টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ব্যারিস্টার জাকির হোসেন | ১৫ অক্টোবর, ২০২৪
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে বলা আছে।
“জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা-এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি”। অনুচ্ছেদ ২৫(১), বাংলাদেশ সংবিধান।
পররাষ্ট্রনীতির অভিধানে স্থায়ী বন্ধু কিংবা স্থায়ী শত্রু বলে কিছুই নাই, এটি যেমন সত্য তেমনি এখানে কালেক্টিভ ম্যাডনেস কিংবা আবেগেরও কোনোও স্থান নেই! এখানে পারস্পারিক বাণিজ্য/স্বার্থ/interest ই হলো পররাষ্ট্রনীতির চিরস্থায়ী বিষয়বস্তু। কূটনীতিই শেষ কথা।
বঙ্গবন্ধু যতদিন ছিলেন ততদিন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের অনুকূলেই ছিল। সদ্য স্বাধীন দেশ থেকে মাত্র ৩ মাসের মধ্যে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া একটি ফুল ফ্লেজড মিলিটারি ফোর্সকে (ভারতের সেনা) ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনা বিশ্বের বিরল, এমন ঘটনা কোথাও ঘটেনি, আর ঘটবেও না। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিকে বাংলাদেশের কেউই অতিক্রম করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু ভারতের সাথে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে, পানি সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট ছিলেন, ২৫ বছরের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অন্যতম, বাংলাদেশের একটি গ্রুপ ঐ চুক্তির বিরোধিতা করলেও জিয়া/এরশাদ/খালেদা জিয়া সরকারের কেউই ঐ চুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেনি, সুতরাং ঐ চুক্তি যথাযথ ছিল বলেই প্রতীয়মান! ভারত, রাশিয়ার বাইরে যেয়ে একাধারে মুসলিম বিশ্ব, বিশ্বব্যাংক, ফিলিস্তিন, পশ্চিমা বিশ্ব, ন্যাম (NAM-The Non-Aligned Movement)-সহ সকল পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধু নিজস্বনীতি অনুসরণ করে গেছেন, তখন সংবিধানের নীতিই ছিল কার্যকর পররাষ্ট্রনীতি।
বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে আমেরিকান/সিআইএ (CIA-Central Intelligence Agency) প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পররাষ্ট্রনীতি থেকে বিপরীত দিকে যেতে থাকে, বিশেষ করে ভারতের বিষয়ে! ফলত, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তান/চীনের পররাষ্ট্রনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়! পাকিস্তান/চীনকে সহায়তা করতে যেয়ে বাংলাদেশ কার্যত ভারতের সেভেন সিস্টার ভাঙ্গার কাজে জড়িয়ে যায়! অন্যদিকে, ভারতও পার্বত্য চট্টগ্রামে ইন্ধন দিতে থাকে! বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত হয়ে উঠে, শান্তি বাহিনী ভারতের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে! ভারত সীমান্তে মরণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করে, সীমান্ত হত্যা এখান থেকেই শুরু। বাংলাদেশ সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করে যুদ্ধ খরচের ভার বহন করতে থাকে! এভাবে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চলেছিল!
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক দুই দেশের পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য হওয়া বাঞ্ছনীয়, এখানে পাকিস্তান/চীন/আমেরিকার স্বার্থ সুরক্ষার সুযোগের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ব্যবহৃত হতে পারে না।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সংবিধান মোতাবেক চলতে থাকে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার উলফাকে সহায়তা বন্ধ করে, অনুপ চেটিয়াকে ঢাকার সেইফ হোম থেকে গ্রেফতার করে, যেখানে উলফার প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম চলত! বাংলাদেশের আইন মোতাবেক অনুপ চেটিয়াকে সাজা দেওয়া হয়, সাজা শেষে কূটনৈতিক চ্যানেলে তাকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয় নতুন করে বিচার না করার শর্তে। বিনিময়ে ভারতও পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে সহায়তা করে, শান্তি বাহিনী ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে! এবং অনুপ চেটিয়া ঢাকায় গ্রেফতার হয় ২১শে ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে! এর পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের সামরিক খরচ কমতে থাকে, অর্থনীতি, পর্যটন, বাণিজ্যে পার্বত্য অঞ্চলে নতুন যুগের সূচনা হয়।
২০০১ সালের পর বিএনপি-জামাত আমলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আবারো চীন/পাকিস্তানের নীতি অনুসরণ করে, ভারতের সেভেন সিস্টারস অশান্ত করার নীতি সামনে চলে আসে! পাকিস্তান/চীন থেকে আগত ১০ ট্রাক অস্ত্র ঘটনাক্রমে আটকে যায়, যেটি উলফাদের জন্য নেওয়া হচ্ছিল। যেখানে রকেট লাঞ্চার, মর্টার শেল, মেশিনগান, গ্রেনেড, মাইনের মত যুদ্ধ পরিচালনার সকল সরঞ্জাম ছিল! এটি ভারতকে বিচলিত করে তোলে, ভারতের সামরিক বাজেট বহুগুণে বেড়ে যায়!
২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবারো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসে, ভারতের সেভেন সিস্টার অঞ্চলে সামরিক বাজেটের বাৎসরিক প্রায় ৩০ হাজার কোটি কমে যায়!
