আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সনাতন নারীর ক্ষমতায়নে উত্তরাধিকার আইন

কেশব কুমার অধিকারী  

সনাতন নারীর ক্ষমতায়নে উত্তরাধিকার আইনের প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই বিবেচনা করা উচিত জাতীয় প্রেক্ষাপটে এ সম্প্রদায়ের সার্বিক পরিসংখ্যানগত পরিস্থিতি। বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিগত ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৩.৩ মিলিয়ন (৮.৩৯%)। তার মধ্যে নারীর সংখ্যা ৬.৫ মিলিয়ন (৪.১%)। বাংলাদেশে উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত মোট নারীর সংখ্যা ১১২ মিলিয়ন (২৩.৬৭%)। এর সরল অনুপাতে সংখ্যালঘু নারীর সংখ্যা হওয়ার কথা ১ মিলিয়নের মতো। বাস্তবে সেই সংখ্যার অস্তিত্ব কোন অবস্থাতেই দৃশ্যমান নয়। গৃহস্থালি কর্মযজ্ঞকে এখানে উৎপাদনশীল খাতে ধরা হয়নি। উৎপাদনশীলতায় নিয়োজিত নারী সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক সূচককে প্রভাবিত করে।

গত ৩১ মার্চ ২০২১ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোর ‘নারী-পুরুষ সমতায় ডব্লিউইএফ-এর তালিকায় পিছিয়েছে বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন দৃষ্টিগোচর হয়েছিলো। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ক এই প্রতিবেদনে যদিও দেশের হিন্দু বা সনাতন নারী সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছু বলা নেই তবে সামগ্রিকতার নিরিখে সম্প্রদায়ে এর স্বাভাবিক প্রভাব সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যাবে। বিগত এক বছরে গোটা বিশ্বের সাপেক্ষে বাংলাদেশ নারী-পুরুষ সমতায়নে ৫০তম অবস্থান থেকে ২০২১ সালে ৬৫তম অবস্থানে নেমেছে। যার পরিণতি স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিটি সম্প্রদায়ে পড়বে। সরল সংখ্যানুপাতিক হারে এখন সহজেই সমাজে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীকুলের অবস্থা অনুমান করা চলে। তবে সম্ভবত এই বাস্তবতা কল্পিত অনুপাতের চাইতে আরও বেশি ভয়াবহ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত চারটির মধ্যে একমাত্র রাজনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের নারীবৃন্দ একই অবস্থানে থেকে গেলেও অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষায় নারীর অবস্থান পড়ন্ত। এটি দৃশ্যমান। সেই রাজনীতিতে দৃশ্যমান সনাতন নারীর অংশগ্রহণের বর্তমান চিত্র থেকেই দেশে সনাতন নারীর বাস্তবিক অবস্থা নির্ধারণ করা চলে। কাজেই নারীর ক্ষমতায়নে এই বাকি তিনটি সূচকের উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। তার প্রেক্ষিতে আজকে যদি আমরা সমাজের নারীর ক্ষমতায়নের দিকে তাকাই তাহলে কী করণীয় তা স্পষ্টভাবে বোধগম্য বলে মনে করি। অন্যদিকে, নারীর সমতায়নের বিষয়টিও বৈশ্বিক উন্নয়ন মডেলে চারটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে প্রথমত: ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নারীর মালিকানা এবং দ্বিতীয়ত: মজুরি এবং কর্মপরিবেশ, তৃতীয়ত: ন্যায়বিচার ও যথার্থ মূল্যায়ন এবং সর্বশেষ নারীর নেতৃত্ব গ্রহণের ক্ষমতা।

উপরোক্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিলে আমরা দেখবো যে বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে নারী সমাজের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রধান কার্যকরণটিই সম্প্রদায়গত আইনের নিরিখে আসলে অনুপস্থিত। হিন্দু সমাজভুক্ত নারীর তো নেইই, সামগ্রিক ভাবে ভূমি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে বাংলাদেশের নারীর অধিকার অধ্যাপক ড. আব্দুল বারাকাতের ‘নারীর ভূমি অধিকার ও বঞ্চনা’ শীর্ষক গবেষণায় মাত্র চার ভাগ দেখা যায়! এ বড্ড ভয়াবহ অবস্থা!

