টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এনামুল হক এনাম | ১৮ মে, ২০২৫
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সাথে পুরোপুরি যোগাযোগহীন থাকা দেশের স্বার্থে সম্ভব নয়। এই বক্তব্য বাংলাদেশের প্রচলিত পররাষ্ট্রনীতিতে একটি নতুন মোড় হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সবসময় প্রতিবেশীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার প্রেক্ষাপটে ঢাকা সরকার বাস্তবতার নিরিখে কিছু ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করছে।
এই প্রবন্ধে পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা, প্রতিবেশী দেশের অখণ্ডতা, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, রোহিঙ্গা সংকট এবং সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়েছে—আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কি কূটনৈতিক দ্বিচারিতা, না কি বাস্তববাদী প্রয়োজনে গৃহীত একটি কৌশল?
“সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়”—এ নীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি। ভারত, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক। কিন্তু রাখাইনে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস এবং আরাকান আর্মির উত্থান বাস্তবতায় পরিবর্তন এনেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মতে, বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকাও যাবে না। এ বক্তব্য বাংলাদেশকে আদর্শবাদী পররাষ্ট্রনীতি থেকে বাস্তববাদী কূটনীতির দিকে টেনে এনেছে।
বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের ভৌগোলিক অখণ্ডতা স্বীকার করে। কিন্তু ২০২৪ সাল নাগাদ রাখাইনের অনেক অঞ্চল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় সীমান্ত নিরাপত্তা, চোরাচালান ও অপহরণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ বাধ্য হয়েছে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। সরকারের ভাষ্য মতে, এটি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নয় বরং নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝখানে এক কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। চীন, ভারত ও রাশিয়া মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করলেও, তাদের অনেকেই নিজেদের স্বার্থে আরাকান আর্মির সাথেও সংযোগ স্থাপন করেছে। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা শক্তিও রোহিঙ্গা ও মানবিক ইস্যুতে এএ’র সাথে কথা বলছে। সুতরাং বাংলাদেশের পক্ষেও এই প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা অবাস্তব। তবে ভারসাম্য বজায় রাখা এখানে মুখ্য—যাতে আন্তর্জাতিক মহলে নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ থাকে।
রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, ফলে বাংলাদেশকে বিকল্প কূটনৈতিক পথ ধরতে হয়েছে। যদিও আরাকান আর্মি নিজেরাও রোহিঙ্গাবিরোধী মানসিকতা পোষণ করে, বাংলাদেশ শর্ত জুড়ে বলেছে—রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না হলে সংলাপ এগোবে না। এই অবস্থান কূটনীতির ব্যালান্স রক্ষা করে—সমর্থন নয়, বরং মানবাধিকারের প্রশ্নে চাপ সৃষ্টি।
নাফ নদীতে বাংলাদেশি জেলে অপহরণ ও গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বিজিবি আরাকান আর্মির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তিন জেলেকে উদ্ধারে সক্ষম হয়। এই উদাহরণ দেখায়, এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক সংযোগ কখনো কখনো বাস্তবিক নিরাপত্তার জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। সীমান্ত অঞ্চলে দ্বৈত কর্তৃপক্ষ, চাঁদাবাজি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় এ ধরনের যোগাযোগ কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে।
জাতিসংঘ বাংলাদেশকে রাখাইনে ত্রাণ পৌঁছাতে মানবিক করিডোরের প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও এটি মানবিক উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত, তবে এতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহৃত হবে, যা ভবিষ্যতে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলতে পারে। করিডোর ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক সংস্থার অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ এবং তদারকি যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা তৈরি করতে পারে। অতীতে লিবিয়া বা সিরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোতে এমন করিডোর ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক প্রভাবের টুলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকেও তাই এই প্রসঙ্গে সতর্ক থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কূটনৈতিক দ্বিচারিতা না বাস্তববাদিতা?
সমালোচকরা এই ধরনের কূটনৈতিক আচরণকে দ্বিচারিতা বললেও, সরকারের ভাষ্য—এটি কৌশলগত দ্বৈত নীতি (dual-track diplomacy)। মিয়ানমারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখে, মাঠপর্যায়ে প্রভাবশালী পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ একই কৌশল অনুসরণ করেছে। বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার ধারাবাহিকতায় নিজেদের অবস্থান সাজাচ্ছে।
এই কৌশল যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে তা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সীমান্ত স্থিতিশীলতায় সহায়ক হতে পারে। অন্যদিকে, আরাকান আর্মির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে বা আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক বার্তা গেলে বাংলাদেশ বিপাকে পড়তে পারে। মানবিক করিডোরের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তাই বাংলাদেশকে প্রতিটি সিদ্ধান্ত কৌশলগত বিচক্ষণতায় নিতে হবে।
বাংলাদেশের আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ বর্তমান বাস্তবতায় একটি অবশ্যম্ভাবী কূটনৈতিক কৌশল। এটি পুরনো আদর্শবাদী নীতির ব্যতিক্রম হলেও একে বাস্তববাদী প্রয়োগ হিসেবে দেখা যায়। সময় বলবে, এই পদক্ষেপ সফল হবে কিনা। তবে এটুকু স্পষ্ট—বাংলাদেশ এখন গঠনমূলকভাবে নিজেদের কৌশল পুনর্নির্ধারণ করছে, যেখানে পররাষ্ট্রনীতি আর স্রেফ বিবৃতি নয়, বরং মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বিত একটি প্রক্রিয়া।
তথ্যসূত্র:
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য