ভারতের সেভেন সিস্টার অশান্ত করার চিন্তা অতিমাত্রায় স্থূল মগজের কুচিন্তা! কেউ যদি মনে করে প্রতিবেশীর ঘরে আগুন দিয়ে নিজে আরামে বসবাস করবে সে মূলত অন্ধের হস্তি দর্শন করছে! বাস্তবে এটির প্রভাবে বাংলাদেশের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে, লাভ হলে হবে চীন এবং পাকিস্তানের।
বর্তমানে আবার বাংলাদেশ ভারতের সেভেন সিস্টার অপকর্মে জড়াচ্ছ চাচ্ছে, এখানে জনগণ যেমন আছে, তেমনি সরকারের উঁচু মহলের লোক আছে, সামরিক বাহিনীর লোকও আছে! এটি হলে ভারতও স্বভাবতই রিটালিয়েশন করবে, পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত করবে। দু দেশেরই সামরিক বাজেট বাড়বে, স্বাভাবিক অর্থনীতি, পর্যটন বিপর্যস্ত হবে।
পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ করে ভারত বিষয়ে এখানেই মৌলিক ব্যবধান। বাংলাদেশের অনেক জংলী মানুষ সেভেন সিস্টার ভাঙ্গার কথা বলে, এই মূর্খরা জানে না এর পরিণতিতে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে কি হবে!
বাংলাদেশ -ভারত সম্পর্কটা রাজনৈতিক না হয়ে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক হওয়া উচিত। এটি উভয় দেশের জন্যই, জনগণের জন্যই লাভজনক হবে। এখানে বাংলাদেশের সমস্যা এবং দুর্বলতা হলো বার্গেইন ক্যাপাসিটি, কূটনৈতিক দক্ষতা প্রায় শূন্য, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদক্ষতা/দুর্বলতার সুযোগ ভারত নিচ্ছে। ফলে, প্রতিটি চুক্তিতে ভারত বেশি সুবিধা নিচ্ছে। বাংলাদেশ যতদিন নিজেদের বার্গেইন ক্যাপাসিটি বাড়াতে পারবে না, যতদিন নিজেদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারবে না ততদিন চলমান অবস্থা চলতে থাকবে।
আমেরিকা বাংলাদেশের জন্মশত্রু এদের বিশ্বাস করার কারণ/সুযোগ কোনটাই নেই! বাংলাদেশের ভিয়েতনামের জন্মশত্রুও আমেরিকা, জো বাইডেন গত বছর ভিয়েতনাম সফর করেছেন, প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি করেছে, যার মধ্যে আছে ৫০টি বোয়িং বিমান, এ রকম আরও বাণিজ্যিক ইস্যু বিদ্যমান! ভিয়েতনাম বাংলাদেশের পরে স্বাধীনতা পেলেও ভিয়েতনামের অর্থনীতি বাংলাদেশের থেকেও ভালো করছে, যেটি শুরু হয়েছিল ভিয়েতনামের স্বাধীনতার পরপরই! বাংলাদেশের জন্ম ৭০ বছর হলেও এই দেশের প্রায় ২৫ বছর চলে গেছে জন্মশত্রুদের আদর্শের ভিতরে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাণিজ্য/স্বার্থ/interest বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর ন্যায় শেখ হাসিনার দর্শনও দেশীয় স্বার্থই মুখ্য ছিল! উল্লেখ থাকে যে, ৭৫ এর পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মূলত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, যেখানে চীন/পাকিস্তানের অর্থে ভারতের ক্ষতি করা একটি মৌল লক্ষ্য ছিল, এর সাথে যোগ হয়েছিল আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির পলিটিক্যাল ইসলামের বিস্তার, যেখানে সৌদি অর্থে দেশে ওহাবি মতবাদের বিস্তার, ফলত জঙ্গি, জিহাদি, আফগানিস্তানে মুজাহিদ রপ্তানি ছিল অন্যতম অপকর্ম!
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় সকলেই অতীতে তীব্র ভারত বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করে আসছিল! যদিও দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই কৃত্রিম বিরোধিতা আর দেখা যাচ্ছে না! অর্থাৎ, দেশে চলমান ভারত বিরোধিতা অনেকাংশেই ভিত্তিহীন, অবাস্তব, অতিরঞ্জিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!
বৈদেশিক শক্তিগুলো চলমান বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে ততদিন নিরাপদ মনে করবে যতদিন অর্থনৈতিক উন্নয়ন চলমান থাকবে। কারণ, এর মধ্য থেকে তাদের বাণিজ্য চলমান থাকবে। এটিই তাদের স্বার্থ। বাংলাদেশের স্বার্থ হলো, চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে জনগণের জীবন মানের উন্নয়ন। তবে, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার বাইরের পররাষ্ট্রনীতি চীন/পাকিস্তান/আমেরিকাকে উপকার করলেও বাংলাদেশের জন্য বিষাক্ত/ক্ষতিকর!
সকল দেশের সাথেই সুসম্পর্ক জরুরি, অর্থনৈতিক উন্নয়নই শেষ কথা, দেশের পলিটিক্যাল ইকোনমিই শেষ ভরসা। এর পরের ধাপে স্বাভাবিক গতিতেই সামাজিক মুক্তির ধাপ ত্বরান্বিত হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের স্বার্থেই পরিচালিত হউক, এটিই কাম্য!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য