বর্তমান হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে হিন্দু সমাজ এবং নারীকুলের বাস্তবতা
দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার মতামত বিভাগে শাহানা হুদা রঞ্জনার ২১ জুলাই ২০২১-এর প্রবন্ধ, ‘কল্পনা রাণীর জীবন ও সম্পদে হিন্দু নারীর সমানাধিকারের প্রশ্ন’ শীর্ষক প্রবন্ধটিই প্রকৃতপক্ষে বর্ণনা করেছে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সম্প্রদায়ের সমাজ এবং নারীকুলের বাস্তবতার প্রকৃষ্ট রূপ।

লেখক এই প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছেন, “কল্পনা রাণীর মতো দুর্ভাগা অনেকেই আছেন। আমার এই লেখা দেখে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ বলতেই পারেন, কেন একজন মুসলিম নারী হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার নিয়ে কথা বলছেন? নিজেদেরটা নিয়ে বলছেন না কেন? একজন নারী হিসেবে যখন দেখি হিন্দু নারী তাদের অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত, তখন মুখ বন্ধ করে বসে থাকা যায় না। একজন নারীর বঞ্চনা মানে, অন্য নারীরও অধিকারহীনতা।“ আমি তো মনে করি শুধু তাই নয় বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের নারীবৃন্দও কোন না কোন ভাবে পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় সমাজে বঞ্চিত হচ্ছেন নানা ভাবে। বিশ্বের অধিকাংশ আধুনিক সভ্য দেশের মতোই রাষ্ট্রীয় ভাবে একটি একক পারিবারিক আইন অত্যন্ত জরুরি। আজকে সনাতন নারীর যোগ্য অধিকার কাল সমগ্র নারীসমাজকে তার যথার্থ মর্যাদার অধিষ্ঠানে আগ্রহী করবে। জাগরণের পথে প্রজন্মকে এগিয়ে চলার শক্তি যোগাবে। সেইজন্যেই হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীর উত্তরাধিকার আইনের সংশোধনকল্পে আজ যে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে তা যুগপৎভাবে সমগ্র দেশের জন্যেই একটি ইউনিফর্ম সিভিল ল প্রণয়নের আবশ্যিক দিকটিকে প্রতিভাত করে। লেখক নিজেও এই বিষয়ে বাস্তবানুগভাবে দাবি জানিয়েছেন।

অপরাপর ধর্মীয় সহবস্থানের নিরিখে সামাজিক প্রেক্ষাপট
সংখ্যালঘুর অধিকার ও সুরক্ষা এবং তাদের স্বাভাবিক বিকাশের পরম্পরা নির্ভর বৈশ্বিক এবং রাষ্ট্রিক কর্মকাণ্ড ও নীতি প্রণয়ন বহুদিন থেকেই মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্যোগের মুল বিষয়। কোন দেশের বা স্থানের কোন একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা আধুনিক মননে নিতান্তই অশোভন একটি ভাবনা। আন্তর্জাতিকভাবে এর কোন স্বীকৃত সংজ্ঞাও নেই। তথাপি আমারা প্রায়শই দেখে থাকি, আমাদের আশেপাশেই বহু যুগ ধরে পুরুষানুক্রমে বসবাস করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাস, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, জাতিগত ভিন্নতা কিংবা ভাষাগত পরিচয়ের কারণে কোন কোনও জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে সামগ্রিক জাতীয়তাবোধ এবং রাষ্ট্র ভাবনায় ছেদ পড়ে। ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা এমনকি ধর্মহীনতার স্বাধীনতা সমানভাবে আধুনিক বিশ্বে চর্চিত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হওয়া কিংবা বৈষম্য-অন্যায্যতার প্রতিকারের বিধান দাবি করার মতোই ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রকাশের অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কোন আধুনিক রাষ্ট্র মানুষের এইসব মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী নীতি যেমন গ্রহণ করতে পারে না ঠিক তেমনি জনপুঞ্জে এই অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কিংবা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তার প্রতিকার এবং সংরক্ষণের বিধানাবলী রচনাতেও উদ্যোগী ভূমিকা পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী সমেত কিছু নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব আছে। এদের মধ্যে আবার নারী ও অন্যান্য লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুরা আরও অধিক মাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। এদের উপর যেমন আছে প্রথমত: পুরুষতান্ত্রিকতার প্রবলচাপ ঠিক তেমনি পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতাপ সম্বলিত ধর্মীয় বিধি-বিধানের অন্তঃসম্প্রদায়ের অশিষ্টতা। তার সাথে যুক্ত থাকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নানামুখী অশুভ তৎপরতা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পেয়ে থাকেন স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকর্তৃক অসহযোগিতা। যেমন, বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভারতের প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে বলে ধরে নিয়ে তাদেরকে অযাচিত অপমান, আক্রমণ, বুলিং এমনকি উচ্ছেদের লক্ষ্যবস্তুও করা হয়, এর সহজ শিকার অনেকাংশে নারীরা। এইসব ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা স্ব-স্ব পরিবারের নারীদের নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্কিত বোধ করেন।

