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চাইতে ৪৫ শতাংশ ধনী।

এই রিপোর্টটির নিচে কিছু বাংলাদেশী এবং অসংখ্য পাকিস্তানী বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তারা বলেছেন বাংলাদেশের উন্নতি থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ঘুরে ফিরে বার বার শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং ভারত বা পাকিস্তানের চাইতে সেনাবাহিনীকে কম গুরুত্ব দেয়া বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল কারণ বলেছেন অনেকে। এছাড়াও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, নারী স্বাধীনতা, গার্মেন্টস শিল্পে অগ্রগতি, শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বও এই উন্নতির কারণ মনে করছেন অনেকে।

এই রিপোর্টের নিচে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশীদের গঠনমূলক মন্তব্য যেমন আমাকে উৎসাহিত করেছে, ঠিক একইভাবে অসংখ্য বাংলাদেশীর তির্যক এবং স্থূল মন্তব্য আমাকে হতাশ করেছে। আমরা ১৯৭১ এ পাকিস্তানকে হারিয়েছি, স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে প্রতিরক্ষা ছাড়া প্রায় আর সবক্ষেত্রে আমরা তাদের চাইতে এগিয়ে– এই অনুভূতির কোন তুলনা হয় না। কিন্তু অনেকের মন্তব্য দেখলে মনে হয় ১৯৭১ এ পাকিস্তান হারেনি, আমরাই হেরেছি। স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছর পরেও ক্রমাগত পাকিস্তান ও পাকিস্তানীদের বিদেশী অনলাইন প্লাটফর্মে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দেখলে বিভ্রান্তি হওয়া সম্ভব যে আমরা আসলেই যুদ্ধে জিতেছি কিনা! একটি পরাজিত শক্তির সাথে বারংবার নিজেদের তুলনা করাও আমাদের জন্য কোন উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশের তুলনা হতে হবে ভারতের সাথে, চীনের সাথে– এবং হ্যাঁ, ক্যানাডার সাথে হলেও সমস্যা নাই। লক্ষ্য যদি উঁচু না হয়, তাহলে আমরা এগুবো কী করে।

এই রিপোর্টের নিচে আমি একটি মন্তব্য করেছি। আমি চাই আমার গঠনমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে পাকিস্তানসহ পৃথিবীর প্রতিটা দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাক। ধারণা নিক বাংলাদেশীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির গভীরতা নিয়ে। আমি বলেছি,

“Bangladesh made tremendous progress mainly because of the leadership of Sheikh Hasina, who is the daughter of the father of the nation of Bangladesh – Sheikh Mujibur Rahman. She has strongly neutralised all Islami extremists and invested in social development. Supporting poor and marginalised with social capital made it possible to bring millions of people out of poverty.

It’s been 50 years that Bangladesh won their independence against Pakistan and utilized that independence to become the second strongest economy in South Asia after India.

This is not a time to fight amongst the South Asian countries any more, rather every country should fight against terrorism, extremism, army ruling and militancy.

As a Bangladeshi, I am extremely proud of my country, and also hope all other countries in South Asia including Pakistan will do well and progress further.

Best.”

আমার এই মন্তব্যের মাধ্যমে একদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের কথা উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশ যে এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে এবং মূলত ভারতের সাথেই তুলনীয় সেটি উল্লেখ করেছি। সাথে সাথে কোন দেশ সম্পর্কে বাজে মন্তব্য না করে সবার উন্নতি কামনা করেছি, আবার বুঝিয়ে দিয়েছি উন্নতির অগ্রযাত্রায় কারা সেরা।

আমি মনে করি স্বাধীনতার ৫০তম বছরে আমাদের আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও প্লাটফর্মগুলোয় আরও সরব হতে হবে, তবে তা হতে হবে সুবিবেচনাপ্রসূত ও গঠনমূলক উপস্থিতির মাধ্যমে। নিজের বাসায় বা পাড়ার আড্ডায় আমরা মন খুলে কথা বলব ঠিকই, কিন্তু যেখানে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করার প্রশ্ন আসে, সেখানে আমাদের সবারই কিছুটা সংযত হওয়া দরকার বলে বিশ্বাস করি।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