টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এনামুল হক এনাম | ২১ নভেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথম যে বিপন্ন ছবি ভেসে ওঠে, সেটা হলো এক ভঙ্গুর অর্থনৈতিক নৌকা। এতে ফুটো যত, উন্নয়ন ততটা নয়। এই বাস্তবতায় গণতন্ত্রকে অনেকে বর্ণনা করেন সমাধান হিসেবে, কিন্তু আমাদের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র অনেকটা বাসমতি চাউলের বিরিয়ানি খেতে দাঁতহীন লোকের চেষ্টার মত, চেবানোর চেষ্টা করে... কিন্তু আদতে গিলে ফেলতেই হয়। বলতে পারেন এই তন্ত্র নৈতিকভাবে আকর্ষণীয়, কিন্তু বাস্তবে সুবিধে পাওয়া কঠিন। কারণ গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে ভোটদাতার মানসিক পরিপক্বতা, শিক্ষাগত সক্ষমতা, আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার উপর। আর আমাদের দেশে এই তিনটির যে ভয়াবহ ঘাটতি আছে, সেটা দেখে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছু বের হয় না।
গড় আয় একটু বাড়লেই কিছু মানুষ খুশিতে লাফায়, কিন্তু সেই আয় দিয়ে আজকাল পরিবারের বাজারই সামলানো যায় না। এই দুরবস্থায় স্বাক্ষরতাকে শিক্ষার প্রমাণ ধরে নেওয়া হয়। হাতে কলম লিখতে পারলেই শিক্ষিত, আর ভাবতে পারা, বিচার করতে পারা, যুক্তি ধরতে পারা এই গুণগুলো যেন বিলাসদ্রব্য। তাই ভোটের সময় মানুষ তাদের বাস্তবতা নয়, ভালোবাসা, আবেগ, ঈর্ষা, প্রতিশোধ আর হুজুগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।
টাইটানিকের ক্যাপ্টেন বাছাই করতে যদি ভোট দিতাম, হয়তো নায়ক শাকিব খানকে বেছে নিত আবেগে। আর হিরো আলমকে দিতাম কৌতুক করে। কিন্তু টাইটানিকের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা তো ভোটের সময় কেউই ভাববে না। এটাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত জায়গা। গণতন্ত্র ধরে নেয়, মানুষ যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু আমাদের সমাজে মানুষ ভোটের আগেই দল, গোত্র, ধর্ম, পাড়া, এলাকায় বন্দি হয়ে পড়ে। তখন যোগ্যতা আর অযোগ্যতা একাকার হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে কেন আমি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যৎ দেখি না, তার পেছনে আমার কিছু যুক্তি আছে। যেমন, প্রথমত, আমাদের সমাজে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যক্তির জ্ঞান দিয়ে নয়, দলীয় আনুগত্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। এতে নেতৃত্ব আসে না দক্ষ লোকের হাতে, আসে স্লোগানমুখী লোকের হাতে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব মানুষকে ভোট বাণিজ্যের দিকে ঠেলে দেয়। যে টাকা দিতে পারে, সেই নেতা হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র তখন নীতির নয়, টাকার ধর্মে পরিচালিত হয়। তৃতীয়ত, প্রচলিত ধর্মীয় আবেগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে নির্ধারণ করে। যুক্তির জায়গা খুব সামান্য থাকে, আর ফাঁকা থাকে চিন্তার আসন। চতুর্থত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নপত্র মুখস্থ করায় অভ্যস্ত করে, প্রশ্ন করতে শেখায় না। গণতন্ত্র প্রশ্ন করতে শেখা লোক চায়, আর আমরা তৈরি করি ফরমায়েশি শিক্ষার্থী। পঞ্চমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুজব, বিভাজন আর আবেগকে উসকে দেয়। এতে গণতান্ত্রিক আলোচনা হয় না, হয় আবেগের মারপ্যাঁচ।
বাস্তবতার নিরিখে গণতন্ত্রকে আমি আমাদের সমাজের জন্য কার্যকর মনে করি না। বরং মনে হয়, এটা যেন সোনার মোড়কে ফ্যালাসি। মসৃণ, পরিচ্ছন্ন, আকর্ষণীয়, কিন্তু ভেতরে নরম কাঠ।
এমন পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্র অস্থায়ীভাবে কার্যকর হতে পারে, এই মত পোষণের কারণও যুক্তিপূর্ণ। প্রথমত, সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক দায়িত্ব নিতে বাধ্য করে। ভঙ্গুর অর্থনীতিতে এটা দরকার। বাজারের খেয়ালিপনায় মানুষ বাঁচে না। দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্র শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত করতে আগে শিক্ষা দরকার, পরে ভোট। তৃতীয়ত, সমাজতন্ত্র সম্পদের বৈষম্য কমাতে পারে। বিশাল আয়ের ব্যবধান রাষ্ট্রকে অস্থির করে, এতে গণতন্ত্র কার্যকর হয় না। চতুর্থত, নতুন প্রজন্মকে মুক্তচিন্তা আর সমালোচনামূলক ভাবনার সুযোগ দিতে সমাজতান্ত্রিক কাঠামো উপকারী। বাজারনির্ভর প্রতিযোগিতার চাপ কম থাকলে চিন্তার ক্ষমতা বাড়ে। পঞ্চমত, সাময়িক নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করে। বিশৃঙ্খল গণতন্ত্রের চেয়ে স্থিতিশীল সমাজতন্ত্র অনেক সময় বেশি মানবিক।
গণতন্ত্রের রূপকাররা কিন্তু বলেছিলেন, শিক্ষা, স্বচ্ছতা আর সমালোচনা না থাকলে গণতন্ত্র চলে না। আমাদের সমাজে এ তিনটিরই গভীর সংকট। তাই “Democracy won’t lift the uneducated or the unprepared toward real socioeconomic freedom.” এটা কঠোর শোনালেও সত্যি। গণতন্ত্র একটি সুন্দর ধারণা, কিন্তু আমাদের সমাজে এটা এখনো বাস্তব নয়।
সমাজ আগে তৈরি হবে, গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত হবে, তারপর গণতন্ত্র। না হলে ভোট শুধু হুজুগের হাতেই বন্দী থাকবে। আমাদের রাষ্ট্রযাত্রা তখনই নিরাপদ হবে, যখন যাত্রী চিন্তা করবে, ক্যাপ্টেন জানে কি না জাহাজ চালাতে। তার আগে গণতন্ত্রের চেয়ে কুশাসনও কখনো কখনো কম ক্ষতিকর হয়। এটাই আমাদের সময়ের কঠিন সত্য।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য