পুরুষতান্ত্রিকতার দৃষ্টিতে নারী স্ব-স্ব সমাজে চিরকালই একটা পণ্য হিসেবে গণ্য হয়ে আসছেন। যেখানে যথাযথ শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে নাগরিকের ভেতর থেকে এধরনের মানসিকতার মূলোৎপাটন করা সম্ভব ছিলো, কিন্তু অদূরদর্শী রাজনৈতিক পটভূমি এবং ধর্মীয় উগ্রতার প্রসারে-প্রশ্রয়ে বস্তুত তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে নারীর নিঃস্বতা! অর্থাৎ সম্পদে নারীর আংশিক অধিকার অথবা অধিকারহীনতা।

উপমহাদেশ জুড়ে যে মৌলবাদের উত্থান ইরাক, ইরান, আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক প্রভাবকে হয়তো অগ্রাহ্য করা অসম্ভব ছিলো না এদেশে। ২০১৩ সালে এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সামনে রেখে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিলো সেটি নস্যাৎ হয়েছিলো আমাদের অদূরদর্শী রাজনীতিক, নতজানু সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অপশক্তি যারা নানা কৌশলে সরকারের ভেতরে কিংবা নিকটে অবস্থান করছিলো তাদেরই অপকৌশল প্রয়োগে এবং প্রভাবে। সেই পরিস্থিতি এখনও বর্তমান। সেই সুযোগে এদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্যে ইসলামিক ওয়াজের নামে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিষোদগার এবং হিংসা বিস্তার করা হয়েছে সমগ্র সমাজজুড়ে। সরকারি তরফে এর কোন প্রতিবিধান মেলেনি। চিহ্নিত অপশক্তি সেই সুযোগে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ঠিক এইরকম একটি প্রেক্ষাপটে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ এবং অঞ্চলগুলোতে। পরস্পরবিরোধী এই মৌলবাদী উত্থানকে কাজে লাগিয়েছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। সুযোগসন্ধানীরা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে আর এর দাবানলে পুড়েছে উপমহাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী।

সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কেবল মাত্র হিন্দু সমাজ বা বৌদ্ধ, খৃষ্টান আদিবাসী, নৃগোষ্ঠীই নয় বরং এই জনগোষ্ঠী সমেত সংখ্যাগুরুর নারী সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত। এইসব নারীদের বস্ত্র পরিধানে নিজেদের স্বাধীনতা নেই, পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়েই নারীকে তা নির্বাচন করতে হয়। নাই কাজের স্বাধীনতা, চলায় স্বাধীনতা, সঙ্কুচিত শিক্ষা অবকাঠামোয় নেই শিক্ষায় স্বাধীনতা। প্রান্তিক জনগণের সাথে সাথে প্রান্তিক নারীরাই এর সবচেয়ে বড় শিকার। তাই বাংলাদেশে আজ হিন্দু সমাজের নারীর উত্তরাধিকারসহ হিন্দু আইনের যে সংশোধনের উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে, সেটি আপাত অর্থে সামান্য মনে হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনেক ব্যাপক। এই উদ্যোগের প্রভাবও হবে সুদূরপ্রসারী। কিন্তু এই সংশোধন অনিবার্যভাবে কাম্য এবং আশু নিষ্পত্তি যোগ্য।

