টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ০৮ অক্টোবর, ২০২৫
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একজন শিশুকে তাঁর জন্মের সাথে সাথে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের চাহিদা থাকে পুত্র সন্তান। সন্তান যখন পুত্র না হয়ে কন্যা হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে, তখন সন্তুষ্টির জায়গাটা পূর্ণ হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কন্যা শিশু আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য না।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সারা বিশ্বেই নানান কারণে কন্যা-শিশুরা বেশ অবহেলিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মর্যাদা, ভালোবাসা—সব দিক থেকেই বলতে গেলে তারা বঞ্চিত। সারা বিশ্বেই কোনো না কোনো জায়গায় প্রতি মুহূর্তে অবহেলার শিকার হচ্ছে কন্যা-শিশু। পরিবার ছাড়াও সামাজিকভাবেও তারা হচ্ছে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত। বিশ্বজুড়ে নারী ও কন্যা-শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নৃশংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স আঠারো বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কন্যা-শিশু।
মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে অসহায় হচ্ছে শিশুরা। বড় হয়ে ওঠার জন্য বড়দের উপর শিশুদের নির্ভর করতেই হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, দুনিয়ায় যেকোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। সে দুর্যোগ প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম- যে রকমই হোক না কেন। তার ওপর রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের প্রতি বড়দের দায়িত্বশীলতার ঘাটতি, সঠিক মনোযোগ এবং সঠিক পরিচর্যার অভাব। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুদের প্রতি অবহেলাটা একটু বেশিই। আর যুদ্ধবিধ্বস্ত কিংবা যুদ্ধকালে শিশুদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ যে ভুল পথে পরিচালিত হয়, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশুদের প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনেকেই করেছেন। কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য শিশুর প্রয়োজনীয়তার অনুভবটা নগদানগদি হয় না বলে, সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবনা চিন্তাও করা হতো না একসময়। তবে সময় বদলেছে। বড়রা ক্রমশ বুঝতে পারছে আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। চারাগাছ থেকে যেমন সহসাই ফল-ফল মেলে না, সুমিষ্ট ফলের জন্য এবং সুবাসিত ফুলের জন্য চারাগাছকে যেমন অতি যত্নে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে হয়, তেমনি শিশুদেরও যত্ন প্রয়োজন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেক শিশুই সমঅধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্য সব অধিকার, স্বাধীনতা পেতে কোনো তারতম্যের শিকারই হবে না। কিন্তু সমাজ সংস্কারের প্রচলিত বিধি-বিধান, আইন-কানুন যেন অনেক কিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যার কোনো যৌক্তিক কিংবা আইনত, ধর্মত, কোনো ব্যবধানই স্বীকৃতি পায়নি। একজন শিশুকে যদি শিশু হিসেবেই মূল্যায়ন করা যায় তা হলে বিবদমান কোনো অসম পরিস্থিতি সামনেই আসে না। পুত্র-কন্যা শিশু জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার প্রাক্কালেই কেমন করে যেন সূক্ষ্ম ব্যবধান থেকে বৃহদাকার বৃত্তে পরিণত হয় তাও চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থার চরম বিভাজন। সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে নিত্য নতুন নীতি নৈতিকতা প্রণয়ন করছে সেটাও যে খুব কার্যকরী হচ্ছে তা নয়। প্রচলিত সংস্কার, বিশ্বাস, মূল্যবোধ সামাজিক কাঠামোর গভীরতম স্থানে শিকড় থেকে সুগ্রথিত। যেখানে অসাম্য, বৈষম্যও মাথাচাড়া দিতে সময় নেয় না। প্রচলিত মূল্যবোধে বিশ্বাসী জনগণ চলে আসা দীর্ঘকালীন সংস্কারকে মুছে ফেলতে যুগ-যুগান্তরের অপেক্ষার পালাও যেন শেষ হয় না। সঙ্গত কারণে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়েও আমাদের লিঙ্গ সমতার জন্য জোরেশোরে আওয়াজ তুলতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কন্যা শিশুদের জন্য আরও কিছু অধিকার, ন্যায্যতার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালের স্পর্শকাতর সময়ে এক উদীয়মান কিশোরীর স্বাস্থ্য সচেতনতা তার সব ধরনের নিরাপত্তার জন্য জরুরি। বাল্যবিয়ের মতো মান্ধাতা আমলের প্রচলিত অপসংস্কারকে জোরেশোরে প্রতিরোধ করা কন্যা শিশুর শরীর-মনের জন্য নিতান্ত দায়বদ্ধতা। যা সবার আগে পরিবার থেকে শুরু করা বাঞ্ছনীয়। কন্যা শিশুর ওপর কোনো ধরনের সহিংস আঁচড় বিধিগতভাবে শুধু প্রতিরোধ নয় বাতিলের পর্যায়ে নিয়ে আসা পরিস্থিতির ন্যায্যতা। পারিবারিক দায়বদ্ধতার পরবর্তী পর্যায়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বলয় নিশ্চিত করা। যা সম্মিলিত এক মহা কর্মযোগ। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে নৃশংসভাবে উঠে আসে একজন কন্যা শিশুর নাকি তার নিজ পারিবারিক পরিবেশেও নিরাপত্তার বেষ্টনী পেতে হিমশিম খেতে হয়। আর উত্তরাধিকার আইনে পিতার সম্পত্তিতে সম অধিকার না পাওয়া ও কন্যা শিশুর জন্য আর এক বৈমাত্রেয় বিভাজন তো বটেই।
দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব নির্বিশেষে আমাদের সমাজে এমনকি নিজের পরিবারেও লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মেয়ে শিশুর প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণ। ফলে অনেকাংশেই দরিদ্রতার প্রথম শিকার হয় কন্যা শিশুরা। কিছু সামাজিক কথিত নীতির কারণে শিশুকাল থেকেই কন্যা শিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যাতে করে তারা প্রতিবাদী হতে না শেখে। তাদের প্রতি করা বৈষম্যমূলক আচরণকে অন্যায় হিসেবে না দেখে বরং সহজাত ও সমঝোতার সঙ্গে গ্রহণ করতে শেখানো হয়। যা পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার পথটিকে প্রশস্ত করতে সাহায্য করে। বর্তমান আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজব্যবস্থায় আমরা কথায় কথায় বলি, "সন্তান ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, মানুষ হওয়াটাই আসল কথা।" কিন্তু অনেকেই মৌখিকভাবে তা মানলেও মনে মনে ঠিকই চিন্তা করেন "সন্তান হতে হবে ছেলে।" কন্যাসন্তান হওয়ার ক্ষেত্রে একজন নারীর কোনো ভূমিকা নেই—এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি শিক্ষিত পুরুষটি জানার পরও মানসিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এ দায় চাপিয়ে দেন নারীর ওপরই। ফলে কোনো অন্যায় না করে আমাদের দেশে হাজার হাজার নারী কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অভিযোগে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেন।
বাংলাদেশে কত কন্যা ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশের সরকারের কাছে নেই। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গুতম্যাকার ইনস্টিটিউটের এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১১ লাখ ৯৪ হাজার স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। নানান কারণে এসব গর্ভপাত ঘটানো হয়। তবে উদ্বেগের চিত্রটি হলো, অনেক দম্পতি ছেলে সন্তানের আশায় থাকে। শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয় শিশু আইন-১৯৭৪ যা যুগোপযোগীকরণের মাধ্যমে শিশু আইন-২০১১ রূপে প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯-এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এরপরেও শিশুর প্রতি বৈষম্য আর অধিকারের বিষয়টি আমরা ভুলে যাই। প্রকৃত অর্থে শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের একটি উক্তি রয়েছে, "আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো।" শিক্ষা কন্যা শিশুর উন্নয়ন, বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিশু মৃত্যুর হার কমানোর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং প্ল্যান বাংলাদেশের এক যৌথ জরিপ মতে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা ২৬ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। নিরক্ষর নারীদের বেলায় এই সংখ্যা ৮৬ শতাংশ।
কন্যা শিশু ও নারীকে অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মধ্যে রেখে কখনোই একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে উঠতে পারে না। এই বাস্তবতায়, নারী ও কন্যা শিশুর শিক্ষার বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। সেটি শুরু করতে হবে কন্যা শিশুর জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগের মধ্যদিয়ে। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে তাদের জন্য সমসুযোগ ও সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাদেরকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। আর এই মানবসম্পদ গড়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে কন্যা শিশুর জন্মলগ্ন থেকেই। মনে রাখতে হবে, আজকের কন্যা শিশু আগামী দিনের একজন সুশিক্ষিত মহীয়সী নারী ও আদর্শ মা এবং সেই আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করবে। আমরা সকলের জন্য একটি আলোকিত সময়ের স্বপ্ন দেখি। আমরা কোনো বৈষম্য চাই না। আমরা চাই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পর্যায়ে মানুষের সম্মান নিশ্চিত হোক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য