আইন পরিবর্তনের খাতসমূহ
আইন কমিশনের প্রকাশিত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বিবেচনাযোগ্য যে খাতগুলো উঠে এসেছে, এক কথায় তা সত্যিকার অর্থেই গুরুত্ববহ এবং প্রণিধানযোগ্য। এই প্রতিবেদনটি ইউএনডিপি-র অর্থায়নে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত ‘Promoting Access to Justice and Human Rights in Bangladesh’ প্রজেক্টের অধীনে পরিচালিত একটি জরিপের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় তার প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলেছে, ‘পরিবর্তনশীল সমাজের প্রয়োজনে এবং বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের সার্বজনীন ধারনাকে সামনে রেখে অন্যান্য আইনের মতো পারিবারিক আইনেরও সংস্কার করা প্রয়োজন।‘ এই যথার্থ উক্তির সাপেক্ষে ২০১০–২০১১ সালের দ্বি-বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত পারিবারিক আইনের পর্যালোচনায় হিন্দু পারিবারিক আইনের বিষয়ে যে করণীয় বেরিয়ে আসে তার উপসংহারে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে অধিকতর গুরুত্ব বিবেচনার জন্যে নির্বাচিত করা হয়। মন্ত্রণালয় যথার্থভাবে মনে করে যে এই নিম্নলিখিত বিষয়ে হিন্দু পারিবারিক আইনসমূহ সংশোধনকল্পে আশু পদক্ষেপ প্রয়োজন।

১. হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন
২. বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ আইন
৩. যথোপযুক্ত কারণ বহির্ভূত বহুবিবাহ নিরোধ আইন
৪. অসবর্ণ বিবাহ আইন
৫. দত্তক গ্রহণ আইন
৬. সম্পত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রোধক আইন
৭. সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর উত্তরাধিকার আইন।

এসব আবশ্যকীয় এবং সময়োপযোগী বিষয় ছাড়াও দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্যে আরও কিছু আইনগত বিষয় আছে যা সংশোধন, পরিমার্জন এবং বিকশিত করা প্রয়োজন। এসব দাবি বহু পুরানো এবং যত দ্রুত সম্ভব সম্প্রদায়-গোষ্ঠীর সার্বিক বিকাশে বাস্তবায়নের প্রয়োজন। বিশেষ করে আইন মন্ত্রণালয় যখন বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করার বিষয়ে বলেছেন এবং উপলব্ধিতে আপাতত যত্নশীল। এছাড়াও প্রকাশিত প্রতিবেদনের ‘আইন সংস্কারের প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে অর্পিত সম্পত্তি আইনের বিষয়ে বলা হয়েছে। যা এদেশের ধর্ম-জাতি-নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে একটি আতঙ্কের নাম। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার একটি বড় কারণ হলো তাদের সম্পত্তি রক্ষার অধিকারকে খর্ব করা। সংখ্যালঘুদের জমি কেড়ে নেয়া বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিলো বিশেষ করে ১৯৭৫ পরবর্তীকালে, যা এখনও বিদ্যমান। এই অর্পিত সম্পত্তি আইনটি এমন একটি আইন যার দ্বারা এদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে সবসময়ই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যহীন হিসেবে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে উৎসাহিত করে।[১]

সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান বলছে এই অর্পিত সম্পত্তি আইনের দ্বারা প্রায় তিন মিলিয়ন একর জমি হারিয়েছে বাংলাদেশের ১.৫ মিলিয়ন পরিবার। এই সমস্ত জমির ৮৭ শতাংশই হিন্দু ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি বা সম্পত্তির অংশ অথবা মন্দিরের জায়গা।[২] যদিও এ আইনের সংশোধনী-২০১১’র মাধ্যমে ইতোপূর্বে কেড়ে নেয়া সম্পত্তি প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, তবুও এই প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত শ্লথ এবং অসাধুতায় পুষ্ট।

পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায় এদেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর একটি অংশের হাতে নিয়মিতভাবে প্রায়ই সংখ্যালঘুর বসত-বাড়ি, মন্দির, পারিবারিক মন্দির এবং সম্পত্তির ক্ষতি সাধিত হয়। বাংলাদেশের আইন এবং প্রশাসন অত্যন্ত সীমিত আকারে এসবের প্রতিবিধান করে বা সুরক্ষা দেয়, কিংবা দেয় না। ২০১৮ সালে প্রণীত দ্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে যদিও যেকোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে, ওয়েবসাইটে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কারোও সম্মানহানি বা ধর্মানুভূতিতে আঘাতের প্রেক্ষিতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা দেবার কথা থাকলেও আইনটি প্রায় নির্দিষ্টভাবে এদেশের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় এবং সম্প্রতি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে।[৩]

সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় মৌলবাদের অসহিষ্ণুতার ক্রমোন্নয়নে সম্প্রতি ধর্মনিরপেক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ক্রমশ কোণঠাসা করা হয়েছে এদেশে। আবহমান সংস্কৃতির বাহ্যিক প্রকাশ গুলোতে কিছু জাতীয় অনুষ্ঠানে ঘোষিত-অঘোষিত ভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে দেশের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক আবহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিকতার মুক্ত প্রকাশে সে প্রয়াস এখন নিদারুণ ভাবে হুমকির মুখে।[৪]

এই রকম একটি পরিস্থিতি স্বভাবতই দেশের সংখ্যালঘু সমাজ ব্যাপক বৈষম্যের শিকার এবং এর ব্যাপ্তি এবং বিস্তৃতি প্রকাশিত সংবাদ বা দৃশ্যমান অবস্থার চাইতে অনেক নৃশংস এবং ব্যাপক। সংখ্যালঘু নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রায় নেই তার উপর আছে বৈষম্যমূলক ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক আইন। এই উভয়বিধ টানাপড়েনে এদেশের সংখ্যালঘু নারী সমাজ নানাভাবে প্রায়ই যৌন নিগ্রহের সহজ শিকারে পরিণত হন, অথবা জীবনের তাগিদে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হন, অথবা ঠিকানাবিহীন ভবঘুরেতে রূপান্তরিত হন।[৫]

কোভিড’১৯ এর বিশ্বব্যাপী গ্রাসের মধ্যেও সংখ্যালঘু অবদমন স্তিমিত হয়নি বিন্দুমাত্র। ‘বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ’ ২০২০-এর মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিশ্চিত সতেরটি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু হত্যাকাণ্ডের কথা জানিয়েছে।[৬]

এই সব প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক হিন্দু সমাজের উন্নয়নে হিন্দু নারী সমাজের আস্থা এবং আত্মবিশ্বাসের জায়গাটির বিনির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। সাথে সাথে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর আশু সমাধানও জরুরি। কিন্তু সবার আগে দরকার নিজ সম্প্রদায়ের আভ্যন্তরীণ উন্নয়নের স্বপ্রণোদিত প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টার পালে বাংলাদেশ সরকারের তরফে যে উদ্যোগ, তাতে ইতিবাচক অংশগ্রহণই হতে পারে ভবিষ্যতের সংকট মোকাবেলায় কার্যকর প্রভাব বিস্তারি হাওয়া। এই মুহূর্তে আমরা অবগত যে, কোন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের তাগিদে এবং ভবিষ্যতের জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে অন্তঃসম্প্রদায়ের বৈষম্য নিরসনের বিকল্প নেই। সেই সাথে দরকার হবে সমগ্র দেশে একটি সমন্বিত পারিবারিক আইন প্রণয়নের সূচনাধারা। এর সাথে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কর্মোদ্দীপনা, পরিবেশ ও সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অংশগ্রহণ এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা এতটাই জরুরি যে তা শুধু মাত্র বৈবাহিক অবস্থা সুরক্ষা নয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও ততধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহ বিচ্ছেদ এবং পুনর্বিবাহ সংক্রান্ত আইনটিরও সংশোধনী প্রয়োজন। হিন্দু সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ নেই। অথচ এই অসম্পূর্ণ আইনি বলয়ে এদেশের হিন্দু সমাজে রয়েছে এক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা। এর প্রধান শিকার এ সমাজের নারী সদস্যবৃন্দ। নানান অজুহাতে পুরুষের পক্ষে পুনর্বিবাহ সম্ভব হলেও নারীর ক্ষেত্রে সে পথ রুদ্ধ। সুতরাং এ শৃঙ্খল ভাঙা দরকার। আধুনিক যুগে নারী কোনভাবেই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে পারে না। পুরুষের পাশাপাশি নারীরও একই স্বাধীনতা থাকতে হবে। পুরুষের বহুবিবাহ রোধ কল্পে যথোপযুক্ত আইনি বলয়ে সীমা থাকাটা জরুরি। বিশেষ করে পুরুষের বহুবিবাহ সংশ্লিষ্ট পরিবারে নারীকে দুর্বল করে এমনকি পরিবারের শিশু সন্তানের উপরেও সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় সন্তানের ভবিষ্যৎ। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব শেষ পর্যন্ত সম্প্রদায় হয়ে রাষ্ট্রের উপরেই বর্তায়।

অসবর্ণ বিবাহ সম্প্রতি অনেকটাই সহনীয় এবং গ্রহণীয়। তবুও প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক পর্যায়ে এর অশুভ প্রভাব এখনো বিদ্যমান। বিশেষ করে সমাজ কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধের জালে আটকে পড়ে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা। সুতরাং এর সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন এখন প্রয়োজন। প্রচলিত হিন্দু সমাজে নারীর দত্তক গ্রহণের সুযোগ নেই। আবার গোটা সমাজে কারোই নারী-শিশু দত্তক হিসেবে গ্রহণেরও সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় ভাগ্যচক্রে অসহায় নারী শিশুদের ভাগ্য বিড়ম্বনা অনুমানযোগ্য। সুতরাং এক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ উভয়েরই ছেলে অথবা মেয়েকে দত্তক হিসেবে গ্রহণের বিধান জরুরি। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের শারীরিক কিংবা মানসিক ত্রুটি একটি বড় প্রতিবন্ধক। এর সুযোগ গ্রহণ করে একই পরিবার কিংবা সমাজের সুবিধা ভোগী শ্রেণি। তার সাথে অসুস্থ সমাজে একজন প্রতিবন্ধীকে যেকোনো পর্যায় থেকে বঞ্চিত করার প্রয়াস সতত বিরাজমান। ফলে প্রতিবন্ধী যে প্রাকৃতিকভাবেই সীমাবদ্ধ এবং বঞ্চিত তাকে এই সমাজ আরও প্রকটভাবে বঞ্চিত করার প্রয়াস পায়। অথচ বিষয়টি হওয়া উচিত ছিলো ঠিক এর উল্টো। পরিবারের প্রতিবন্ধী শিশুটিই বরং অধিকতর যত্ন এবং মনোযোগের অধিকারী হওয়া উচিৎ অথচ সে হয় স্থায়ী এবং নিশ্চিত ভাবে বঞ্চনার শিকার। সুতরাং এখানেও এই প্রতিবন্ধীর একটা শক্ত আইনি সুরক্ষা প্রয়োজন। মানবাধিকার সমুন্নত রাখার স্বার্থে এর সুস্পষ্টতা দরকার, দরকার তার উত্তরাধিকারের সুরক্ষা কল্পে শক্ত আইনি বলয়। সমাজে নারীর উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা একই ভাবে জরুরি।

প্রচলিত হিন্দু আইনে স্ত্রী-ধন হিসেবে বিয়ের সময় প্রাপ্ত অস্থাবর গহনা বা টাকা গৃহ-তৈজষই কেবল পায়। পৈত্রিক সম্পদে কিংবা স্বামীর সম্পদে তার কোন নিরঙ্কুশ মালিকানা নেই। বাড়তি যা আছে সেটি হলো স্বামীর সম্পদে তার জীবনতত্ত্ব মালিকানা। অর্থাৎ জীবদ্দশায় সে কেবল তা ব্যবহার করতে পারবে। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, পিতার মৃত্যুর পরে সাধারণত পুত্রেরা সম্পদ বণ্টনে আগ্রহী হয়ে উঠে। এসব ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যানবৃন্দের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। ফলে প্রথাগত সামাজিক চাপে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর ভোগ সত্ত্বে প্রাপ্ত সম্পদের ভোগ থেকেও বঞ্চিত হন, হয়ে পড়েন পুত্রের আশ্রিত! যা নিতান্তই দুঃখজনক। এমনকি ভাগ্য বিড়ম্বিত হলে পথে নামতেও বাধ্য হন। সেই কারণেই মানবাধিকারের দৃষ্টি থেকে হলেও এই উত্তরাধিকারের আইনটি যুগোপযোগী হওয়া এখন অত্যন্ত প্রয়োজন।

সংশোধিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সম্ভাব্য প্রভাব
বিগত কিছুদিন যাবত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার প্রশ্নে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর আলোচনা, তর্ক এবং যুক্তি-পাল্টা-যুক্তির ঢেউ বয়ে চলেছে। অনেকেই বেদ-বেদান্ত শাস্ত্র-নিরুক্তের অজস্র বাণী, অলঙ্কার, কথোপকথন, উদ্ধৃতি সমেত নিজ নিজ বক্তব্যের সারবত্তা তুলে ধরার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। এসবের কোনটিই অযথা নয় অথবা হয়তো মূল্যহীনও নয়। তবুও এ আলেখ্যের পরম্পরা শেষে সব কিছুর ঊর্ধ্বে কয়েকটি বিষয়কে তুলে ধরতেই হবে।

প্রথমত: আমাদের বাংলাদেশে এবং সমগ্র উপমহাদেশের নানা ধর্ম, জাতি, আদিবাসী, নৃগোষ্ঠী সমেত সবাই আসলে একই খুব কাছাকাছি গোত্র কিংবা গোষ্ঠীর উত্তর প্রজন্ম। সেই হিসেবে আজকের বিভাজন রীতির যেমন কোন অর্থ নেই তেমনি হিংসা, বিদ্বেষ এবং অবিশ্বাসেরও তেমন কোন গূঢ় অর্থ থাকারও কারণ নেই। কিন্তু বাস্তবতা এর বিপরীত। ক্রমশ সভ্যতার অগ্রযাত্রার সোপানে আমাদের এগিয়ে চলতে হচ্ছে। পুরনো ধ্যান-ধারনা অনেকেই তাদের ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এর হয়তো সাংস্কৃতিক মূল্য আছে, তবুও অযথা রক্ষণশীলতার দুর্লঙ্ঘ্য প্রকার তুলে দিয়ে সংস্কৃতিকে ধরে রাখা যায় না। কেননা সংস্কৃতি একটি পরিবর্তনশীল শিল্পচর্চা বৈ তো নয়। আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে এর রূপ এবং রস আস্বাদনের ধরন এবং পদ্ধতির পরিবর্তন নিরন্তর ঘটে চলেছে। সেজন্যেই আমাদের প্রতিনিয়তই আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে সমাজ এবং পরিবার এমনকি দেশজ ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করে তুলতে হয়। সম্পদে, ঐশ্বর্যে বেশভূষায় সেটিকে রপ্ত করতে আমরা পারঙ্গম। কিন্তু অন্তরে ধারণের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই ব্যর্থ। এ আমাদের হীনতা, কূপমুণ্ডকতা।

আজকে যখন রাষ্ট্র নেতৃত্বের দপ্তর থেকে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তখন প্রথমত: উচিত একে সাধুবাদ জানানো। অচলকে আঁকড়ে ধরে ঐতিহ্য রক্ষায় কোন গৌরব নেই। দ্বিতীয়ত: বিরোধ নয় বরং প্রস্তাবিত আইনটিকে সুগঠিত এবং কল্যাণকর করার স্বার্থে সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। দরকার এর সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ের আধুনিকায়ন এবং যুগোপযোগীকরণ।

এতক্ষণের আলোচনায় একথা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, ঐতিহ্যিক রীতিতে শাস্ত্রোক্তও মতের ভিত্তিতে প্রচলিত আইনে বাংলাদেশের হিন্দু নারীর পায়ের তলায় শক্ত মাটি নেই। আর যেহেতু ঐসব রীতি এবং শাস্ত্রোক্ত মতবিন্যাস অপরিবর্তনীয়ও নয়, তাই বিশ্বায়নের এই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে যেকোনো সমাজকে উঠে দাঁড়াতে হলে তার নারী সদস্যকে হতে হবে সব দিক দিয়েই মর্যাদাশীল এবং সক্ষম। নারীর বিচক্ষণতা পরিবারকে সুগঠিত করে। নারীকে আবর্তিত করেই পরিবার সংগঠনটি সুসংহত হয়। সনাতন শাস্ত্রে তাই নারীকে দশভুজা হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই দশভুজার বাহন হলো সিংহ। আজকের সনাতন নারীরা সিংহপৃষ্ঠ হতে অথৈ জলে নিমজ্জিত। তাকে শক্তভাবে দাঁড়াবার জায়গা দিতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে একটি শক্তিশালী পরিবার কাঠামো। সমাজের সব থেকে ক্ষুদ্র সংগঠন হলো পরিবার। তাই এই পরিবারের গুরুত্ব এতোটাই বেশি যে, এই বন্ধন ভেঙে পড়লে তার অবশ্যম্ভাবী নেতিবাচক প্রভাব এসে সমাজের স্রোতে মেশে। সমাজ কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভেঙে পড়ে। তার বিস্তর নমুনা অধুনা বাংলাদেশে বিদ্যমান। যুগের পরিপন্থী আইনের সংস্কার তাই জরুরি হয়ে পড়ে সময়ের বিবর্তনে। সনাতন সংস্কৃতিতে হেঁসেলে হাঁড়ি-ঠেলা নারীর অবয়বে যাতে আত্মবিশ্বাসের স্ফুরণ ঘটে তার জন্যই আজকের আয়োজন সম্পন্ন করতে হবে। কেননা তা আমাদের সামগ্রিকতায় যে প্রভাব বিস্তার করবে তা সুদূরপ্রসারী।

নারীর আত্মবিশ্বাস তার আত্মমর্যাদাকে জাগিয়ে তুলবে। সেটা তার সন্তানের হাত ধরে প্রজন্মান্তরে ধাবিত হবে। সহাবস্থানে থাকা অপরাপর সম্প্রদায়, জাতি এবং নৃগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করবে। আত্মমর্যাদাবোধের নিরিখে সমাজ জীবনে স্বাভাবিক যাপিত জীবনের জলতরঙ্গ অনুরণিত হবে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক ভীতিগুলো হবে অমূলক। কেননা নারী যখন তার নিজস্ব ঠিকানার খোঁজ পাবে, তখন স্বভাবতই শৃঙ্খলিত হবার বাসনা তিরোহিত হবে। কেননা বিপদগ্রস্ত নারীর প্রথম প্রয়োজন সামাজিক মর্যাদা, খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা। নিজ সম্প্রদায়ে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে চাইলে বিপন্ন মানুষ মাত্রই প্রয়োজনে আন্তঃসম্প্রদায়ে আশ্রয় খুঁজবে জীবনের প্রয়োজনে। সম্পদে উত্তরাধিকার নারীকে সেই বিপন্নতা থেকে মুক্ত করবে।

আজকের অসমতা নারীকে বোধ সৃষ্টির কাল থেকেই নিজের কাছে হীন করে তুলে। সম্প্রদায়ের সমাজে হীনম্মন্যতা তাকে গ্রাস করে, বাস্তবিকই সে যেকোনো সম্প্রদায়েই আস্থার জায়গাটি নিশ্চিত করতে পারে না। নিজের ঠিকানাবিহীন, অস্তিত্বহীন জীবনে সম্প্রদায়ের শাস্ত্রীয় রীতিনীতি এবং আপ্তবাক্যের কোন মূল্যই তখন তার কাছে থাকে না। সুতরাং ধর্মান্তরে, গোত্রান্তরে নারীর নিজস্ব বোধের জায়গায় সৃষ্টি হয় বিশাল শূন্যতা, ফলে ধর্মান্তর সহজতর হয়। নারী কিংবা পুরুষ তার বোধের জায়গা থেকে গৃহীত ধর্মান্তরে সমাজে কারোই কিছু বলার নেই। কেননা ধর্ম এবং সংস্কৃতিবোধ একটি মানুষের সম্পূর্ণ নিজস্ব স্বাধীনতা এবং উপলব্ধি। আজও সনাতন সম্প্রদায়ে এত এত শৃঙ্খল সত্ত্বেও নারীকুলের নির্বিকার চিত্তের পেছনে রয়েছে সমাজের, শাস্ত্রের চোখরাঙানি। আজ তা উপেক্ষার সময় এসেছে। সুতরাং নারীকে তার ন্যায্য অধিকার দিতে হবেই।

তথ্যসূত্র:
১. Shelley Feldman “The Hindu as Other: State, Law, and Land Relations in Contemporary Bangladesh” South Asia Multidisiplinary Academic Journal, 13, (April 22, 2016).
২. Taslima Yasmin “The Enemy Property Laws in Bangladesh: Grabbing Lands Under the Guise of Legislation; Oxford University Commonwealth Law Journal, 15 (1), 2015, 121-147.
৩. Digital security Act: Arrest warrant Issued Against Baul Rita Dewan, The Daily Star, August1, 2021. Digital Security Act: Arrest warrant issued against Baul Rita Dewan | The Daily Star
৪. দ্য ডেইলি অবজারভার, 15 named for fanning communal tension, militancy thru Waz; Sunday, 7 April, 2019, 15 named for fanning communal tension, militancy thru Waz - Front Page - observerbd.com
৫. মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল, আন্ডার থ্রেট: দ্য চ্যালেঞ্জেস ফেইসিং রিলিজিয়াস মাইনোরিটিজ ইন বাংলাদেশ। রিপোর্টস / মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল, ২০১৬।
৬. USA Department of State; Bangladesh, May 12, 2021.

কেশব কুমার অধিকারী, শিক্ষক, গবেষক, ঘেন্ট ইউনিভার্সিটি গ্লোবাল ক্যাম্পাস, ইনসন, দক্ষিণ কোরিয়া। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